মধ্যবিত্তর পকেটে টান, বাজারের কোথায় কতটা কোপ বসাচ্ছে জিএসটি?

এখনও পর্যন্ত এই জিএসটি তালিকায় সবথেকে বেশি কর বৃদ্ধি হওয়া যে জিনিসটি রয়েছে, সেটি হলো চেক বই এবং তার খুচরা পাতা। এতদিন পর্যন্ত এই জিনিসটি কর ছাড়ের আওতায় আসত।

খুচরোর বদলে যদি আপনি চাল, ডাল কিংবা মুড়ির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্যাকেট কিনতে অভ্যস্ত হন, তাহলে সংসার খরচ বাড়তে চলেছে আপনার। কারণ আজ থেকেই প্যাকেটবন্দি এবং লেবেল আটকানো সমস্ত খাদ্যসামগ্রীর ওপরে বসতে চলেছে অতিরিক্ত পণ্য পরিষেবা কর বা জিএসটি। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত জিনিসের ওপরে কর ছাড় ছিল, সেগুলির ওপরেও এবারে বসতে চলেছে করের বোঝা। চড়া করের আওতায় প্রবেশ করতে চলেছে হোটেলের হাজার টাকার কম দামের ঘর, এবং ব্যাঙ্কের চেক বই। সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, এমনিতেই যেখানে গৃহস্থ খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানি-সহ সবকিছুর বর্ধিত দামে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ, সেই অবস্থায় জিএসটি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই তালিকার বাইরে নেই সরকারি দফতরগুলিও। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাস্তা, সেতু, রেলপথ, মেট্রো, বর্জ্য সংশোধনাগার এবং শ্মশানের কাজের চুক্তিতে এবারে ১৮ শতাংশ জিএসটি গ্রহণ করা হবে।

তাছাড়াও, এমন বহু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে, যেখানে আজ থেকে জিএসটির সংশোধিত হার চালু হতে চলেছে। ফলে বাড়তে চলেছে কর। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, পড়াশোনার জন্য অত্যন্ত জরুরি কিছু জিনিস। এর মধ্যে রয়েছে লেখার কালি, আকার এবং ছাপার কালি, পেনসিল শার্পনার, ছুরি, ব্লেড থেকে শুরু করে আরও অনেক জিনিস। এছাড়াও এলইডি আলো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎচালিত পাম্প, সবকিছুই হতে চলেছে মহার্ঘ। সোলার ওয়াটার হিটারের দাম বাড়বে, গত মাসে জিএসটি পরিষদের বৈঠকে কর ছাড়ের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সেই তালিকা থেকে স্পষ্ট হয়েছিল, আর কিছুদিনের মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু জিনিসের ওপর বসতে চলেছে অতিরিক্ত কর। তবে বেশ কিছু পণ্যে জিএসটি-র হার কমিয়ে দেওয়ারও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, হাতে গোনা এবং খুব কম সংখ্যক মানুষের প্রয়োজনে লাগে সেই জিনিস।

প্যাকেজ পণ্যের ওপর ধার্য হচ্ছে ১৮ শতাংশ জিএসটি
আজ থেকে প্যাকেজ করা এবং ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টের ওপর ১৮ শতাংশ করে জিএসটি ধার্য করা হবে। এতদিন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাংশ ছিল জিএসটি। যদি গ্রীষ্মের তীব্র গরমে গলা ভেজানোর জন্য আপনারা ডাবের জল কিনতে চান, তাহলে তার ওপরেও বসানো হবে ১২ শতাংশ জিএসটি। এছাড়াও জুতোর কাঁচামালের ওপর থাকছে ১২ শতাংশ নতুন জিএসটি রেট।

আরও পড়ুন: জিএসটি-র কোপে চড়ছে দাম, কতটা ক্ষতির সম্মুখীন সাধারণ মানুষ?

চাপ বাড়বে হেঁশেলে
মাছ, দই, পনির, শুকনো মাখন, শুকনো সোয়াবিন, মটর, গম, এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য, মুড়ি, মধু, গুড়, আটা, চাল, এবং প্যাকেটবন্দি অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ওপর এবার থেকে প্রযুক্ত হবে ৫ শতাংশ জিএসটি। কিছু জিনিসকে ছাড় দেওয়া হলেও তার সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এতদিন পর্যন্ত এই সমস্ত জিনিসগুলি জিএসটি-র আওতাভুক্ত ছিল না। তবে এবার যেহেতু এই সমস্ত জিনিসের ওপর জিএসটি বসছে, সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, এবার থেকে আরও মহার্ঘ হতে চলেছে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী।

বাড়তে চলেছে চাষের খরচ
সাবমার্সিবল পাম্প, টারবাইন পাম্প, সাইকেলের পাম্পের ওপরে এবারে লাগু হবে ১৮ শতাংশ করে জিএসটি। এছাড়াও বীজ পরিষ্কার এবং বাছাই করার মেশিনের ওপর জিএসটি বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। সোলার পাওয়ারের ওপর জিএসটি পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে, ফলে এবার তার দাম বাড়বে। শ্রেণিবিন্যাসের যন্ত্র, বায়ুচালিত আটার চাকি, ডিজিটাল বর্জ্য, আলকাতরা- সমস্ত জিনিসের ওপর বাড়তে চলেছে দাম।

সঙ্গে ডিম, ফল এবং অন্যান্য কৃষিজ পণ্য বাছাই এবং শ্রেণিবিন্যাস করার বিশেষ যন্ত্রের ওপরে জিএসটি বাড়িয়ে ১২ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও টেট্রা প্যাক, বিদ্যুৎচালিত যে কোনও ছোটখাটো জলের পাম্পের ওপরে এবার থেকে চালু হচ্ছে ১৮ শতাংশ করে জিএসটি।

ব্যয়বহুল হতে চলেছে স্বাস্থ্য পরিষেবা
সোমবার থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ বাড়তে চলেছে একটা বড় অঙ্কে। ৫০০০ টাকার ওপর হাসপাতালের কেবিনে ৫ শতাংশ জিএসটি ধার্য করা হয়েছে। এই দাম যদিও আইসিইউ ছাড়া অন্যান্য কেবিনের ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে। এছাড়াও বায়োমেডিক‍্যাল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ সুবিধার ওপর ১২ শতাংশ জিএসটি ধার্য করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে এই জিএসটি প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। তবে সরকারের মত, সাধারণ মানুষ হাসপাতালে এসে এই ৫ হাজার টাকার বেডে ভর্তি হন না, তাই এই করের বোঝা সাধারন মানুষের ওপরে পড়বে না।

দামি হচ্ছে শিক্ষাও
এবার থেকে দামি হতে চলেছে কচিকাঁচাদের শিক্ষাও। বাচ্চাদের লেখাপড়ায় ব্যবহার হয় যে সমস্ত জিনিস, সেসবের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড্রইংয়ের কালি, পেনসিল শার্পনার, মার্কিং করার পণ্য, কাগজ কাটার ছুরি- সবকিছুর ওপর জিএসটি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এতদিন পর্যন্ত এই সমস্ত জিনিসে ১২ শতাংশ করে পণ্য পরিষেবা কর নেওয়া হতো। তবে এবারে দিতে হবে ১৮ শতাংশ করে জিএসটি। এছাড়াও অ্যাটলাস এবং অন্যান্য মানচিত্র এবং চার্টের ওপর ১২ শতাংশ করে জিএসটি ধার্য হবে। সমস্ত ধরনের গ্লোব, টোপোগ্রাফিক্যাল প্ল্যানের ওপর ধার্য হবে বারো শতাংশ করে জিএসটি। বাচ্চাদের স্কুল যাওয়ার জুতোর দাম বাড়বে। চামড়া এবং অন্যান্য জুতো তৈরির সামগ্রীর ওপরে জিএসটি বাড়ানো হবে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত।

হোটেলের ঘরের ওপরে কত ট্যাক্স ধার্য হবে?
প্রতিদিন হাজার টাকার কম খরচে হোটেলের রুমের উপরে ১২ শতাংশ করে কর ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এটি জিএসটি ছাড়ের আওতায় আসে।

সবথেকে বেশি দাম বাড়ছে কীসে?
এখনও পর্যন্ত এই জিএসটি তালিকায় সবথেকে বেশি কর বৃদ্ধি হওয়া যে জিনিসটি রয়েছে, সেটি হলো চেক বই এবং তার খুচরা পাতা। এতদিন পর্যন্ত এই জিনিসটি কর ছাড়ের আওতায় আসত। কিন্তু এবার এই জিনিসটির জন্য আপনাকে ১৮ শতাংশ কর দিতে হবে।

New GST Rates

গ্রাফিক্স: জয়দীপ চৌধুরী

কর কমছে কোন কোন জায়গায়?
প্রতিরক্ষার জোগান ও বেসরকারি ক্ষেত্রে আমদানি করা সামগ্রী, ফাইলেরিয়া নির্মূল করার ট্যাবলেট ডিইসি, কৃত্রিম অঙ্গ এবং দেহে বসানোর যন্ত্রাংশ, হাড়ের চিকিৎসার কিছু যন্ত্রাংশ, শল্যচিকিৎসার কিছু সামগ্রী, কিছু অর্থোপেডিক প্লেট, রোপওয়েতে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহণের খরচ, এবং ট্রাক ও অন্যান্য পণ্যবাহী যানের ক্ষেত্রে জিএসটি কমানো হয়েছে অনেকটাই।

অর্থনীতিবিদদের কী মত
পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদরা এই জিএসটি সংশোধন নিয়ে খুব একটা খুশি নন। তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বারবার দাবি করা হয়, তারা নাকি আয়কর গ্রহণের পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু যদি আয়কর গ্রহণের পরিমাণ এতটা বৃদ্ধি পায়, তাহলে এইরকমভাবে জিএসটি বাড়ানো সম্পূর্ণ রূপে অযৌক্তিক। আসলে এখনও অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা কিন্তু আয়কর দেন না। তাই অগত্যা সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা না ভেবে কর্পোরেট কর কমিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর জিএসটির চাপ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।

ভবিষ্যৎ কী?
এইরকমভাবে জিএসটি বৃদ্ধির ফলে সমস্যায় পড়েছে ভারতের সাধারণ মানুষ। তেলে শুল্ক কমানো, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার মধ্যে প্রকল্পে ভরতুকি বৃদ্ধি করা, সারে ভরতুকির সিদ্ধান্তর হাত ধরে চলতি অর্থবর্ষে অনেকটাই কম হতে চলেছে রাজস্ব আদায়। সরকারের অন্দরমহল থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে আরও কড়া হাতে ভর্তুকি পরিচালনা করা এবং ক্ষেত্র বুঝে তা বন্টন করা জরুরি বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় সরকার।

একই রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের ভরতুকি কোথাও শূন্য, আবার কোথাও নামমাত্র। এই অবস্থায় যদি এই ভরতুকি পুরোপুরি উঠে যায়, তাহলে আরও সমস্যায় পড়বে সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যেই মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে মে মাসের শেষে পেট্রোল এবং ডিজেলের যথাক্রমে ৮ টাকা এবং ৬ টাকা করে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার। এর ফলে কেন্দ্রের ঘরে এক লক্ষ কোটি টাকা কম আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এপ্রিল মাসে ফসফেট এবং পটাশিয়ামযুক্ত সারে ৬০,৯৩৯.২৩ কোটি টাকা ভরতুকির কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়াও সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে অন্ন যোজনার অধীনে বিনামূল্যের রেশন বিতরণের ক্ষেত্রে।

সরকার সূত্রে খবর, যেভাবে তেল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার, তার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে রীতিমতো হারতে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফলে এই ভরতুকি ব্যবস্থা আরও আঁটোসাঁটো করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে ভারতের জন্য। সেক্ষেত্রে কোথায় বন্টন হবে, সেসব বুঝেশুনে তবেই বাছাই করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই শুল্ক বন্টন নীতি দেখে অনেকেই মনে করছেন, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরও বৃদ্ধি পেতে পারে শুল্কজাত পণ্যের দাম। রান্নার গ্যাস হয়তো হবে আরও মহার্ঘ। তার পাশাপাশি হয়তো খুব শীঘ্রই তেলের ওপরেও ভরতুকি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় সরকার।

More Articles