সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থেকে সোজা মুখ্যমন্ত্রী! উত্তরপ্রদেশে অখিলেশের সম্ভাবনা কতটা?

উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আকাশে সমাজবাদী পার্টি যেন একটি সাত-রঙা রামধনুর মতোই দীপ্তিমান। আর সেই রামধনুর মধ্যে থেকেও যে রঙটি সবথেকে বেশি করে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেখানেই অবস্থান করছেন সমাজবাদী পার্টির মুখ তথা তাদের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী অখিলেশ যাদব। ৮২ বছর বয়সি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মুলায়ম সিং যাদবের সুপুত্রের জন্য এই নির্বাচন কোনো অগ্নিপরীক্ষার থেকে কম নয়। দেখার মত এই লড়াইয়ে একদিকে আছেন অখিলেশ। অন্যদিকে, তার সমস্ত অস্ত্রকে ব্যর্থ করতে রণংদেহী মেজাজেই আছেন যোগী আদিত্যনাথ। 

২০১২ বিধানসভা নির্বাচনের বছর কয়েক আগে সক্রিয় রাজনীতিতে বাবার ছত্রছায়া ছেড়ে স্বাধীনভাবে পদার্পণ। সমাজবাদী পার্টির প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে সেই সময় যেন উপচে পড়ছে রাজনৈতিক মামলার ফাইল। গুন্ডাদের দল হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে সমাজবাদী পার্টি। ঠিক সেই সময়ে তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে সামনে এসে দাড়ালেন অখিলেশ যাদব। প্রযুক্তি প্রেমী, আইফোন ব্যবহারকারী, রক সঙ্গীতের ভক্ত এই তরুণ রাজনীতিবিদকে সাফল্য এনে দিলেন উত্তরপ্রদেশের সাধারন জনতা। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা, প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা রাখা এহেন এক তরুণ মাত্র ২৭ বছর বয়সেই কেন সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিলেন? মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মানুষের কতটা দাবি পূরণ করতে পারলেন তিনি? আর আগামী ভবিষ্যতেই বা তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনা কত দূর? 

উত্থান পর্ব 

২০০০ সাল থেকেই উত্তরপ্রদেশের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও অখিলেশ যাদব ছিলেন সব সময় বাবা মুলায়ম সিং যাদব এর ছত্রছায়ায়। কিন্তু, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, তার চিন্তাধারা সবকিছুই একেবারে পাল্টে দেয় ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। নির্ভেজাল ফ্যামিলি ম্যান অখিলেশ যাদবকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় লড়াইয়ের ময়দানে।

২০০৯ লোকসভায় স্ত্রী ডিম্পল যাদবের পরাজয়ে অখিলেশ যাদব বোঝেন, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির অবস্থা একেবারে শোচনীয়। সেখান থেকেই শুরু অখিলেশ যাদবের উত্থান। সেই সময় সমাজবাদী পার্টির সিংহভাগ নেতার বিরুদ্ধে কোর্টে চলছে একাধিক মামলা। রাজনৈতিক তথা সামাজিক কিছু মামলার ভারে তখন জর্জরিত অবস্থা গোটা দলের। ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব তাই নিজের কাঁধেই গ্রহণ করলেন অখিলেশ। যুবকদের মধ্যে নিজেকে একটি আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। মাঠে নেমেই একেবারে ছক্কা হাঁকাতে শুরু করলেন। 

আরও পড়ুন-হেস্টিংসের দুর্নীতি ফাঁসের মাশুল, হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার

২০১২ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের সময় যখন অন্যান্য দলগুলো সবে পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছে, ততক্ষণে অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের সিংহভাগ জায়গা চষে ফেলেছেন। মিডিয়াতেও শুরু হয়ে গিয়েছে অখিলেশ যাদবের জয়জয়কার। অখিলেশকে অশ্বমেধের ঘোড়া হিসেবে ব্যবহার করে পুরনো ফর্ম ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সমাজবাদী পার্টি। দলের প্রত্যেকটি জনসভা, প্রত্যেকটি মিছিলে তখন মুখ শুধুমাত্র অখিলেশ। ইন্টারনেট তখনও ততটা সহজলভ্য না হলেও, কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করেছিল মানুষ। তাই হয়তো মুলায়ম সিং যাদবের ইংরেজি-বিরোধী এবং কম্পিউটার-বিরোধী ইমেজটাকে ভাঙার প্রয়োজন ছিল।

আর সেই কাজটাই করে দেখালেন অখিলেশ। হাতে আইফোন নিয়ে, মুখে ইংরেজিতে বুলি আওড়ানো অখিলেশ যাদব খুব কম সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠলেন উত্তরপ্রদেশের যুবসমাজের প্রাণপুরুষ। অখিলেশ সমাজবাদী পার্টির সাইকেলের চালকের আসনে বসতে না বসতেই দলের হাবভাব যেন পুরো পাল্টে গেল। প্রত্যেকটি জনসভায় অখিলেশ যাদব ঘোষণা করলেন, তিনি পড়ুয়াদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেট প্রদান করবেন, বেকারদের কাজ দেবেন কারখানায়, চাষীদের দেবেন বিনামূল্যে বিদ্যুৎ। এছাড়াও দল থেকে গুন্ডাদের দমন করার জন্য প্রথমবারের জন্য পার্টি অফিসে নিয়ে এলেন কম্পিউটার। সব মিলিয়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন অখিলেশ যাদব।

অখিলেশের ৫ বছর 

১৫ মার্চ ২০১২, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশের কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে লখনৌ এর সিংহাসনে বসলেন অখিলেশ যাদব। ২০০০ এর লোকসভায় কনৌজ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাজনীতিতে হাতে খড়ি করা মুলায়ম পুত্রের উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা শুরু বলতে গেলে ২০১২ থেকেই। তার আগে অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে খুব একটা জায়গা করে নিতে পারেননি। মুলায়ম সিং যাদব নিজের জীবনে কখনো একটানা ৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। তবে, অখিলেশ সেটা পেরেছিলেন। ২০১২ থেকে ২০১৭, টানা পাঁচ বছর উত্তরপ্রদেশের সিংহাসনে আসীন ছিলেন অখিলেশ যাদব। এই সময়কালে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সূচনা এবং তার সম্প্রসারণ করেছিলেন অখিলেশ।

তার রাজনৈতিক ট্র্যাক রেকর্ড এর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, আগ্রা-লখনৌ এক্সপ্রেসওয়ে, লখনৌ মেট্রো, কামধেনু যোজনা, লোহিয়া আবাস যোজনা, শ্রবণ যাত্রাসহ একাধিক প্রকল্প তিনি চালু করেন। অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বেই উত্তরপ্রদেশ সরকার মাত্র ২ বছরের মধ্যেই তৈরি করেছিল ৬ লেন বিশিষ্ট বিশাল হাইওয়ে আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে। উত্তরপ্রদেশ এক্সপ্রেসওয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ২০১৪ সালে এই প্রকল্প শুরু করে যা মাত্র দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করেন অখিলেশ।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার কাজের তালিকায় পরবর্তী বড় মাইলফলক ছিল লখনৌতে মেট্রো চালু। ২০১৩ সালে উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনৌ শহরের মেট্রোরেলের কাজ শুরু করার অনুমতি দেন অখিলেশ যাদব। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর লখনৌ মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয় যা ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শেষও করে দেন অখিলেশ। পরিসংখ্যান বলে, লখনৌ শহরের মেট্রোই নাকি ভারতের সবথেকে কম সময়ে তৈরি মেট্রো ছিল। এছাড়াও ২০১৬ এর ডিসেম্বরে ৫২,৪৩৭ কোটি টাকার পাওয়ার প্রজেক্টও শুরু করেছিলেন অখিলেশ যাদব। তিনটি থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট সহ দক্ষিণ কোরিয়ার একাধিক কোম্পানির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছিল এই বিশেষ প্রজেক্ট। 

উত্তরপ্রদেশে গ্রামীণ মহিলাদের উন্নয়নেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন অখিলেশ যাদব। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসা মাত্রই তিনি চালু করেন ১০৯০ মহিলা হেল্পলাইন নম্বর, যার মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের প্রত্যেকটি স্তরের মহিলার ক্ষমতায়ন করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এই নম্বরটি ছিল সারা রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য। এই নম্বরে ফোন করলেন মহিলারা যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানাতে পারতেন মুহূর্তেই। এছাড়াও পুলিশের কাছেও অভিযোগ দায়ের করা যেত এই নম্বরের মাধ্যমে। 

তার সাথেই ছিল ডেয়ারি স্কিম কামধেনু যোজনা, যা উত্তরপ্রদেশকে করে তুলেছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ দুগ্ধ উৎপাদনকারী রাজ্য। এছাড়াও আছে কিষান আওয়াম সর্বিত বীমা যোজনা, কিষান বাজার, লোহিয়া আবাস যোজনা, সমাজবাদী স্বাস্থ্যসেবা, শ্রবণ যাত্রার মতো একাধিক প্রকল্প যা মূলত উত্তরপ্রদেশের একেবারে প্রান্তিক জনতাকে টার্গেট করেই তৈরি করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি প্রকল্প সফল হয়েছিল কিনা সেই নিয়ে বিতর্ক কম নয়। তবে হ্যাঁ, অখিলেশ যে উত্তরপ্রদেশের প্রান্তিক জনতার মন পড়তে পেরেছিলেন সেটা অস্বীকার করা যাবে না।

​​​বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে স.পা. 

অখিলেশ যাদব এবং সমাজবাদী পার্টি যতই দাবি করুক না কেন, অখিলেশের সময়কালে উত্তরপ্রদেশে বিতর্ক যে খুব একটা কম হয়েছে তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সবসময়েই ব্যাকফুটে ছিলেন অখিলেশ। এছাড়াও, সাফাই অভিযানে যাদব বংশীয়দের বাদে বাকিদের যোগদানের অনুমতি না থাকা, কৃষকদের জন্য প্রকল্প ঘোষণা করে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, ৫ বছরে কেবলমাত্র একটি হাইওয়ের উন্নয়ন, মাত্র একটি মেট্রো প্রকল্পের শুরুয়াত থেকে শুরু করে আর্থিক ঘোটালা, একাধিক দিকেই ব্যর্থ ছিল অখিলেশের সরকার। 

সর্বোপরি, উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটা সবথেকে বর্বরোচিত দাঙ্গার ঘটনা, ২০১৩ মুজাফফরপুর দাঙ্গাও কিন্তু হয়েছিল অখিলেশ যাদবের আমলেই। এই দাঙ্গার সময় শুধু বিরোধীরাই না, সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকেও নোটিশ জারি করে অখিলের সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কড়া কথা শোনানো হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, যেহেতু সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে চটাবেন না, তাই মুজাফফরপুর দাঙ্গাকে ঠেকানোর জন্য কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি অখিলেশ যাদব। যার জন্য শেষে গদি পর্যন্ত খোয়াতে হয়েছিল অখিলেশকে।

২০২২ ও অখিলেশ 

অখিলেশ যাদবের জন্য এবারের বিধানসভা নির্বাচন দলের থেকেও নিজের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনেই জীবনে প্রথমবারের জন্য বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে নামতে চলেছেন সমাজবাদী পার্টির রাজপুত্র। তিনি বরাবরই লোকসভায় থাকতে বেশি পছন্দ করেন। ২০০০ সালে কনৌজ লোকসভা থেকে জয়লাভের পর থেকেই তার আনাগোনা লোকসভায় চিরকালই বেশি। এমনকি, ২০১২ সালেও যে তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেরকমটা নয়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় তিনি ছিলেন উচ্চকক্ষের সদস্য। ২০১৭ সালে ক্ষমতা চলে গেলেও তিনি দমে যাননি, বরং ২০১৯-এ আবারো তিনি চলে যান লোকসভায়। 

বস্তুতই, ২০২২ বিধানসভা নির্বাচন তার জন্য সম্পূর্ণ একটি নতুন পরীক্ষা। বিধানসভা নির্বাচনের চাপ লোকসভার থেকে সব সময়ই বেশি থাকে। আর যদি সেই রাজ্য হয় উত্তরপ্রদেশ তাহলে তো আর কথাই নেই। তাই প্রচারেও তিনি কোন খামতি রাখতে চাইছেন না। একদিকে যেমন মোদি বারানসী থেকে গেরুয়া ঝড় তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন, তেমনি তাকে ঠেকানোর জন্য একেবারে তেড়ে-ফুঁড়ে নেমেছেন অখিলেশ। একাধিক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট তৈরি করে বিজেপিকে ঘিরে ফেলতে চাইছেন তিনি। প্রায় ৬ থেকে ৭টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট স্থাপন করে তাদেরকে নিয়ে একসাথে জনসভা করছেন অখিলেশ যাদব। 

ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে যখন কাশী বিশ্বনাথ করিডরের পুনঃনির্মাণের ঘোষণা করলেন মোদি, তার ঠিক পরের দিনেই পাশের জেলা জৌনপুরের মিছিলে শক্তি প্রদর্শন করেন অখিলেশ। সেই জনসভাতেই বিজেপি ছেড়ে সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান করেন পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর দুই উচ্চপদস্থ মন্ত্রী এবং একাধিক বিধায়ক। যার ফলশ্রুতি, আপনা দল এবং নিষাদ পার্টির সঙ্গে জোট স্থাপনে বাধ্য হয় বিজেপি। মুহূর্তের মধ্যেই হিন্দুত্বের পাশাপাশি বিজেপির প্রচারকার্যে জায়গা করে নেয় 'গরিব কল্যাণ'-এর মত স্লোগান।

উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য আবার পন্থা আলাদা রকমের। সেখানে আবার জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করছেন অখিলেশ। মুজাফফরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে মুসলিম এবং জাঠ জনগোষ্ঠীরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, দীর্ঘ সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলন তাদেরকে আবার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এই বিষয়টা বেশ ভালোভাবেই জানেন অখিলেশ। তাই জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে জোট করে পশ্চিম-উত্তরপ্রদেশের সিংহভাগ ভোট নিজের দিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনায় আছেন তিনি। সঙ্গেই তার তুরুপের তাস হিসেবে রয়েছে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অক্ষমতা, বেকারত্ব, জিডিপি হ্রাস, সহ একাধিক বিষয় যা তাকে উত্তরপ্রদেশের মানুষের কাছে ফেভারিট করে তুলতে পারে। 

তবে ২০১২-র ভুলটা এবারে আর করছেন না তিনি। ওবিসি এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উপর যাদব জনগোষ্ঠীর প্রভাবের কারণে অনেকেই ২০১৭ বিধানসভায় বিজেপির দিকে চলে যান, যার ফলে ক্ষমতা হারাতে হয় অখিলেশকে। কিন্তু এবারে, সমস্ত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একসাথে এগোনোর পন্থা নিয়েছেন অখিলেশ, যা তাকে এনে দিতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। মায়াবতীর দলিত ভোটব্যাঙ্কের উপরেও তার কড়া নজর রয়েছে। এবারের বিধানসভায় তার নতুন স্লোগান, "পিছড়ো কা ইনকিলাব হোগা", যার মাধ্যমে তিনি টার্গেট করছেন একেবারে দলিত শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ককে, যেখানে প্রধানত মায়াবতীর প্রভাবটাই বেশি থাকে। পাশাপাশি, যোগী আদিত্যনাথ এর বিরুদ্ধে ঠাকুরবাদ তত্ত্ব তৈরি করে যাদব নয় এমন ওবিসি জনগোষ্ঠীর ভোট টানার পরিকল্পনাতেও আছেন অখিলেশ। সম্পূর্ণ উত্তরপ্রদেশের মাত্র ১২ শতাংশ ঠাকুর জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। সেই জায়গায় বিজেপিকে সরিয়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তাই তাদের বাদ দিয়েই বাকি আসনগুলির দিকেই লক্ষ্য অখিলেশের।

বহু জন সমাজ পার্টি এবং কংগ্রেস যেখানে একেবারে বিলুপ্তপ্রায়, সেখানেই বিজেপির জয়রথ আটকে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখছেন অখিলেশ। তবে হ্যাঁ, অসম্ভব না হলেও কাজটা একেবারে সহজ হবে না অখিলেশের জন্য। পুরনো পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যাবে ২০১২ সালে যখন প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন অখিলেশ, সেই সময় সমাজবাদী পার্টির ভোটের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ, যেখানে মায়াবতীর বহু জন সমাজ পার্টি পেয়েছিল ২৬ শতাংশ ভোট এবং বিজেপির দখলে ছিল ১৫ শতাংশ ভোট। তবে, ২০১৭ বিধানসভায় ছবিটা একেবারে পাল্টে যায়। 

মায়াবতীর দল ২৬ শতাংশ ভোট আর হয়তো পাবে না। ২০১২ সালে বিজেপির কাছে তেমন কোনো মুখ ছিল না, কিন্তু ২০২২ এ যোগী আদিত্যনাথ শক্ত হাতে হাল ধরেছেন বিজেপির। গতবারের বিধানসভায় ২০১২ সালে ৪৭ টি আসন পাওয়া বিজেপি পেয়েছিল ৩২৫ টি আসন! যেখানে সমাজবাদী পার্টি এবং বহু জন সমাজ পার্টির আসন সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছিল একেবারে তলানিতে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, যোগী আদিত্যনাথের বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ হবে না।

আরও পড়ুন-কতটা ভয়ঙ্কর করোনা ভ্যারিয়েন্ট নিওকোভ, জানা গেল নতুন গবেষণা থেকে

আর যদি পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অখিলেশ যাদবও একই স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন তাহলে তিনি কখনোই সফল হতে পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে প্রধান তফাতটা হল, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ধর্মের রাজনীতি খুব একটা কাজ করে না। পাশাপাশি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তৃণমূল স্তরের নেত্রী এবং ১০ বছর ধরে তিনি বাংলার সিংহাসনে আসীন ছিলেন। বাংলায় বিজেপির তেমন কোন বড় মুখ ছিল না। আর, উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। উত্তরপ্রদেশে ধর্মের রাজনীতি খুব ভালো প্রভাব ফেলে। উত্তরপ্রদেশের একটা বড় অংশের মানুষের ওপর যোগী আদিত্যনাথ এর একটা আলাদা রকমের প্রভাব রয়েছে। আর যোগী আদিত্যনাথ এর পিছনে রয়েছেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যাকে রাজনৈতিক বুদ্ধিতে টেক্কা দেওয়া অখিলেশের জন্য অত্যন্ত শক্ত কাজ। 

অখিলেশের ভাগ্যে কি আছে, তা তো বলবে সময়। তবে ২০১৭-র থেকে যে ২০২২-এ অখিলেশের অবস্থা অনেকটাই ভালো সেটা বলাই বাহুল্য। সমাজবাদী পার্টির ভাবমূর্তি অনেকাংশেই উজ্জ্বল করেছেন অখিলেশ যাদব। গুন্ডাবাহিনীর পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সমাজবাদী পার্টি, আজ অনেকটাই ভালো জায়গায়। একাধিক ভালো ভালো প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন অখিলেশ। সঙ্গেই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে, করহাল বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করবেন তিনি, যা সমাজবাদী পার্টির সমর্থকদের বাড়তি অক্সিজেন যোগাতে পারে। সর্বোপরি, যুবকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেশ ভালো, যা তার জন্য একটি বড় অ্যাডভান্টেজ হতে পারে। খাতায় কলমের পরিসংখ্যানে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে অখিলেশ উত্তরপ্রদেশে কিছু জায়গায় তো আবারো ফিরবেন, তবে পুরোটা কি তার কবলে আবার আসবে? সেই উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কিছুদিন।

More Articles