ঘুমন্ত মানুষগুলোকে কারা মারল! আইনের শাসন কোথায় পশ্চিমবঙ্গে?

প্রশ্নাতীতভাবে তৃণমূল জমানার অন্যতম নৃশংস রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটে গেল। ঘুমের মধ্যে পুড়িয়ে মারা হল রামপুরহাটের একই পরিবারের ১২ জন বাসিন্দাকে। গোটা রাজ্যে তীব্র উত্তাপ ছড়িয়েছে ঘটনায়। অভিযোগ স্থানীয় তৃণমূল নেতা ভাদু শেখের মৃত্যুর একঘণ্টার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কারা জড়িত এই ঘটনায়? ঘুমের মধ্যে মানুষগুলোকে কে মারল?

ঠিক কী ঘটেছিল

ঘটনার সূত্রপাত সোমবার রাত ১০ টা নাগাদ। রামপুরহাট এলাকার বকতুই গ্রামে বোমা হামলায় তৃণমূল নেতা ভাদু শেখের মৃত্যু হয়। ভাদু শেখ রামপুরহাট এক নম্বর ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ছিলেন। তাঁর বাড়ি রামপুরহাট থানা এলাকার বগতুই গ্রামে। সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন ভাদু শেখ। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় তৃণমূল নেতা লালন শেখ এবং আনারুল হোসেনের বক্তব্য অনুযায়ী, দুটি মোটর বাইকে করে ৪ জন দুষ্কৃতী এসে সেই সময় তাঁকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে পালায়। ঘটনার পর স্থানীয় মানুষজনের সহায়তায় রক্তাক্ত অবস্থায় ভাদুকে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা ভাদুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। খুনের পর থেকেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ওই গ্রাম। খুনের সঙ্গে যুক্তদের বাড়িতে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।

এই  ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রায় ১২ জন মানুষের মৃত্যু হয়।এখন ও অবধি ৯ টি অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ সনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২টি শিশু, ৫ জন মহিলা, ও ২ জন বয়স্ক পুরুষ রয়েছেন। যদিও আরোও বেশ কিছু মৃতদেহ লোপাট করার অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা। আবার বীরভুমের পুলিশ সুপার নগেন্দ্র ত্রিপাঠী ঘটনাস্থলে গিয়ে দাবি করছেন এই ঘটনায় সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা যে ঘটতে পারে পুলিশের কাছে আগে থেকেই তার ইঙ্গিত ছিল। তাহলে কেন প্রয়োজনমাফিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা পুলিশ করেনি? আবার আগুন লাগার ঘটনার পর পুলিশ ও দমকল গ্রামে প্রবেশ করতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়? কেন রাতেই  আরও বড় ফোর্স নিয়ে ঢোকা গেল না? গোটা গ্রাম কার ভয়ে সিঁটিয়ে!

পরে বেলা দশটার সময় বীরভূমের পুলিশ সুপার তাঁর বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেন। পুলিশ দমকলের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের গ্রামে প্রবেশ করলে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়। মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রসাশনিক স্তর থেকেই তথ্যের গলদ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস দশটি মৃতদেহ উদ্ধার করার দাবি করলেও গ্রামে পৌঁছে এসপি দাবি করেন ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ ও দমকলের মতানৈক্যের কথা তুলে পুলিশ সুপারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি ফরেনসিক টেস্টের আগে কোনও বিবৃতি দিতে রাজি হননি।

কী বলছে শাসক দল

রাজনৈতিক হিংসা ও গোষ্ঠী দ্বন্ধের কথা স্পষ্ট ভাবেই অস্বীকার করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেসে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেছেন টিভি বাস্ট করে ওই বাড়িগুলোতে আগুন লেগেছে। তিনি সরাসরি পুলিশি তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন। তবে গতকালের খুনের সঙ্গে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সংযোগ থাকার সম্ভবনা সরাসরি উড়িয়ে দেননি তিনি। ফলে পুলিশি তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক আরোও চরমে পৌঁছায়। আবার অনুব্রত মণ্ডলের বক্তব্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যগত মতপার্থক্য তৈরি হয়। অনুব্রত মণ্ডলের টিভি থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় শিলমোহর দেননি মমতা। তাঁর প্রশ্ন, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দশটি বাড়িতে একসাথে কী ভাবে টিভিতে শর্ট সার্কিট থেকে বিস্ফোরণ ঘটে কুণাল ঘোষ আবার তুলে আনছেন, লার্জার কনস্পিরেন্সি বা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? কুণাল ঘোষ আবার তুলে আনছেন, লার্জার কনস্পিরেন্সি বা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। 

কী পদক্ষেপ নিল প্রশাসন

গোটা ঘটনায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ স্বীকার করে রাজ্য সরকারের তরফে এসডিপিও সায়ন আহমেদ, এবং ইন্সপেক্টর ইনচার্জ প্রামাণিককে ক্লোজ করা হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্যের তরফে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি বিধায়কের প্রতিনিধিদলকে গণহত্যা কাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিষয় খতিয়ে দেখতে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম বা সিট গঠন করে পাঠানো হয়েছে সিআইডির বিশেষ তদন্তকারী দলকে।  এখনও পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কী বলছেন বিরোধীরা

বীরভূমের এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে উত্তাল হয়েছে বঙ্গ রাজনীতি। তৃণমূল সরকারের গাফিলতির অভিযোগ তুলে বিধানসভা থেকে ওয়াক আউট করে বিরোধী দল বিজেপি। বিজেপির দুবরাজপুর বিধানসভার বিধায়ক অনুপ সাহা এই ভয়াবহ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পিছনে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্ধকেই দায়ী করেছেন। বাম জোট আইএসএফ এর বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী গোটা ঘটনাকে দুঃখজনক নিন্দাজনক এবং বর্বরোচিত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘গোটা রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। সিট গঠন করে তদন্ত প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক’। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সাংবাদিক বৈঠক করে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন। সেলিমের বক্তব্য, রাজ্য রাজনীতি বিরোধী শূন্য করে দেওয়ার পর এখন তৃণমূল নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। অবৈধ বালি এবং কয়লা খাদানের টাকার বখরা নিয়ে বীরভূমে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সামনে যে পুলিশ প্রশাসন কার্যত নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। 

ফিরছে গণহত্যার স্মৃতি

গোটা ঘটনায় এই মুহূর্তে বকতুলা গ্রাম সহ গোটা রামপুরহাটেই থমথমে পরিস্থিতি। বিশাল পুলিশবাহিনী গ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে। মাত্র আট মাস আগেই রাজনৈতিক রেষারেষিতে খুন হন মৃত ভাদু শেখের মেজ ভাই। তারপরে ও কেন পুলিশ এলাকার আইনশৃঙখলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি সেই প্রশ্ন ও উঠে এসেছে। রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই ভয়াবহ পুড়িয়ে মারার ঘটনা মনে করায় বাম আমলে খোদ কলকাতায় ঘটে যাওয়া আনন্দ মার্গী হত্যাকাণ্ডকে। ১৯৮২ সালের ৩০ শে এপ্রিল প্রায় একই কায়দায় বালিগঞ্জ বিজন সেতুর ওপরে আনন্দ মার্গী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যসিনীদের ট্যাক্সিগুলিকে তিনটি পৃথক জায়গায় বাধা দেওয়া হয়। এরপরেই ট্যাক্সিগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় প্রায় ১৬ জন সন্ন্যাসী ও একজন সন্ন্যাসিনীর মৃত্যু হয়। বেশ হয়েকজন আহত হয়। গোটা ঘটনায় অভিযোগের আঙুল ওঠে তৎকালীন শাসক দল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। ৪০ বছর পরের প্রায় একই রাজনৈতিক নৃশংসতা প্রশ্ন তোলে পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন কোথায়? যে তৃণমূল নেত্রী বিরোধী দলনেত্রী থাকাকালীন বারবার সিপিএম সরকারের রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আজ তাঁর শাসনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক শান্তি বা আইনের শাসন কোথায়? ফিরছে নন্দীগ্রাম নেতাইয়ের স্মৃতি। কোন মুখে উত্তরপ্রদেশকে তুলোধনা করা, যদি এমনটাই হয় প্রকৃত চিত্র!

 

-প্রতিবেদক শুভজিৎ পুতুতুন্দু

More Articles