মহারাষ্ট্রের মহা-নাটকের যবনিকা পতন, নতুন যুগের শুরু?

নতুন করে এই রাজ্যে ফড়নবিসের অভিষেক ঘটানোই কি বিজেপির কাছে বড় চ‍্যালেঞ্জ ছিল? সেই কাজে বিজেপির তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করেছেন একনাথ। কার্যত তাঁকে ব্যবহার করেই বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে।

২০ জুন বিধান পরিষদ নির্বাচনে শাসক জোট ‘মহাবিকাশ অঘাড়ি’-র অপ্রত্যাশিত ধাক্কার পর শিবসেনার জনা কুড়ি বিধায়ক-সহ বিদ্রোহী নেতা একনাথ শিন্ডে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন। ২১ জুন নরেন্দ্র মোদির রাজ্যে সুরাতের রিসর্টে বসে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতা দখলের জন্য অতীতে অনৈতিক কোনও কাজ করিনি। ভবিষ্যতেও করব না। প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের কাছে আমি হিন্দুত্ববাদের শিক্ষা পেয়েছি।’’ এর পর বিজেপির ‘হেফাজতে’ অসমের গুয়াহাটির বিলাসবহুল হোটেলে আশ্রয় নেন তাঁরা।

তখনই নাটকের আখ্যান আরম্ভ।

তারপর বিভিন্ন ঘটনা-পরম্পরাকে কেন্দ্র করে পরতে পরতে জমেছে মহা-নাটক। উদ্ধব ঠাকরের ইস্তফা ঘোষণার ফলে গত ১০ দিনের এই ‘রাজনৈতিক নাটকের’ যবনিকা পড়ল মহারাষ্ট্রে। ২৯ জুন রাতে রাজ্যপালের নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে শিবসেনার তরফে জানানো আবেদন দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা শুনানির পর নাকচ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি জেবি পাড়িয়ালার বেঞ্চ রাজ্যপাল নির্দেশিত সময়সূচি মেনেই আস্থাভোট গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এর পরেই ‘ফেসবুক লাইভ’ করে পদত্যাগের কথা জানান উদ্ধব। মুখ্যমন্ত্রিত্বের পাশাপাশি তিনি বিধান পরিষদের সদস্যপদেও ইস্তফা দেন।

আরও পড়ুন: বাল ঠাকরের আদর্শ অতীত, মহারাষ্ট্রের স‌ংকটে নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ উদ্ধব ঠাকরের

বুধবার রাত ৯টায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ার নির্দেশ মেনে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার মধ্যেই বিধানসভায় আস্থাভোট নিতে হবে তাঁর সরকারকে। কিন্তু সেই নির্দেশের কিছুক্ষণ পরেই মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফার কথা ঘোষণা করেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে। আর সেই সঙ্গেই পতন ঘটল ৩১ মাসের ‘মহাবিকাশ অঘাড়ি' জোট (শিবসেনার পাশাপাশি এনসিপি এবং কংগ্রেস যার অন্যতম শরিক) সরকারের।

সুপ্রিম ধাক্কা
মহারাষ্ট্র বিধানসভায় ৩০ জুন আস্থাভোট নিতে হবে উদ্ধব ঠাকরেকে। রাজ্যপালের নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে শিবসেনার তরফে যে আবেদন জানানো হয়েছিল, ২৯ জুন দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা শুনানির পর তা নাকচ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

২৯ জুন বিকেল ৫টা থেকে শিবসেনার আবেদনের শুনানি শুরু হয় বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি জেবি পাড়িয়ালাকে নিয়ে গঠিত শীর্ষ আদালতের বেঞ্চে। রাত ৮টার কিছু পরে শুনানি শেষ করে বেঞ্চ জানায়, রাত ৯টায় এ-বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হবে। এরপর উদ্ধবের আবেদন নাকচ করে দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, রাজ্যপালের নির্দেশমতোই ১১টায় বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন শুরু হবে। আস্থাভোট শেষ করতে হবে বিকেল ৫টার মধ্যে। এই সুপ্রিম ধাক্কার পর অনিবার্য হয়ে ওঠে সরকারের পতন। পদত্যাগ করেন উদ্ধব।

বিদায়বেলায় কী বললেন উদ্ধব
সুপ্রিম কোর্ট আস্থাভোটের নির্দেশ দেওয়ার পরই ২৯ জুন ফেসবুক লাইভ করেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব। সেখানে তিনি বলেন, "যাঁরা অটো চালাতেন, রিকশা চালাতেন, তাঁদের এমপি, এমএলএ করেছি। যাঁদের সব দিয়েছি, তাঁরাই এমন করলেন। নাম না করে এভাবেই শিন্ডেকে আক্রমণ করেন তিনি।" রাজনীতিতে আসার আগে শিন্ডে ছিলেন অটো-রিকশা এবং টেম্পো চালক। একেবারে ছাপোষা অবস্থা থেকে ওঠেন শিন্ডে। যাওয়ার আগে একথা তাঁকে মনে করিয়ে দেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী। কারণ মহারাষ্ট্রে এই রাজনৈতিক ডামাডোলের নেপথ্যে একনাথই তো প্রধান কারিগর।

উদ্ধব আরও বলেন, যাঁদের বড় করেছি, ক্ষমতা পাওয়ার পর তাঁরাই ভুলে গিয়েছেন। যাঁদের সব দিয়েছি, তাঁরাই আজ বিক্ষুব্ধ। যাঁরা কিছু পাননি, তাঁরাই এখন পাশে। রাজ্যপালের উদ্দেশে উদ্ধব আরও বলেন, "দেড় বছর বিধান পরিষদের যে তালিকা আটকে রয়েছে, তার অনুমোদন দিন।" বিক্ষুব্ধ শিবসেনা বিধায়কদের উদ্দেশে উদ্ধব বলেন, "আপনারা কীসে অখুশি, সুরাত-গুয়াহাটি না গিয়ে, মাতোশ্রীতে এসে বলতে পারতেন। আপনাদের আবেগকে সম্মান করি, মাতোশ্রীতে এসে বলতেই পারতেন আপনারা।" তিনি জানান, শিবসেনা ভবনে বসবেন। পদ ছাড়ার জন্য কোনও দুঃখ নেই। নতুন করে দল তৈরি করবেন।

শিবসেনা বিধায়ক অনিল পারব উদ্ধবের পদত্যাগপত্র পৌঁছে দিয়েছেন রাজ্যপালের কাছে। রাতে তা গৃহীত হয়।

মিষ্টি বিলি
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল উৎসব। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের ইস্তফা ঘোষণার পর মুম্বইয়ের একটি বিলাসবহুল হোটেলে জড়ো হওয়া বিজেপি নেতাদের ভিড়ে শুরু হয়ে যায় মিষ্টি বিলি। আর সেই সঙ্গে বিজেপির পরিষদীয় নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিসের নামে উঠল স্লোগান। বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, তৃতীয়বারের জন্য মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিতে চলেছেন তিনি। উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন বিদ্রোহী শিবসেনা নেতা একনাথ শিন্ডে।

ফরমুলা সিক্স
শোনা যাচ্ছে, ফরমুলা সিক্স হলো, নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের নতুন ফরমুলা।

দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার সঙ্গে বৈঠক সেরে ৩০ জুন রাতে মুম্বই ফেরেন ফড়নবিস। রাজ্য বিজেপির অন্য নেতাদের সঙ্গে ডেরা বেঁধেছিলেন ওই হোটেলে। দিল্লির বৈঠকেই ‘ফরমুলা সিক্স’ মেনে পরবর্তী মন্ত্রিসভার রূপরেখা তৈরি হয়ে গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। অর্থাৎ, প্রতি ছ’জন বিধায়ক পিছু এক জন করে মন্ত্রী।

বর্তমানে ৩৯ জন বিদ্রোহী শিবসেনা বিধায়কের পাশাপাশি অন্তত আট জন নির্দল এবং ওমপ্রকাশ বাবুরাও কাড়ু ওরফে বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন প্রহার জনশক্তি পার্টির দুই বিধায়ক রয়েছেন শিন্ডে শিবিরে। শিন্ডে, বাচ্চু-সহ মোট ৮ জন মন্ত্রী রয়েছেন এই তালিকায়। তাঁদের প্রত্যেককেই ফের মন্ত্রী করা হতে পারে। এছাড়া বাড়তি দু’টি প্রতিমন্ত্রীর পদ পেতে পারেন শিন্ডে অনুগামীরা। অন্যদিকে বিজেপির রয়েছে ১০৬ জন বিধায়ক।

২৯ জুন শিন্ডে-সহ বিদ্রোহী বিধায়করা গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরে পুজো দিয়ে চার্টার্ড বিমানে গোয়ায় পৌঁছন। রাজধানী পানাজির কাছে একটি বিলাসবহুল রিসর্টে রয়েছেন তাঁরা। উদ্ধব ইস্তফা দেওয়ায় আর আস্থাভোটের প্রয়োজন নেই। এই পরিস্থিতিতে আগামী দু’-এক দিনের মধ্যে তাঁদের মুম্বই আনা হতে পারে। শোনা যাচ্ছে, ১ জুলাই বিজেপি নতুন সরকার গঠন করবে।

দীর্ঘদিনের শরিক বিজেপি-র সঙ্গ ছেড়ে আড়াই বছর আগে মহারাষ্ট্রে এনসিপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়েন উদ্ধব। তাঁর হাত ধরেই ঠাকরে পরিবারের নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রবেশ। এনসিপি এবং কংগ্রেস, দুই শরিকের অনুরোধেই মুখ্যমন্ত্রী হন উদ্ধব। কিন্তু সম্প্রতি উদ্ধবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন শিবসেনার বিধায়ক একনাথ শিন্ডে। এনসিপি, কংগ্রেসের সঙ্গ ছেড়ে বিজেপি-র হাত ধরতে হবে বলে দাবি করেন তিনি। এর পর একে একে বিক্ষুব্ধদের ভাঙিয়ে অসমে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন। সেই থেকে বিজেপি-র সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া নিয়ে নানা জল্পনা শোনা যাচ্ছিল। তার পর দেবেন্দ্র ফড়নবিস মঙ্গলবারই গিয়ে উদ্ধব সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে গেলেও, এই দিন আস্থাভোটের পক্ষেই রায় দেয় শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম ধাক্কার পর উদ্ধব সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই তড়িঘড়ি এই পদত্যাগ।

২০১৪-'১৯ মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ফড়নবিস। ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটের পর শিবসেনার সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ায় এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারের বিদ্রোহী ভাইপো অজিতের সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ফড়নবিস। অজিত হন উপমুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এনসিপি পরিষদীয় দলে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হয়ে ৮০ ঘণ্টার মধ্যেই ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাঁকে। নতুন করে এই রাজ্যে ফড়নবিসের অভিষেক ঘটানোই কি বিজেপির কাছে বড় চ‍্যালেঞ্জ ছিল? সেই কাজে বিজেপির তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করেছেন একনাথ। কার্যত তাঁকে ব্যবহার করেই বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে। তাই বিজেপি তাঁকে পুরস্কার দেবে না, তা হয় না কি!

More Articles