বঙ্কিমদা থেকে রবীন্দ্রনাথ! ভোট এলেই মোদির ঝোলায় বাঙালি আইকন?

BJP Uses Bengali Icons as Electoral Tools: বাংলায় বিজেপির শিকড় নেই বলে সাংস্কৃতিক ধারকেই ব্যান্ডউইডথ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নেতাজিকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেন তাঁরা হিন্দুত্ব রাজনীতির অগ্রদূত ছিলেন।

লোকসভার সাম্প্রতিক বিতর্কে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল, বাঙালি আইকনরা এখন বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের কেন্দ্রে। বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনার সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে 'বঙ্কিমদা' বলে সম্বোধন করেন। মুহূর্তেই আপত্তি ওঠে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের তরফে। আপত্তি শুনে মোদি দ্রুত সংশোধন করেন,

আচ্ছা, বঙ্কিমবাবু বলছি।

বাঙালি আইকনদের ব্যবহার বিজেপির কাছে দিন দিন প্রথাগত বোঝাপড়া ছাড়াই কেবল নির্বাচনী স্টান্টের মতো হয়ে যাচ্ছে।

লোকসভায় বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে এই বিতর্ক শুধু একটি শব্দ ভুল বলার ঘটনা নয়। এতে আবারও সামনে এসেছে যে বিজেপি কীভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহার করে। বন্দে মাতরম, বাঙালির কাছে যুগান্তকারী সাহিত্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা, সেটিকে বিজেপি খুব সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চাইছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিজেপি শাসনেই মতপ্রকাশের অধিকার পর্যন্ত সংকুচিত, বহুত্ববাদের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হয়েছে, এখন তারা বঙ্কিমের ভাবনাকে দখল করে নৈতিকতা শেখাতে চায়! বিজেপির কাছে এটি ইতিহাসের থেকেও বেশি রাজনৈতিক আবেগ তৈরির শক্তিশালী হাতিয়ার।

'বঙ্কিমদা' বলে ফেলার পর মোদির তৎক্ষণাৎ সংশোধনও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এতে বোঝা যায়, বিজেপি বাংলার ভাষা, রীতি, সংস্কৃতির সূক্ষ্মতা এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেন না। অথচ সেই বাংলার সংস্কৃতিকেই তারা বারবার নির্বাচনে সহানুভূতি পাওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে। আসলে বাংলায় বিজেপিকে আজও বহিরাগত মনে করা হয়, এটাই মূল সমস্যা। তাই বাংলা জয়ের শর্টকাট হিসেবে তারা ইতিহাস, সাহিত্য, প্রতীক সবাইকে ভোটের ভাষায় অনুবাদ করছে। 

আরও পড়ুন

বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!

মোদি আগেও বাঙালির আবেগ টেনে রাজনীতি করেছেন। আর ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বাঙালি আইকনের জায়গা বরাবরই বিশেষ। কিন্তু গত এক দশকে তাঁদের ব্যবহার নতুন এক মাত্রা পেয়েছে, বিশেষত নির্বাচনের সময়। নির্বাচন সামনে এলেই, তাঁর ভাষণে অনিবার্যভাবে চলে আসে রবি ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বিবেকানন্দের নাম। ক্রমে এটি রাজনৈতিক কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, প্রতিটি বাঙালি আইকনকে বিজেপি তাদের সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবাদী বয়ানে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলে।

২০১৯ সালে লালকেল্লায় নেতাজি সংগ্রহশালা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রবেশদ্বারে নেতাজির ছবির পাশাপাশি তাঁর নিজের ছবিও রাখা হয়। ২০২২ সালে মোদি অভিযোগ তোলেন, স্বাধীনতার পরে জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেস ইচ্ছাকৃতভাবে নেতাজিকে ইতিহাস থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। তাঁর দাবি ছিল, ভারত যদি নেতাজির পথ অনুসরণ করত, দেশ আরও উঁচুতে পৌঁছতে পারত, এবং তিনি নাকি এখন সেই পথেই এগোচ্ছেন। বাংলার ২০২১ সালের ভোটের আগে মোদি আত্মনির্ভরতার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি পংক্তি,

চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী

উচ্চারণ করার চেষ্টাও করেন। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁর আগ্রহ তিনি মন কি বাত-এ বারবার দেখিয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি দাবি করেন, রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় তিনি রেডিও-তে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন। ২০২০ সালে একই অনুষ্ঠানে দেশের খেলনা শিল্প বা শিশুদের উপযোগী খেলনার সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবারও রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করেন।

ভোট এলেই মোদির ভাষণে বাঙালির মহীরুহদের নাম এমনভাবে উঠে আসে যে মনে হয় তিনি দীর্ঘদিন বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরের সদস্য। বিশ্বভারতী যেন হয়ে ওঠে তাঁর আধ্যাত্মিক তীর্থ ক্ষেত্র। তিনি যেন দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক ছিলেন। বিশ্বভারতী, রবীন্দ্র-দর্শন, সবই তাঁর ঠোঁটে সাজানো। কিন্তু বাস্তব প্রশ্ন একটাই, যেখানে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বে বিশ্বভারতী আজ ক্ষতবিক্ষত, রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক চাপে নুইয়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে মোদির এই ‘রবীন্দ্রভক্তি’ কতটা আন্তরিক? নাকি এটি ছিল কেবল ভোটের মৌসুমী চশমা?

আরও পড়ুন

শতবর্ষে আরএসএস : ইতিহাস পুনর্লিখনের পথে মোদি সরকার?

আর নেতাজি! এখানেই বিজেপির প্রতীকী রাজনীতি সবচেয়ে স্পষ্ট ও সবচেয়ে নগ্নভাবে ধরা পড়ে। তাঁর জন্মদিনকে পরাক্রম দিবস ঘোষণা করা হোক বা লালকেল্লায় হলোগ্রাম মূর্তি স্থাপন সবকিছুই ক্রমে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কারণ নেতাজির প্রকৃত আদর্শ ছিল বহুমাত্রিক, সাম্যবাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক; তাঁর রাজনীতি কেন্দ্রীভূত শক্তির নয়, বরং বহুধারার ভারত গড়ার স্বপ্নে ভর করে। কিন্তু বিজেপি আজ তাঁকে এমনভাবে ব্যবহার করছে, যেন নেতাজির নাম উচ্চারণ করলেই তাদের আক্রমণাত্মক, কেন্দ্রিকৃত জাতীয়তাবাদ হঠাৎই 'খাঁটি' হয়ে যায়। নেতাজির ভাবমূর্তি তাদের কাছে শুধু ইতিহাস নয়, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার। যে নেতাজি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তিনিই এখন ব্যবহৃত হচ্ছেন কর্তৃত্বকেন্দ্রিক রাজনীতির চিহ্ন হিসেবে, এটাই সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য।

সত্যিটা হলো, বিজেপির কাছে বাঙালি আইকনরা কেবলই নির্বাচনী ব্র্যান্ডিং। বাংলায় নিজেদের শিকড় নেই বলে সাংস্কৃতিক ধারকেই ব্যান্ডউইডথ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নেতাজিকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেন তাঁরা হিন্দুত্ব রাজনীতির অগ্রদূত ছিলেন। অথচ তাঁদের লেখনী, চিত্রকল্প, রাজনৈতিক আদর্শ সবই ছিল বহুমাত্রিক, মানবতাবাদী, যুক্তিবাদী। বিজেপির প্রচারণায় সেই সত্যের জায়গায় ঢুকে পড়েছে একটি সুবিধাজনক বিকল্প ইতিহাস।

তাই বলতেই হয়, বাংলা দখলের লড়াইয়ে বিজেপির সবচেয়ে বড় অস্ত্র এখন আর সংগঠন নয়, আইডিওলজিও নয়, আইকন। ভোট এলেই যেন জাদুর ঝোলার মতো বেরিয়ে আসে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, বিবেকানন্দ। একদিকে বাংলার সংস্কৃতি-বোধকে টার্গেট করা, অন্যদিকে ‘বহিরাগত’ তকমা— এই দুই লক্ষ্যেই মোদি-শাহর দল বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করতে চায় বাংলা আইকনদের কথা উল্লেখ করে। তবে বিজেপির আইকন-রাজনীতি যতই আকর্ষণীয় দেখাক, ভিতরে তা ততটাই ফাঁপা। লোকসভায় বঙ্কিমচন্দ্রকে ঘিরে যে ঘটনা ঘটল, সেটি ছবিটা আরও স্পষ্ট করে দেয়, বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতীকরা এখন ইতিহাসের উত্তরাধিকার নয়, বরং ভোট পাওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

প্রশ্ন এখানেই বাংলাকে জিততে কি বিজেপির নিজের মতো কোনো বাঙালি নেতৃত্ব, কোনো দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক কাজ, কোনো সাংস্কৃতিক মুখ নেই? বিজেপি বাংলা সংস্কৃতি বোঝার জন্য এত বছরেও কোনো গ্রহণযোগ্য মুখ দাঁড় সামনে আনতে পারেনি, তাদের ভরসা এখন কেবল বাংলার মহীরুহরা।

More Articles