সাধারণ মেয়ের জেদের কাছে হারতে হল মন্ত্রীর মেয়েকে! প্রতিবাদের নাম ববিতা

পরেশ অধিকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই পরেশ অধিকারী প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে মিলল সুবিচার। ক্ষমতার বিরুদ্ধে জয় পেল যোগ্যতা। কলকাতা হাই কোর্টের ওপর থেকে যখন মানুষের আস্থা এবং ভরসা কার্যত উঠে যাওয়ার জোগাড়, সেই সময় বিচারক হয়ে উঠলেন সমস্ত বিচারপ্রার্থীদের মসিহা। তার সঙ্গে সঙ্গেই বয়কট, ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়াই- সব পেরিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিলেন উত্তরবঙ্গের একজন সাধারণ মেয়ে ববিতা সরকার। সিবিআই তলব পেয়ে চিন্তায় অসুস্থ নেতা-মন্ত্রীরা যখন হাসপাতালে ছোটেন, সেই সময়ে রীতিমতো নিজের মেয়েকে নিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পরেশ অধিকারী। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বেআইনিভাবে নিয়োগের অভিযোগে মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতার চাকরি তো গেলই, তাকে কর্ম জীবনের সমস্ত বেতনের টাকা ফেরানোর নির্দেশ দিল আদালত। জানিয়ে দেওয়া হলো, দুই কিস্তিতে এই টাকা ফেরাতে হবে মন্ত্রীর কন্যাকে। হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে হবে এই টাকা। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসলেন একজন 'সাধারণ মানুষ'।

 

ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে?
২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর এসএসসি পরীক্ষায় বসেছিলেন ববিতা। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়। তবে সেই মেধাতালিকার প্যানেল লিস্টে তার নাম ছিল না। নাম ছিল ওয়েটিং লিস্টে। প্যানেলের পর ওয়েটিং লিস্ট থেকেও চাকরি হয়। তাই বুকে অনেকটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন ববিতা। ভেবেছিলেন তার চাকরি হবে। ওয়েটিং লিস্টের তালিকা প্রকাশের দাবিতে একাধিক পরীক্ষার্থী আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশে কমিশন যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে দেখা যায় ২০ নম্বরে নাম রয়েছে ববিতা সরকারের।

 

কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় তার সমস্ত সমস্যা। যখন প্রথম কাউন্সেলিং হয়, সেই সময় তার নাম ছিল ২০ নম্বরে। কিন্তু দ্বিতীয় কাউন্সেলিং যখনই শুরু হয়, তখনই ববিতা জানতে পারেন, তাঁর নাম ২০ থেকে ২১ নম্বরে নেমে এসেছে। আর সেই জায়গায় এক নম্বরে চলে এসেছে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম। এই অঙ্কিতা অধিকারী হলেন রাজ্যের বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা। বাধ্য হয়ে ববিতা কমিশনের দ্বারস্থ হন। কমিশন জানায়, আরটিআই করার পরে অঙ্কিতার নম্বর বেড়ে গিয়েছে, তবে এর সপক্ষে কোন কাগজ দেখাতে পারেনি তারা। শুরু হয় শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ববিতা সরকারও।

 

আরও পড়ুন: দাপটে অস্থির মন্ত্রী-আমলা, একাই একশো বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

 

এরপর পঞ্চম কাউন্সেলিং হয়ে গেলেও তাঁর কপালে চাকরি জুটল না। তিনি বলছেন, "মেধা তালিকা অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমার চাকরি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই তালিকায় প্রথমেই অঙ্কিতার নাম চলে এল, আর আমার চাকরিটা হলো না। এই কারণেই আমি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।" তিনি আরও বলেন, "অঙ্কিতার ইন্টারভিউ ছাড়া প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬১। সেই জায়গায় আমার ইন্টারভিউ-সমেত প্রাপ্ত নম্বর ৭৭। যদিও অঙ্কিতা ইন্টারভিউ-র ১০ নম্বর পুরোটাই পায়, তাহলেও কিন্তু তার থেকে আমার নম্বর বেশি। তাহলে কী করে মেধাতালিকার প্রথমে তার নাম থাকে?"

 

মন্ত্রীর কন্যার থেকে ১৬ নম্বর বেশি পেয়েছিলেন ববিতা। তবুও ববিতার নাম ছিল তালিকার ২১ নম্বরে। মেধা তালিকার কার্ড নিয়ে ধরনা মঞ্চ থেকে শুরু করে এসএসসি কর্তৃপক্ষ, সব জায়গায় দৌড়ে বেড়িয়েছেন তিনি। এমনকী, তথ্য জানার অধিকার আইনে প্রশ্ন করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে সংসার এবং দুই সন্তান সামলে নিজের লড়াই চালিয়েছিলেন তিনি। লড়াই যে কঠিন হবে, সেই বিষয়টা তখনই হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন, কারণ উল্টোদিকে যে প্রভাবশালী মন্ত্রী! কিন্তু তবুও কখনও হাল ছাড়েননি। পরেশ অধিকারীর মতো একজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধেও লড়াই করে গিয়েছেন ববিতা।

 

এসএসসি মামলায় পরেশ অধিকারী

কম নম্বর পেয়েও মন্ত্রীর মেয়ের চাকরিতে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, শুধু কম নম্বর পাওয়াই নয়, কোনওরকম পার্সোনালিটি টেস্ট ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রী-কন্যা অঙ্কিতা। আর এই মন্ত্রী হলেন এককালীন ফরওয়ার্ড ব্লকের দাপুটে নেতা এবং বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী। যাঁকে সরিয়ে মন্ত্রী-কন্যা চাকরি পেয়েছেন, সেই ববিতা সরকারের দায়ের করা মামলায় এই মুহূর্তে বেকায়দায় পড়েছেন শিক্ষা-প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী। এসএসসি মামলায় সিবিআই-এর কাছে হাজিরা দেওয়ার পরেও আরও একবার তলব পেয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার সিবিআই-এর তরফ থেকে পরেশ অধিকারীকে একপ্রস্থ জেরা করা হয়। সিবিআই-এর তরফ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার তাঁর জেরা অসম্পূর্ণ ছিল। এমএলএ হোস্টেল থেকে নিজাম প্যালেসে গিয়ে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন তিনি। আদালত অবমাননার মামলাও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে। এরপরেও মন্ত্রীকে শেষ সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন বিচারপতি। এর পরেই রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়ে, সিবিআইকে ই-মেইল করে সন্ধ্যায় সোজা নিজাম প্যালেসে পৌঁছেছিলেন তিনি।

 

পরেশ অধিকারীর সঙ্গে ববিতার 'অধিকারের' লড়াই


মেখলিগঞ্জের বিধায়ক পরেশ অধিকারীর এসএসসি মামলায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে ইতিমধ্যেই অস্বস্তিতে পড়েছে কোচবিহার জেলা তৃণমূল। প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না করলেও বিধায়কের কীর্তি দলের যুবদের ওপরে খারাপ প্রভাব ফেলছে বলেই কথা উঠছে দলের অন্দরে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং লোকসভা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। তবে পরেশ অধিকারীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোচবিহার জেলা তৃণমূল সভাপতি পার্থপ্রতিম রায়। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগ করে তিনি দাবি করেছেন, "তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ হলেই যে সে দোষী, এটা তো আর বলা যায় না। এর আগে অনেক অভিযোগ হয়েছে, আবার নির্দোষ প্রমাণ হয়েছে। এর আগে বহু নেতাকে সিবিআই তলব করেছে। এটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি কি না, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।"

 

বাম আমলে অত্যন্ত দাপুটে একজন নেতা ছিলেন পরেশ অধিকারী। ফরওয়ার্ড ব্লকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তিনি ছিলেন। বাম আমলে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালেই তৃণমূলে যোগদান করেন। কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে, তৃণমূলে যোগদান করার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ওয়েটিং লিস্টের তালিকায় নাম উঠে আসে তাঁর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর। কিছুদিনের মধ্যেই প্রভাব খাটিয়ে মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এসএসসি মেধাতালিকায় প্রথমে নাম না থাকা সত্ত্বেও অঙ্কিতা অধিকারী মেধাতালিকার প্রথমে চলে আসেন এবং চাকরি পান।

 

পরেশ অধিকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই পরেশ অধিকারী প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এরপর ২০১৯-এর লোকসভায় যখন পরাজিত হলেন পরেশ অধিকারী, সেই সময় তৃণমূলে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যান তিনি। কিন্তু, পরেশ অধিকারীকে তৃণমূলের যিনি নিয়ে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁর পাশে। এবং তিনি আর কেউ নন, এসএসসি মামলার আরেক অভিযুক্ত রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাই পরেশ অধিকারীর তেমন একটা চিন্তা ছিল না।

 

ববিতা সরকারের মামলার পরেও অনেকটাই খোশমেজাজে ছিলেন পরেশ অধিকারী। এর পরেই একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হন পরেশ অধিকারী, তাও আবার যে সে মন্ত্রী নয়, যে দপ্তরের মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে, সেই শিক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিরা। বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের বেঞ্চ থেকে ধাক্কা খাওয়ার পরে ডিভিশন বেঞ্চেও তাঁর মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে। পরেশ অধিকারীর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

 

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছিলেন, মেয়ের চাকরি-সহ তিনটি শর্তেই তৃণমূলে এসেছিলেন পরেশ। লোকসভা নির্বাচনে হারলেও যখন বিধানসভা ভোটে জিতলেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করে দিলেন। পরেশ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী হওয়ায় লড়াইয়ে আরও কঠিন হয় ববিতার। কিন্তু তাও, মেয়েকে আর বাঁচাতে পারলেন না পরেশ অধিকারী। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছর পর পরেশকে যে সিবিআই-এর ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হলো, তার কারণ এই ববিতাই। এসএসসি চেয়ারম্যানের পদ থেকে বুধবার ইস্তফা দিলেন সিদ্ধার্থ মজুমদার। পরেশ অধিকারীর কন্যার দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনার অনেকটাই কৃতিত্ব তাঁর। হাই কোর্টে তিনি জানিয়েছিলেন, পরেশের কন্যাকে অবৈধভাবে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিলিগুড়ি কোর্ট মোড়-এর বাসিন্দা ববিতা যদি তাঁর অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই না চালিয়ে যেতেন, তবে সিদ্ধার্থের একার পক্ষে মন্ত্রীর গোপন বন্দোবস্ত ফাঁস করা সম্ভব হতো না। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর শেষমেশ ৫ বছর পরে সুবিচার পেলেন ববিতা। হয়ে উঠলেন, চাকরির আশায় বসে থাকা তামাম এসএসসি প্রার্থীদের একজন প্রতিবাদের মুখ। আর এই প্রতিবাদের ভাষাকে জীবিত রাখার নেপথ্যে সেই 'খারাপ' বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

 

অঙ্কিতার ভবিষ্যৎ কী?

এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এর পরেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন অঙ্কিতা অধিকারী। তাঁকে কর্মজীবনের বেতনের সমস্ত টাকা ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। দুই কিস্তিতে টাকা ফেরাতে হবে অঙ্কিতা অধিকারীকে। পাশাপাশি কোচবিহারের ইন্দিরা বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর পদ কেড়ে নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধাতালিকায় নাম না থাকা সত্ত্বেও তিনি নাকি ৪৩ মাস চাকরি করছেন ওই স্কুলে! তবে সম্প্রতি এসএসসি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি মামলায় সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই, এই মামলায় নাম ওঠে অঙ্কিতা অধিকারীর। বাবার সুপারিশে অঙ্কিতা যোগ্য নম্বর না পেলেও চাকরিতে যোগদান করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অঙ্কিতাকে ডেকে পাঠায় সিবিআই। হাজিরা এড়ালেও শুক্রবার এই শুনানিতে স্কুল সার্ভিস কমিশনকে অঙ্কিতা অধিকারীর বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

 

মন্ত্রীর মেয়ে অঙ্কিতা কোথায়, তা এদিন জানতে চাওয়া হয়। তাকে আদালতে হাজির হতে বললে আসতে পারবে কি না, তাও জানতে চায় কলকাতা হাইকোর্ট। আইনজীবী জানান, অঙ্কিতা এই মুহূর্তে কোচবিহারে আছে তাই ডাকামাত্রই আসা সম্ভব নয়। সবকিছু শুনে উচ্চ আদালত অঙ্কিতাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয়। আদালতের তরফ থেকে বলা হয়, অঙ্কিতা যেন শিক্ষিকা হিসেবে নিজেকে পরিচয় না দেন। তারপরেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, মন্ত্রীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী স্কুলে ঢুকবে না। অঙ্কিতা অধিকারী ইন্দিরা গার্লস হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষিকা। কিন্তু সেই স্কুলে ঢুকতে পারবেন না অঙ্কিতার পরিবারের সদস্য এবং পরিজনরা। পাশাপাশি কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ৪৩ মাস ধরে স্কুলে চাকরি করে তিনি যে বেতন পেয়েছেন, তার সমস্ত অর্থ হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। ৭ জুন এবং ৭ জুলাই- এই দুই কিস্তিতে বেতন ফেরাবেন মন্ত্রীর মেয়ে।

 

বিচারপ্রার্থীদের 'মসিহা' বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

দুর্নীতি দেখে চুপ থাকবে না আদালত, একটা সময় এই কথাটা শুধুমাত্র ব্যবহার করা হতো কোনও বাংলা সিনেমার সংলাপে। কিন্তু, একটা দীর্ঘ সময় পর কলকাতা হাই কোর্টের এক বিচারপতির গলায় শোনা গেল এই বিশেষ কয়েকটি শব্দবন্ধ। বক্তার নাম, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। হাই কোর্ট পাড়ায় এই মুহূর্তে তিনি শাসকের হাই প্রেশারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন এই বিচারপতি। গত কয়েক মাসে একের পর এক মামলায় তাঁর এজলাস থেকে এসেছে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ। পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে পরেশ অধিকারী, একের পর এক ভিভিআইপিদের নিজাম প্যালেস অবধি দৌড় করিয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

 

২০০৮ সালে বিচারপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত এসএসসি প্যানেলের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। তারপরে ২০১৮ সালে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে কলকাতা হাই কোর্টে আসেন। হাই কোর্টের ১৭ নম্বর এজলাসে তিনি যেন শাসক দলের যমরাজ! ২০২১ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সিবিআই অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরি থেকে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। আইনজীবী হিসেবে অরিজিনাল সাইটের মামলা, ন্যাশনাল ইনশিওরেন্স কর্পোরেশনের মামলা থেকে শুরু করে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা লড়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। স্কুল শিক্ষা কমিশনের দুর্নীতি বাদেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কলকাতা হাই কোর্ট সাক্ষী থেকেছে তাঁর একাধিক মানবিক রায়ের। ৭৬ বছরের বৃদ্ধার ২৫ বছরের এরিয়ার-সহ সমস্ত বেতন মিটিয়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত তাঁর এজলাস থেকে এসেছে। দুরারোগ্য ক্যানসার-আক্রান্ত সোমা কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এজলাসে দাঁড়িয়েই সোমা ঘোষণা করেছিলেন, আলাদা চাকরি নয়, তাঁদের মনে আশা জাগিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি তাঁর লড়াই চালিয়ে যাবেন।

 

একটি মামলায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক শিক্ষকের বেতন আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলাতেও বেনজির রায় দিয়ে ১০ জুন পর্যন্ত ওই শিক্ষকের স্কুলে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। স্কুলের গেটে দু'জন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চেও একের পরে এক রায় ঘোষণা করেছেন। তাঁর একক বেঞ্চের নির্দেশের ওপর বিভিন্ন সময়ে ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চিঠি লেখেন তিনি। প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ দাবি করেন চিঠিতে। শাসকের প্রেশার এতটাই বেড়ে যায় যে, তাঁদেরকে শেষমেষ ধরনা দিতে হয়। শাসক দলের আইনজীবীরা তাঁর কোর্ট রুমের বাইরে ধরনা দেন। এমনকী, ২০২২ সালে এপ্রিল মাসে তাঁর এজলাস বয়কটের ডাক দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন।

 

কিন্তু তাঁর এই মনোভাব পাল্টে দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিদের মনোভাবকেও। এখন শুধু তিনি একা নন বিচারপতি ট্যান্ডন, বিচারপতি সামন্ত, সকলেই শাসকের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছেন রায়। সরাসরি না বললেও, ভাবে-ভঙ্গিমায়, রায়ের ধরনে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কলকাতা হাই কোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ ও ডিভিশন বেঞ্চ আর শাসক দলের দুর্নীতি লুকোনোর জায়গা হবে না। এবারে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! সমস্ত বিচারপতিদের এই মনোভাবে চাপে পড়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও। এতদিন পর্যন্ত, তৃণমূলের কথায়, কলকাতা হাই কোর্টের একমাত্র 'মাথা খারাপ' বিচারপতি ছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু, আর কতদিন? বয়কট, ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সমস্ত চাকরিপ্রার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন এই বিচারপতিরা। আইনি দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁস কাটিয়ে যেভাবে বিচারপ্রার্থীকে দ্রুত সুবিচার দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়, এখন অনেক বিচারপতিই সেই রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন। আইন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের হারিয়ে যাওয়া সেই বিশ্বাস ফিরছে আবার। আবার মানুষ আশা করছেন সুবিচার পাওয়ার। আবার মানুষ হাই কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে। আর্জি একটাই, "প্লিজ, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসেই মামলাটা দিন, তাহলেই সুবিচার পাব আমরা।"

 

 

More Articles