চোলাই নয়, সরকারি লাইসেন্সের বাংলা মদই মৃত্যু পরোয়ানা! দায় কার?

মদ বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ফীত হয়েছে রাজ-কোষাগার। পাশাপাশি ঢালাও মদ বিক্রির লাইসেন্সের পরিণতি যে কী মারাত্মক হতে পারে, তা ভালোই দেখেছে রাজ্য।

বর্ধমানে বিষমদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনার রেশ এখন কাটেনি। এরই মধ্যে তোলপাড় ফেলল হাওড়া। এখানেও বিষ মদের বলি কয়েকজন। সংখ্যাটা যাই হোক, প্রশ্ন হলো, এতগুলো মানুষের জীবনের দাম কীভাবে দেবে সরকার? মন্ত্রী তো পুলিশের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। তাতেই কি আদৌ হাত ধুয়ে ফেলা যায়? সরকার মদ বিক্রির লাইসেন্স দিচ্ছে পুরোদমে। যতদূর জানা যাচ্ছে, মৃতরা চোলাই খাননি, খেয়েছেন দেশি মদ। এই মদ তো সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তাহলে এতগুলো মৃত্যুর দায় কার? তদন্ত নিছক দায় এড়ানো নয় তো? তদন্ত প্রহসনে পরিণত হবে না তো? এই নজির যে বিরল, তা বলা যায় না। আপাতত এই ঘটনা নিয়ে উত্তাল রাজ্য, তাই কি আবগারি দফতরকে আসরে নামিয়ে তদন্তের প্রয়োজন ছিল?

কী হয়েছে হাওড়ায়
১৯ জুলাই সন্ধ্যায় হাওড়ায় অনেকে মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর ২০ জুলাই থেকে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা। বেশ কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাওড়া ও কলকাতার একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁদের। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় এই প্রসঙ্গে বলেন, পুলিশ অন্যায় করলে ছাড় পাবে না।

হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ার ঘটনা। মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে এখানকার অনেকে চিকিৎসাধীন। মৃতরা প্রত্যেকেই মালিপাঁচঘড়ার গজানন বস্তির বাসিন্দা। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ এবং রাজ্য আবগারি দফতর জানতে পেরেছে, বাংলা মদ খেয়েই স্থানীয় বেশ কয়েকজনের শরীরে বিষক্রিয়া হয়। মদের নমুনা সংগ্রহ করে তদন্ত শুরু করেছে আবগারি দফতর। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে দেহগুলি ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তর পকেটে টান, বাজারের কোথায় কতটা কোপ বসাচ্ছে জিএসটি?

জানা গেছে, হাওড়ার গজানন বস্তির বেশ কিছু বাসিন্দা প্রতাপ কর্মকার বলে স্থানীয় এক ব্যক্তির ঠেক থেকে মদ কিনে খেতেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বারবার অভিযোগ জানালেও এই বেআইনি ঠেকের বিরুদ্ধে কোনও ব‍্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। ২ দিন ধরে মদ খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটছিল। ২০ জুলাই সকাল থেকে পরিস্থিতি খারাপ হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ থাকলেও তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী অরূপ রায়।

আসরে আবগারি দফতর
এই ঘটনার পর তৎপর হয়েছে রাজ্য আবগারি দফতর। যে ব্যাচের মদ্যপান করে এই ঘটনা বলে অভিযোগ, সেই ব্যাচের সমস্ত উৎপাদিত বাংলা মদ আপাতত বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। যে দোকান থেকে এই মদ কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই দোকানের পাশাপাশি এলাকার আরও কয়েকটি দোকানের বাংলা মদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, কতগুলি মানুষের জীবনের বিনিময়ে আবগারি দফতরের এই তৎপরতা? মদ বিক্রি থেকে আদায় হওয়া শুল্ক সরকারকে লাভের মুখ দেখিয়েছে। তাই কি এই তৎপরতা? যে মানুষগুলো বিষমদের বলি হলেন, তাঁদের জীবনের দাম এতে মিলবে?

রাজ্যের আবগারি আয়
মদ বিক্রির নীতি পরিবর্তন করে রাজ্যে রেকর্ড আয়। আবগারি শুল্কবাবদ রাজ্য কোষাগারে ঢুকেছে ২৩,০০০ কোটি টাকা। রাজ্য সরকার সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের জুন মাস থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকার আবগারি শুল্ক আদায় হয়েছে। যেখানে ২০১৯-'২০ অর্থবর্ষে আদায় হয়েছিল ১১,২৩৬ কোটি টাকা। আবগারি দফতর সূত্রের খবর, মোট বিক্রির মাত্র ৩৫ শতাংশ হল দেশি মদ।

নতুন আবগারি নীতি চালু করে রাজ্য। চোরাকারবার রুখতে এটা করা হয়েছিল। এর ফল এসেছে হাতেনাতে। কমানো হয়েছিল বিলিতি মদের দাম। আর তাতেই এই রেকর্ড আয়!

সর্বকালীন রেকর্ড, গড়ে গত ১৮ মাসে মদ বিক্রির আবগারি শুল্কবাবদ রাজ্য কোষাগারে আসে ২৩ হাজার কোটি টাকা। যা একেবারেই নজিরবিহীন বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। নতুন আবগারি নীতি ও পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমতা বজায় রেখে মদের দাম নতুন করে ঠিক করতেই বেড়েছে আবগারি শুল্ক। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মদের দাম কমেছিল প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমদানি করা মদের দাম, দিল্লির থেকে কম এই রাজ্যে। এতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে মদ চোরাচালানের মাত্রা কমে গেছে কয়েক গুণ। সরকারি কোষাগারে সাফল্যের সঙ্গে ঢুকছে মদ বিক্রির টাকা।

ঢালাও লাইসেন্স
মদ বিক্রিতে রেকর্ড আয় রাজ্যের। তাই মদ বিক্রিতে দেওয়া হয়েছে ঢালাও লাইসেন্স। আর এটাই এখন গ্রামে গ্রামে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও বাড়ির মহিলারা পথে নেমেছেন।

সরকার দিচ্ছে ঢালাও মদের লাইসেন্স। সেক্ষেত্রে বাড়ছে মদের দোকান। আর সেই মদের দোকান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মদ্যপের সংখ্যা। সেই কারণ কোথাও কোথাও পথে নামেন গ্রামবাসীরা। কিছুদিন আগে খবরের শিরোনামে এসেছিল কাঁথির রসুলপুর। সেখানেই রাস্তা অবরোধ করেন এলাকার মহিলারা। তাঁদের অভিযোগ, সরকার মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়েছে। যে কারণে বেড়েছে মদ্যপ-দের উপদ্রব।

এর আগে মালদাতেও একই ধরনের ঘটনা সামনে আসে। মদের দোকানে লম্বা লাইন। দিনের পর দিন এভাবে কষ্টার্জিত অর্থ শুধুমাত্র নেশায় ব্যয় হচ্ছে দেখে সেখানেও হাতে লাঠি তুলে নেন মহিলারা। সরকারি লাইসেন্স প্রাপ্ত মদের দোকান নিজেরাই ভাঙতে শুরু করেন।

বলা বাহুল্য, মদ বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ফীত হয়েছে রাজ-কোষাগার। পাশাপাশি, ঢালাও মদ বিক্রির লাইসেন্সের পরিণতি যে কী মারাত্মক হতে পারে, তা ভালোই দেখেছে রাজ্য। এরপর যাতে রাজ্যে মদ বিক্রি মুখ থুবড়ে না পড়ে, তাই কি তড়িঘড়ি হাওড়ায় আসরে আবগারি দফতর?

More Articles