কতটা ভয়ঙ্কর করোনা ভ্যারিয়েন্ট নিওকোভ, জানা গেল নতুন গবেষণা থেকে

নিওকোভ (NeoCoV) নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেকে ভীত, কেউ কেউ আবার এখনও নিওকোভের ভয়াবহতা কতখানি হতে পারে সেই নিয়ে ধন্ধে।  নিওকোভ আদতে কী ধরণের করোনাভাইরাস (Coronavirus)? কতটা ভয়াবহ হতে পারে এর প্রভাব? আমাদের কী সত্যি ভয় পাওয়া উচিত, এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিলেন একদল বিজ্ঞানী।

প্রথমত, করোনাভাইরাসের শ্রেণিবিন্যাস (Classification) করলে দেখা যাবে, এদের একটি বিশাল গোত্র বা ফ্যামিলি রয়েছে। এই গোত্র বা ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত করোনাভাইরাসগুলি হয় মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীদের আক্রমণ করে। এদের আবার চার রকমের জেনাস (Genus) আছে। সেগুলি হল – আলফা (Alpha), বিটা (Beta), গামা (Gamma), এবং ডেল্টা (Delta)। সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে আলফা এবং বিটা করোনাভাইরাস বাদুড় এবং মানুষের মতো বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আক্রমণ করে। অন্যদিকে গামা এবং ডেল্টা প্রজাতির করোনাভাইরাস কেবল পাখিদের আক্রমণ করে।

বলা ভালো করোনাভাইরাসের জেনাস আলফা, বিটা, বা ডেল্টার সাথে কিন্তু নোভেলকরোনা ভাইরাসের (Novel Coronavirus)  স্ট্রেইন (Strain) আলফা, বিটা বা ডেল্টার কোনো সম্পর্ক নেই। একটি ভাইরাস গ্রুপের  (যাদের মধ্যে সমস্ত ধরনের করোনাভাইরাস অন্তর্ভুক্ত) একটি জেনাস (Genus) থেকে আরেকটি জেনাস আলাদা করা হয়, বিস্তর জেনেটিক (Genetic) তফাতের কারণে।

একটি ভাইরাসের (যেমন, নোভেল করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2)  একটি স্ট্রেইন থেকে আরেকটি স্ট্রেনের মধ্যে মূল জেনেটিক গঠন একই থাকলেও, জিনের সামান্য কিছু জায়গায় অদল-বদল বা মিউটেশনের (Mutation) কারণে একই ভাইরাসেরই আলাদা-আলাদা স্ট্রেইনের উদ্ভব ঘটে।

যদিও বাদুড় এবং অন্যান্য প্রাণীদেরকেই মূলত করোনাভাইরাস আক্রমণ করে, তবে এই ভাইরাস কিন্তু নিজের জিনে মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষকেও আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই ঘটনাকে বলে zoonotic spillover। ঠিক যেমন ব্যাট করোনাভাইরাস মিউটেট হয়ে মানুষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে।

যেহেতু করোনাভাইরাসের শরীরে আরএনএ (RNA) থাকে, এদের মধ্যে মিউটেশনের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে। ডিএনএ ভাইরাসের (DNA Virus) ক্ষেত্রে কিন্তু মিউটেশনের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম।

আরও পড়ুন-হেস্টিংসের দুর্নীতি ফাঁসের মাশুল, হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার

কী এই নিওকোভ? কতটাই বা মিল আছে অন্য করোনাভাইরাসের সাথে?

নিওকোভ হল ব্যাট করোনাভাইরাস (Bat Coronavirus), অর্থাৎ যারা বাদুড়কে আক্রমণ করে। নিওকোভের সন্ধান পাওয়া যায় ২০১১-তে। এদের পাওয়া গেছিলো নিওরোমিসিয়া (Neoromicia) জাতের বাদুড়ের শরীরে। আর এই নিওরোমিসিয়া থেকেই নিওকোভ নামটি এসেছে।

তবে নিওকোভের জিনের গঠনের সাথে  ৮৫ শতাংশ মিল আছে মার্স-কোভ করোনাভাইরাসের (MARS-CoV), যা কি-না মানুষকে আক্রমণ করে এবং অসুস্থতার ভয়াবহতাও বেশি হয়। মার্স-কোভের মত সার্স-কোভ (SARS-CoV), OC43, HKU1, 229E, NL63-ও কিন্তু মানুষকে আক্রমণ করে।

তাহলে কি নিওকোভ মানুষকে আক্রমণ করতে পারে?

যতদূর দেখা গেছে এখনও নিওকোভ মানুষকে এখনও আক্রমণ করতে পারে না, শুধু বাদুড়কেই আক্রমণ করতে পারে। আর যেহেতু মানুষকে এখনও পর্যন্ত নিওকোভ আক্রমণ করতে পারেনি, এর ফলে কোনো মানুষের মৃত্যুও ঘটেনি।

বিজ্ঞানীদের নিওকোভ নিয়ে নতুন গবেষণা থেকে আমরা কী জানতে পারছি? এই গবেষণার গুরুত্ব কী?

গবেষণার মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আগে, আমাদের জানা প্রয়োজন নোভেল করোনাভাইরাস সহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের করোনাভাইরাস কী ভাবে আমাদের শরীরে ঢোকে। করোনাভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে রিসেপটরের (receptor) সাহায্যে, যেগুলি আবার শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোশের বাইরে থাকে। রিসেপ্টরের মূল গঠনের জন্যে দায়ী প্রোটিন (Protein)। এদিকে করোনাভাইরাসের গায়েও থাকে কাঁটার মত দেখতে স্পাইক প্রোটিন (Spike Protein)। বিভিন্ন করোনাভাইরাসে, স্পাইক-প্রোটিনের গঠনের রকমফের দেখা যায়। তারা আবার শরীরে প্রবেশ করার জন্যে বিভিন্ন ধরণের রিসেপ্টর ব্যবহার করে। করোনাভাইরাসের স্পাইকপ্রোটিন আর এদিকে মানুষ বা অন্য প্রাণীর শরীরের রিসেপ্টরের গঠন তালা-চাবির মত খাপে-খাপে মিলে গেলে (Lock and key mechanism), তখনই শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

ব্যাট করোনাভাইরাস নিওকোভ, বাদুড়ের শরীরে প্রবেশ করার জন্যে ব্যবহার করে ব্যাট ACE2 রিসেপ্টর। কিন্তু মানুষের শরীরে প্রবেশ করার জন্যে নোভেল করোনাভাইরাস ব্যবহার করে ACE2 রিসেপ্টর। দু'টি রিসেপ্টরের মধ্যে নামের সাদৃশ্য থাকলেও, মানুষের ACE2 রিসেপ্টর আর বাদুড়ের ACE2 রিসেপ্টরের গঠনের বিস্তর ফারাক। ফলে  ব্যাট করোনাভাইরাস নিওকোভ কোনো মতেই মানুষের ACE2 রিসেপ্টরকে ব্যবহার করতে পারে না। ফলে সেই রিসেপ্টরকে ব্যবহার করে নিওকোভ মানুষের শরীরে ঢুকতেও পারে না।

নতুন এই গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, নিওকোভ বা অন্যান্য ধরণের করোনাভাইরাস, যারা এখনও কেবল প্রাণীদেরকেই আক্রমণ করতে পারে এখনও, তারা কিন্তু সুযোগ পেলে - অর্থাৎ যখন মানুষের সংস্পর্শে আসে, মিউটেশনের মাধ্যমে বদলে গিয়ে মানুষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

আদতে অরণ্য ধ্বংস এবং নগরায়ণ বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা বন্যপ্রাণীর বাস্তুকে আক্রমণ করছি। আমরা তাদের  সংস্পর্শে আসছি অনেক বেশি। গবেষকদের মতে ঘটনা খুবই বিরল, কিন্তু আমরা ক্রমশ প্রাণীদের (নিওকোভের ক্ষেত্রে বাদুড়)  সংস্পর্শে যত বেশি আসব, সেই ঘটনা ঘটার পথ প্রস্বস্ত করে দেবো আরও। ভবিষ্যতে নিওকোভ থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণ রুখতে নিওকোভের বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তাদের জিনে কোনো পরিবর্তন আসছে কি-না দেখতে হবে নিয়মিত। সমস্ত ধরনের করোনাভাইরাস যারা মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদেরকে আক্রমণ করে, তাদের সবারই জেনেটিক গঠন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাহলেই জানা যাবে তাদের চারিত্রিক পরিবর্তন এবং মানুষকে আক্রমণ করার প্রবণতা।  এবং সর্বোপরি মানুষের সাথে বাদুড়ের সংস্পর্শে আসার ঘটনা যথাসম্ভব কমাতে হবে।

তাহলেই হয়তো নোভেল করোনাভাইরাস থেকে পরবর্তী একটা মহামারীর ঘটার সম্ভাবনা আমরা কমাতে পারব।

More Articles