গান্ধী পরিবারের একচেটিয়া দখলদারিতে বিরক্ত নেতারা, ২০২৪-এর আগে কোথায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেস?

সিবালের প্রস্থানে G-23 গোষ্ঠীও অচিরেই ভেঙে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ গোলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মার মতো নেতারা এই মুহূর্তে রাজ্যসভার টিকিট পেতে উদগ্রীব।

হৃত গৌরব ফিরে পেতে আগাপাশতলা রদবদলের কথা শোনা গিয়েছিল। প্রবীণ-নবীন সকলকে একজোট করে অক্সিজেনের জোগান বাড়ানোর কথা ফিরছিল মুখে মুখে। উদয়পুরে মহাসমারোহে ‘চিন্তন শিবির’ সেরে দিল্লি ফেরার পর এখনও দু’সপ্তাহও কাটেনি। তার মধ্যেই বড় রদবদল ঘটে গেল কংগ্রেসে। দল ছাড়ার কথা ঘোষণা করলেন গান্ধী পরিবারের বিশ্বস্ত সৈনিক কবিল সিবাল। শুধু তাই নয়, যে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের দায়িত্বে রয়েছেন খোদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, সেখানে বসেই সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে রাজ্যসভার জন্য মনোনয়নও জমা দিলেন তিনি। দীর্ঘ তিন দশক কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় থাকার পর জানিয়ে দিলেন, কারও অনুগত থেকে নয়, সংসদে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে চান তিনি। কারও অঙ্গুলিহেলনে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা, নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে যাবেন।

 

আইনি ঝামেলা হোক বা দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, দীর্ঘ দিন কংগ্রেসের ড্যামেজ কন্ট্রোল ম্যান হয়েছিলেন সিবাল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দলের সর্বত্র যে ঘুণ ধরেছে, তা বছরদুয়েক আগেই টের পেয়েছিলেন। তাই গান্ধী পরিবারের প্রতি ভক্তিভাব সরিয়ে রেখে, নতুন করে দল সাজানোর জিগিরের অন্যতম হোতা হয়ে উঠেছিলেন। কংগ্রেসে থেকেই বিক্ষুব্ধ নেতাদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন G-23। সর্বক্ষণের নেতা না থাকা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকা নিয়ে প্রকাশ্যেই দলের, সর্বোপরি গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন তিনি। তবে দিনদশেক আগেই যে তিনি ইস্তফা দিয়ে ফেলেছেন, তা এতদিন চাউর হয়নি। বুধবার অখিলেশ যাদবকে পাশে নিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় নিজেই তা খোলসা করলেন সিবাল।

 

কপিলের মতো সুবক্তা, বিচক্ষণ এবং সর্বজ্ঞ নেতার এমন প্রস্থানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মুখে পড়ছে গান্ধী পরিবার। সত‍্যি ‘চিন্তন শিবির’-এ ভারী ভারী কথা বলে দলকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বললেও, আদৌ কংগ্রেস নেতৃত্ব তা নিয়ে ভাবিত কি না, উঠছে প্রশ্ন। কারণ শুধু সিবাল নন, গত পাঁচ মাসে এই নিয়ে পঞ্চম তথাকথিত হেভিওয়েট নেতা কংগ্রেস ছাড়লেন। সিবাল ছাড়াও এই তালিকায় যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন:

 

আরও পড়ুন: কংগ্রেসের ঘোর কলি! কপিল সিবালের দলত্যাগ যে বার্তা দিল

 

সুনীল জাখর: প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। চরণজিৎ সিংহ চান্নির সমালোচনায় সরব হওয়ায় তাঁকে শোকজ করেছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তা নিয়ে হইচই না বাধালেও, চলতি মে মাসেই কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি-তে যোগদান করে জবাব দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, শ্লেষমেশানো সুরে গান্ধীদের উদ্দেশে বার্তা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “কে বন্ধু, কে শত্রু, তা চিনতে শেখা উচিত দলীয় নেতৃত্বের।”

 

হার্দিক প্যাটেল: আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে গুজরাতে কংগ্রেসের ইতিবাচক সম্ভাবনা নিয়ে যে-সময় আলোচনা তুঙ্গে, সেই সময়ই সব সম্ভাবনায় কার্যত জল ঢেলে দেন পতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেল। জানিয়ে দেন, দলে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে তাঁকে। সোনিয়া গান্ধীকে লেখা পদত্যাগপত্রে সাফ জানিয়ে দেন, দেখা করতে গেলে, অভাব-অভিযোগ শোনার বদলে মোবাইলেই বুঁদ হয়ে বসে থাকেন দলের নেতা। সরাসরি নাম না নিলেও, তাঁর ইশারা যে রাহুল গান্ধীর দিকে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারওরই। দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে সমাধানের রাস্তা খোঁজার বদলে গুজরাত কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য চিকেন স্যান্ডউইচের ব্যবস্থা করতে বেশি তৎপর বলেও কটাক্ষ ছুড়ে দেন হার্দিক।

 

অশ্বনি কুমার: দীর্ঘ ৪০ বছর পর প্রাক্তন আইনমন্ত্রী অশ্বনি কুমার এ-বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কংগ্রেস থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সোনিয়াকে লেখা পদত্যাগপত্রে সাফ জানান, দলে থেকে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তাঁর। অদূর ভবিষ্যতে মুখ থুবড়ে খাদে পড়ে যাওয়া ব্যতীত, কংগ্রেসের মধ্যে কোনও সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছেন না বলেও জানান তিনি।

 

রঞ্জিত প্রতাপ নারায়ণ সিংহ: গত বছর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, দীর্ঘ ৩২ বছর কংগ্রেসে কাটিয়েছেন তিনি।কিন্তু আগের সেই দল আর নেই।

 

তাঁরও আগে আবার ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং, জিতিন প্রসাদ, যোগানন্দ শাস্ত্রীও কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যান। নিজের নতুন দল গড়ে, বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে নির্বাচনে কংগ্রেসকেই টেক্কা দেন ক্যাপ্টেন। জিতিন আবার সরাসরি বিজেপি-তেই গিয়ে উঠেছেন। শাস্ত্রী বেছে নিয়েছেন ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিকে।

 

এককালে দলের হয়ে, পূর্বতন ইউপিএ সরকারের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন যে নেতারা, একে একে তাঁদের এই প্রস্থানে প্রশ্নাতীতভাবেই কাঠগড়ায় গান্ধী পরিবার। বিশেষ করে রাহুল গান্ধী। কারণ খাতায়-কলমে সোনিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দলের মাথায় থাকলেও, আদতে আড়াল থেকে রাহুলই সবকিছু পরিচালনা করছেন বলে কংগ্রেসের অন্দরে, বাইরে, সর্বত্রই প্রচলিত। তাই রাহুল সরাসরি নেতৃত্বেও আসছেন না, আবার নেতাদের দলত্যাগ আটকাতে, বিক্ষুব্ধদের মান ভাঙাতে কেন কিছু করছেনও না, তা ভাবিয়ে তুলছে সকলকেই।

 

কারণ হিমন্ত বিশ্বশর্মা থেকে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, ক্যাপ্টেন থেকে সিবাল, কারও চলে যাওয়া আটকাতেই তেমন গরজ দেখা যায়নি কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে। সিবালের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। বুধবার তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আসতে আত্মসমীক্ষার পরিবর্তে সিবালকে আক্রমণ করতেই দেখা যায় কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ প্রদীপ তামতাকে। তিনি বলেন, “কংগ্রেস ওঁকে সবকিছু দিয়েছে। এটা ওঁর দলকে দেওয়ার সময় ছিল। কিন্তু রাজ্যসভায় একটি আসনের বিনিময়ে দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াকেই বেছে নিয়েছেন উনি।”

 

রাহুল নিজে যদিও এখনও পর্যন্ত সিবালের প্রস্থান নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। কিন্তু সিবালের প্রস্থানে কংগ্রেস নেতৃত্ব একরকম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, বিক্ষুব্ধদের নিয়ে G-23 গঠনের হোতা সিব্বলই। কারণে-অকারণে লাগাতার গান্ধী পরিবারকে নিশানা করে গিয়েছেন তিনি। অথচ সংসদে জ্বালাময়ী ভাষণ ছাড়া সাম্প্রতিককালে দলের হয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি সিবালকে। G-23 গোষ্ঠীর অংশ হয়েও সম্প্রতি উদয়পুরে ‘চিন্তন শিবির’-এ যোগদান করেছিলেন শশী থারুরের মতো নেতারা সেখানে সিবাল ছিলেন অনুপস্থিত।

 

সিবালের প্রস্থানে G-23 গোষ্ঠীও অচিরেই ভেঙে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ গোলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মার মতো নেতারা এই মুহূর্তে রাজ্যসভার টিকিট পেতে উদগ্রীব। রাজস্থান থেকে আজাদের নাম প্রস্তাব করা একরকম পাকাও হয়ে গিযেছে। তাই গান্ধীদের চটানোর রাস্তায় তাঁরা যাবেন না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের দাবি, দল ছাড়লে লোকসভার সাংসদ পদটিও চলে যাবে। তাই থারুর, মণীশ তিওয়ারির মতো নেতারাও সেই ঝুঁকি নেবেন না। তাই কংগ্রেসের ঘাড় থেকে একটি বোঝা নেমেই গেল বলে ধরেই নিচ্ছেন তাঁরা।

 

আবার ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে, সিবালের এই প্রস্থানকে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেও দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, গান্ধীদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলায় কংগ্রেস ছেড়ে বেরনো ছাড়া উপায় ছিল না সিবালের। কিন্তু দল ছেড়ে বেরনোর পরও কংগ্রেস সম্পর্কে কোনও কুকথা বলতে শোনা যায়নি। বরং ৩০-৩২ বছরের সম্পর্ক শেষ করা সহজ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে রাজ্যসভার মনোনয়ন জমা দিলেও, অখিলেশের দলে যোগ দেননি সিবাল। বরং স্বাধীন, নির্দল প্রার্থী হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরার কথা বলেছেন। এর পিছনে বিজেপি-বিরোধী জোটের অঙ্ক রয়েছে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের।

 

এ-প্রসঙ্গে গত বছর বাজেট অধিবেশের সমাপ্তির পর সিবালের ডাকা নৈশভোজের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, ২০১৬ সালেও সিবালের রাজ্যসভায় যাওয়ায় সমর্থন জানিয়েছিল সমাজবাদী পার্টি। বাবা মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ের সময় অখিলেশের হয়ে নির্বাচন কমিশনে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সিবাল।রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভালো।১৯৯৮ সালে লালুই রাজ্যসভায় সিবালকে পাঠানোর জন্য সোনিয়ার কাছে দরবার করেছিলেন।

 

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে সিবালের। তৃণমূলের হয়ে মামলাও লড়েছেন তিনি। সূত্রের খবর, রাজ্যসভায় যেতে প্রথমে মমতার সমর্থনই প্রার্থনা করেছিলেন সিবাল। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তাতে রাজি হননি সিবাল। তাই শেষমেশ অখিলেশের হাত ধরেন। বিজেপিবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এই সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আগামিদিনে বিজেপি-বিরোধী জোটে সিবালকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তাতে সফল হলে আগামিদিনে রাহুলের সঙ্গে সিবালের মনোমালিন্য মিটে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

 

More Articles