ঘটতে চলেছে আরেকটি চেরনোবিল? গোটা বিশ্বই প্রমাদ গুণছে রাশিয়াকে দেখে

পরিস্থিতি ক্রমে ঘোরালো হয়ে চলেছে রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধের। পারমাণবিক অস্ত্র এতদিন ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। বিশেষত, গত শতাব্দীর ভয়াবহতা এখনও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি মানবসমাজ। গত শতাব্দীর শেষভাগে হয়ে গিয়েছে চেরনোবিল কাণ্ডও। ফলত পরমাণু শক্তি নিয়ে বিজ্ঞান যাই বলুক, মানুষ বরাবরই একটু শঙ্কিত থাকে। এইবার হাওয়া ঘুরল সেই সংক্রান্ত অন্য একটি সম্ভাব্য বিপদের দিকে। পরমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার রাশিয়া যুদ্ধে করবে কিনা তার থেকেও বড় আলোচনার বিষয় এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যে প্ল্যান্টগুলি রয়েছে ইউক্রেনে সেগুলি কী ভাবে ব্যবহার করবে রাশিয়া। যদি অসতর্ক ভাবে গোলাগুলিতে একটি প্ল্যান্টও ধ্বংস হয়ে যায়, তার প্রভাব হবে চেরনোবিল কাণ্ডের থেকেও মারাত্মক। ইউরোপের দেশগুলি ব্যপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও নিজেদের বয়ান অনুযায়ী কোনও ইউক্রেনিয়ান নাগরিকের ক্ষতি করতে চায় না রাশিয়া, এই আক্রমণের মাধ্যমে তারা চায় শুধুমাত্র ইউক্রেনের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে, কিন্তু ইতিমধ্যে হতাহতের সংখ্যা যে রকমটা দাবি করা হচ্ছে তা সত্যি হলে এই দাবি প্রহসন মাত্র।

ইতিমধ্যেই কিয়েভের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল রাশিয়ান সেনা। আজ একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে সমস্ত শহর। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে কিয়েভের ১০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত চেরনোবিল প্ল্যান্টটি দখল করে ফেলেছে রাশিয়া। দখল করেছে ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকারী প্ল্যান্ট য্যাপোরিঝঝিয়া। আর এই প্ল্যান্টটি দখলের সময়েই ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটে যায় এমন একটি ঘটনা যা বদলে দিয়েছে ইউরোপিয়ান দেশগুলির আপাত নিষ্ক্রিয় অবস্থান। কিছুদিন আগেই একটি ভিডিওতে দেখা যায় বিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ইউক্রেনের একটি গাড়ি পার্কিং। ভিডিওটি রয়টার্স যাচাই করে সত্যি বলেই ঘোষণা করে। শুক্রবার সকালের হামলায় তেমনই আগুন জ্বলতে দেখা যায় য্যাপোরিঝঝিয়া প্ল্যান্টে। এই প্ল্যান্টের আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে সেল বর্ষণ করেছে রাশিয়ান সেনারা বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় ইউরোপের দেশগুলি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক যুদ্ধের থেকেও বেশি বিপজ্জনক এখন পারমাণবিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। যদিও আমেরিকার শক্তিসচিব জেনিফার গ্রানোল্ম জানিয়েছেন, রেডিয়েশন লিকের কোনও প্রমাণ মেলেনি এপর্যন্ত। য্যাপোরিঝঝিয়া প্ল্যান্ট সমগ্র ইউক্রেনে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ একাই সরবরাহ করে থাকে। কাজেই এই প্ল্যান্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউক্রেনও। ইউক্রেনের এক আধিকারিক অবশ্য জানিয়েছেন আগুন বুজিয়ে ফেলা গেছে। এই অঞ্চলে আর যুদ্ধ হয়নি। প্ল্যান্টের কাজ চলছে নির্বিঘ্নে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পারমাণবিক ওয়াচডগের প্রধান গ্রসি স্থানটি নিরীক্ষায় গিয়েছিলেন আজই। তাঁরও বক্তব্য প্রায় একই। দুটি রিয়্যাক্টর মেরামতের কাজ চলছে। দুটি নিরাপদ ভাবে বন্ধ করা হয়েছে। এবং বাকি দুটি লো পাওয়ার মোডে চালানো হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে তাঁর বয়ানেই। কাজেই যে পরিমাণ ভুয়ো তথ্য সরবারহ করা হচ্ছে, তাতে দ্বিধার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। য্যাপোরিঝঝিয়া দখল করেছে রাশিয়া ঠিকই, কিন্তু প্রচুর পরিমাণ গোলাবর্ষণ এ অঞ্চলে হয়েছিল কিনা, তা বিচার সাপেক্ষ।

এদিকে এই সময়েই রাশিয়ান ট্যাঙ্কগুলি এই অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেন জেলেন্সকি। একটি ভিডিও মেসেজে সমস্ত ইউরোপিয়ানদের কাছে চোখ খুলে তাকানোর আবেদন রেখে জেলেন্সকি তাদের দেশনেতাদের কাছে এই হামলার বিচার চাইতে বলেন। কিন্তু এই অভিযোগের সমর্থনে তেমন কোনও প্রমাণ এ অবধি পাওয়া যায়নি। আগুন জ্বলার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু তা ট্যাঙ্ক আক্রমণের ফলেই—তেমন কোনও প্রমাণ নেই এপর্যন্ত। বলা হচ্ছে যুদ্ধে মারা গিয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। সাতদিনে ঘর ছেড়েছেন প্রায় লাখ দশেক। এর আগে চেরনোবিল কাণ্ডের সময় প্রায় শ-তিনেক মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে রেডিয়েশনের আওতায় এসে তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। বসবাসের জায়গা ছেড়ে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন ২ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ। সেই রেডিয়েশনের বিষময় ফল ভোগ করেছিলেন বেলরুশ, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার আমজনতাও। দীর্ঘদিন ধরে নানান ধরনের রোগের শিকার হয়ে আসছেন তারা। প্রায় টানা ১০ দিন বাতাসে মিশে গিয়েছিল সেই বিষ। আর এই প্ল্যান্টটি চেরনোবিলের থেকে অনেকটাই বড়। কোনও রকমে এটি ধ্বংস হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্তর্গত এবং ইউরোপের অনেকগুলি দেশ, ব্যাপকভাবে। প্রভাব পড়বে বিশ্ব-পরিবেশেও।

য্যাপোরিঝঝিয়া প্ল্যান্ট দখলের পরপরই ঘটে চলেছে বহু ঘটনা। আতঙ্কিত ইউরোপের বহুদেশ নিজেদের অবস্থান বদলেছে দ্রুত। প্রতিবাদে শামিল হয়েছে দূরবর্তী দেশগুলিও। তবে ভারত এখনও নীরব। স্টক মার্কেট পড়তে শুরু করেছে। ন্যাটোপ্রধান জেন্স স্টল্টেনবার্গ নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট আক্রমণের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে রাশিয়াকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আখ্যা দিয়েছেন। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন তিনি। একই অভিযোগে শঙ্কিত হয়ে ফ্রান্স তাদের এ এস এন নিউক্লিয়ার ওয়াচডগ বডির ক্রাইসিস সেলের কাজ শুরু করেছে। অন্তত ফরাসী শক্তি সচিব বারবারা পম্পিলির বয়ানে এমনটাই জানা গিয়েছে। রাশিয়ান ফান্ডের ৩ কোটি ৩০ লক্ষ আমেরিকান ডলার আটকে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যদিও সমস্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলিকেই রাশিয়ার ওপর এই ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য আবেদন করেছেন জেলেন্সকি। যেন সেই ডাকে সাড়া দিয়েই দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ব্রিক্স ব্লক রাশিয়ার যাবতীয় আদান প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। 

এ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্তের নির্দেশ জারি করেছে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার রক্ষা কাউন্সিল। পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র আক্রমন যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন বলে মনে করছে তারা। ৪৭টি আসনের মধ্যে ৩২টি ভোট এই আক্রমণের তদন্তের পক্ষে রায় দিয়েছে। জেনিভার কাউন্সিলও মনে করছেন এই আক্রমণ ইউক্রেনের মানবাধিকারের ওপর ঘৃণ্য আক্রমণ। ইউক্রেনের আমেরিকান দূতাবাসও এই আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ বলেই মনে করছে। আন্তর্জাতিক বিচারালয় ইতিমধ্যে এই যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেছে। এই ভোটের ফলাফলের পরেই কিয়েভের দূত বলেন, “সমস্ত দুনিয়া পুতিনের বিপক্ষে, এই বার্তা পুতিনের কানে তোলা দরকার।” ইতিমধ্যে ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা রাশিয়ান সেনাদের ওপর ধর্ষনের অভিযোগ এনেছেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী ইউক্রেনের শহরগুলিতে ইউক্রেনিয়ান মহিলাদের উপর অত্যাচার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। 

একদিকে অভিযোগ অপরদিকে রাশিয়ার ক্রমে ইউক্রেন দখল করে এগিয়ে আসা–এই দুইকে কেন্দ্র করে খানিকটা হলেও জোট বাঁধছে বিপক্ষ। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আজ জানিয়েছে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের চুক্তিকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করতে প্রস্তুত তারা। ইউক্রেনের মাটিতে সরাসরই সেনা তারা নামাবেন না। কিন্তু রাশিয়ার মনে রাখা উচিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সূচাগ্র ক্ষতিও বরদাস্ত হবে না। এদিকে আজ সারাদিন একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে কিয়েভে। রাশিয়ার উপর আনা অভিযোগ, অর্থনৈতিক আঘাত রাশিয়ার আক্রমণে তেমন কোনও প্রভাব ফেলছে বলে এখনও মনে করা হচ্ছে না। তবে তদন্ত কোনদিকে এগোবে, বিচারে রায়ই বা কী হবে, রাশিয়া সেই রায় কেমনভাবে গ্রহণ করে–আগামীর যুদ্ধ পরিস্থিতি এইসব উত্তরগুলির উপরই নির্ভর করবে।

More Articles