দলে একাধিক ক্যাপ্টেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কী হবে টিম ইন্ডিয়ার?

এই বছরের বিশ্বকাপ যে ভারতের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা অনস্বীকার্য। তবে এর মাঝে সৃষ্টি হয়েছে একটি বড় প্রশ্ন, এবং তা হলো অধিনায়কত্ব সামলাবে কে?

কথায় বলে, ক্রিকেট হোক কিংবা ফুটবল, দলের অন্দরে অধিক অধিনায়ক হয়ে গেলে তা শেষমেশ গোটা দলের পক্ষেই হয়ে ওঠে ক্ষতিকারক; আবার অপরদিকে বিকল্প না থাকলেও বেশ মুশকিল! আর এই দুই পরিস্থিতির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে গেলে ব্যস, কেল্লা ফতে। বর্তমানে ঠিক এই অবস্থাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের। বিরাট কোহলির সঠিক বিকল্প কে, তা নিয়ে ঢের প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। শুধু কি তাই, আইপিএল-এর জাদুতে ক্যাপ্টেন হিসেবে এত বেশি নাম উঠে এসেছে যে, তাদের মধ্যে কে অধিক ভালো, তা স্থির করতে প্রয়োজন কোনও ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মানুষকে। কেন এমন পরিস্থিতিতে পড়লাম আমরা, তার জন্য কয়েকটি পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করলেই পরিষ্কার হবে।

সামনে আসতে চলেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ; যেখানে ভারত-সহ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দেশগুলি অংশগ্রহণ করতে চলেছে। এক্ষেত্রে সকল দলকে পরাজিত করে খেতাব জয় করতে গেলে ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং- সব ক্ষেত্রেই নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে হবে টিম ইন্ডিয়াকে। তবে বর্তমানে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে অধিনায়ক ইস্যু। অতীতে ভারতীয় টিমের সাফল্যের পেছনে অধিনায়করা বড় ভূমিকা রেখেছে, যেমন প্রথম বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক কপিল দেব হোক কিংবা পরবর্তীকালে মহারাজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্র সিং ধোনি সকলেই অধিনায়ক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করে গিয়েছেন, এককথায় তার কোন তুলনা হয় না।

২০০৭ এবং ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপ খেতাব জয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যদিও বহু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞর মতে, ধোনির নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করলেও তার প্রধান ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ২০০৩ সাল থেকেই, যে মুহূর্তে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অধীনে ভারতীয় ক্রিকেট সাক্ষী ছিল এক বড় পরিবর্তনের; শেহবাগ, যুবরাজ, জাহির খান এবং মহম্মদ কাইফের মতো একাধিক তরুণ প্রতিভা উঠে আসে সেই মুহূর্তে এবং পরবর্তীকালে ২০০৭ ও ২০১১-তে তাদের ওপর ভর করেই টিম ইন্ডিয়া জিতে নেয় খেতাব। ঠিক যেরকমভাবে ১৯৮৩ সালে 'আন্ডারডগ' হিসেবে শুরু করলেও সকলকে মাত দিয়ে বিশ্বজয় করে কপিলের ছেলেরা।

আরও পড়ুন: মনোজ তিওয়ারি থেকে ঋদ্ধিমান সাহা, বাইশ গজে বাংলার ভাগ্যে শুধুই অবহেলা?

তবে অতীত ছেড়ে বিগত কয়েক বছরের দিকে যদি দেখা যায়, তবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভাগ্যে জুটেছে শুধুই হতাশা। দেশ এবং বিদেশের মাটিতে একাধিক সিরিজ জিতলেও প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে ভারতের ভাঁড়ার থেকেছে শূন্য। ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হার, ২০১৬-তে সেমিফাইনাল থেকে বিদায়, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচে লজ্জাজনক হার এবং ২০১৯-এ নিউজিল্যান্ডের কাছে সেমিফাইনালে ছিটকে যাওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলোয় ক্রমশ মুখ পুড়েছে টিম ইন্ডিয়ার। সম্প্রতি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে নিউজিল্যান্ডের কাছে পুনরায় পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে বিরাট-বাহিনীকে এবং সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও গ্রুপ লিগ থেকে বিদায় নিয়েছে তারা। এক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের কাছে লজ্জার হার স্বীকার করে নেয় গোটা টিম, যা সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে কখনওই হয়নি।

এসবের মাঝে এই বছরের বিশ্বকাপ যে ভারতের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা অনস্বীকার্য। তবে এর মাঝে সৃষ্টি হয়েছে একটি বড় প্রশ্ন, এবং তা হলো অধিনায়কত্ব সামলাবে কে?

সাম্প্রতিককালে টি-টোয়েন্টি, ওয়ান ডে এবং টেস্ট- তিন ফরম্যাট থেকেই অধিনায়কত্ব হারাতে হয় বিরাট কোহলিকে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ব্যাটিংয়েও খরা চলছে তাঁর। পরবর্তীতে বিরাট কোহলির পর টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক হিসেবে উঠে আসে রোহিত শর্মার নাম। এক্ষেত্রে অবশ্য পরবর্তী বেশ কয়েকটি সিরিজে রোহিতের ক্যাপ্টেন্সিতে ভারত জয়ের মুখ দেখে। তবে ব্যাপারটি মোটেও এত সহজ নয়! অধিনায়ক থাকাকালীন ম্যাচ জিতলেও রোহিত তাঁর সেরা ফর্মের ধারে-কাছে ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা, ভারত এইসব ম্যাচ জেতে শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের কাছে। ফলে অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডের মতো প্রতিপক্ষ এলে তাদের অবস্থা কী হবে, তা সময়ই বলবে।

তবে বর্তমানে অপেক্ষা করে রয়েছে আরও বড় অন্ধকার। কোনওক্রমে যদি ভবিষ্যতে রোহিত শর্মা অনুপস্থিত রয়ে পড়েন, সেই ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে আরও এক প্রশ্ন। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে বর্তমানে উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি নাম। যেমন, কে এল রাহুল, ঋষভ পন্থ এবং হার্দিক পান্ডিয়া। অনেকে আবার অধিনায়ক হিসেবে বুমরাহ-র নাম পর্যন্ত তালিকায় সামিল করেছেন। তবে তারা কেউই ধারে এবং ভারে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনির সমকক্ষ নয়। এক্ষেত্রে সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে রাহুলের নেতৃত্বে পরপর বেশ কয়েকটি ম্যাচ হারে টিম ইন্ডিয়া। বর্তমানে রাহুলের অনুপস্থিতিতে পন্থের হাতে অধিনায়কের ব্যাটন তুলে দেওয়া হলেও প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হারের মুখ দেখেছেন তিনি। এরপরেই উঠে এসেছে ক্যাপ্টেন হিসেবে হার্দিক পান্ডিয়ার নাম।

বলে রাখা ভালো, সম্প্রতি শেষ হওয়া আইপিএলে হার্দিকের নেতৃত্বে ট্রফি জেতে গুজরাট টিম। এরপরে ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে তাঁর নামটি ঘোরাফেরা করে চলেছে। তবে এক্ষেত্রে এত বেশি বিকল্প থাকলেও তারা কেউই যে অধিনায়ক হিসেবে অভিজ্ঞ নন, তা স্বীকার করে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রোহিত শর্মা ছাড়া ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক সেরকম নেই বললেই চলে।

আবার অন্যদিকে উঠে এসেছে আর এক প্রসঙ্গ। আইপিএলের প্রথম দিকের কলকাতা দলের কথা হয়তো সকলের মনে আছে। সেই সময় দলের মধ্যে ম্যাকালাম থেকে শুরু করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং পন্টিংয়ের মতো একাধিক অধিনায়ক থাকার ফলে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল গোটা দলকে। এমনকী, প্রতিযোগিতার মাঝপথেই বেশ কয়েক বার ক্যাপ্টেন বদল করতে দেখা যায় স্বয়ং কোচকে আর তার ফল ভুগতে হয়েছিল পুরো স্কোয়াডকে। ফলে বর্তমানে ইন্ডিয়ায় বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, হার্দিক পান্ডিয়া এবং রাহুলের মতো একাধিক ক্যাপ্টেন থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থাও ২০১১ সালের কলকাতা দলের মতো হবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যদি খেতাব জয় করতে হয়, তবে ব্যাটিং-বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ের পাশাপাশি অধিনায়কত্বর ক্ষেত্রেও ভারতকে যে এখন থেকেই ভেবে রাখতে হবে, সেই বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

More Articles