উত্তরপ্রদেশে মসনদে ফের যোগী, কেন দাগ কাটতে ব্যর্থ বিরোধীরা

চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। কিন্তু সেসব অতিক্রম করে ফের একবার উত্তরপ্রদেশের মসনদে যোগী আদিত্যনাথ। এইবারের ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল বিজেপির অন্দরে ও। করোনার সময় থেকে একের পর এক ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বেশ চাপেই ছিলেন যোগী। কিন্তু ২০২২-এর ভোটের অঙ্ক প্রমাণ করল যোগীর প্রতি উত্তরপ্রদেশের আমজনতার ভরসা এখনও অটুট।

করোনা পরিস্থিতিতিতে ইউপির সামগ্রিক চিত্র গোটা দেশের কাছেই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। গঙ্গার চর ধরে কমলা শালুতে মুড়িয়ে মৃতদেহের সারির ছবি কিংবা অক্সিজেনের অভাবে ছটফটিয়ে রোগীর মৃত্যু সবমিলিয়েই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকি এই পরিস্থিতিতে ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য মাঠে নেমেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং বারানসীর সাংসদ নরেন্দ্র মোদী। উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে গুজরাট ক্যাডারের পোড় খাওয়া আমলা একে শর্মাকে পাঠিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বলাই বাহুল্য নিজের রাজ্যে কোনও দিল্লির আমলার খবরদারিকে কার্যত পাত্তাই দেননি যোগী আদিত্যনাথ।

করোনা পরিস্থিতি ছাড়া ও বিজেপির অন্যতম পথের কাঁটা ছিল কেন্দ্রের কৃষি বিল নিয়ে উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের ক্ষোভ। এই সব অশান্তির রেশ ধরেই পুর ভোটে বেশ খারাপ ফল করেছিল বিজেপি। বিরোধীরা ও এর সুযোগ নিতে কসুর করেননি। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লখনউর সিংহাসন থেকে খালি হাতেই ফিরতে হল সমাজবাদী পার্টিকে।

আশা জাগিয়েও কেন ব্যর্থ অখিলেশ?

উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে গোটা দেশের যে বিজেপি বিরোধিতা তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন অখিলেশ যাদব। কৃষি বিল নিয়ে উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের ক্ষোভ থেকে শুরু করে যোগীর মেরুকরণের রাজনীতি সব নিয়েই মানুষের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করেছিলেন মুলায়ম পুত্র। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে জাতের রাজনীতি ভোটের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ট্রাম্প কার্ড। কৃষকদের মধ্যে জাঠ, কুর্মি সম্প্রদায়ের মানুষদের একটা অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন অখিলেশ। আবার মুসলিম ভোটারদের ক্ষেত্রে ও একটা অংশ সমাজবাদীর পার্টির পক্ষে ছিল। অপরদিকে উত্তরপ্রদেশের উচ্চবর্ণ হিন্দুদের সমর্থন অটুট ছিল বিজেপির প্রতি। এমনকি নিম্নবর্গের কিছু গোষ্ঠীকেও নিজেদের হিন্দুত্ববাদী ছাতার তলায় আনতে সমর্থ হয়েছিলেন যোগী। 

কিন্তু অখিলেশের পূর্ব উত্থানও মিথ্যে ছিল না। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে অখিলেশের জনসভায় ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু শেষমেশ এই টক্করে পারলেন না অখিলেশ। যদি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে উত্তরপ্রদেশের গদিতে অখিলেশের বসা হল না ঠিকই কিন্তু বিজেপির নিরঙ্কুশ আধিপত্যে খানিক হলে ও থাবা বসাতে পেরেছেন অখিলেশ। আসনের বিচারে দেখলে ২০১৭ এর নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি পেয়েছিল ৪৭ টি আসন। অন্যদিকে বিজেপির ঝুলিতে ছিল ৩১২ টি আসন। সেখানে এইবার ২০২২ এর নির্বাচনে বিজেপি ২৬৯ টি আসনে এগিয়ে।অন্যদিকে সমাজবাদী পার্টি ৪৭ থেকে এইবার ১১৫ টি আসনে এগিয়ে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে খানিকটা হলেও জাতধর্মের রাজনীতি এবং বিজেপি বিরোধিতার ফায়দা তুলতে পেরেছেন অখিলেশ। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র কারহল থেকে ও বড় মাপের জয় পেয়েছেন অখিলেশ যাদব।

কিন্তু তাত ও যোগীর বিজয়রথকে আটকানো যায়নি। বিজেপির অন্দরে যোগীর উগ্র হিন্দুত্ব নিয়ে অসন্তোষ থাকলে ও নাগপুরের নির্দেশেই যোগীকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করেছিল বিজেপি। যোগী বিরোধীরা যতই যোগীর শাসনের দিকে আঙুল তুলুক সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল তার দিকেই। পেট্রোল ডিজেলের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি, করোনা কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা, বাজারের মন্দা সব নিয়েই উত্তরপ্রদেশের বেশিরভাগ মানুষের মত ছিল গোটা বিশ্বের যেখানে এমন শোচনীয় অবস্থা সেখানে আলাদা করে এই ব্যর্থতার দায় আদিত্যনাথ বা মোদীর নয়। এই যে বিজেপির উত্তরপ্রদেশ বিজয় তার মূলেই রয়েছে হাজার ব্যর্থতার পরও সফলভাবে ভোটারদের মন জয়। 

ভোটের আগে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণে আশি- কুড়ির তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিতে বুলডোজার থিওরি সবমিলিয়ে যোগী আদিত্যনাথ তার হিন্দু রাজনীতি নিয়ে ছিলেন অবিচল নির্বিকল্প। যোগীর রাজ্যে ঠাকুর সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়ি নিয়ে ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ ছিল হয়তো কিন্তু যোগী জানতেন কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট। ফলে এইবার সব বিরোধিতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে লখনউ-এর তখতে যোগীই।

More Articles