মুকুল-রাজীব না কি...? দেবাংশুর চোখে 'ড্রেনের জল' আজ কারা?


মুকুল রায় থেকে রাজীব বন্দ‍্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্ত থেকে বাবুল সুপ্রিয়- শেষ পর্যন্ত এঁদের প্রত্যেককেই 'ড্রেনের জল' বানিয়ে ছাড়লেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য? এখানেই থেমে থাকলেন না তিনি৷ তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে এবার দু'ভাগে ভাগও করে দিয়েছেন৷ তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ১১ বছর পূর্তির আগে এবং বিগত নির্বাচনে বিপুল জয়ের এক বছর পূর্তির ঠিক আগের দিন, ১ মে তিনি একটি ফেসবুক পোস্টে দলকে দু'ভাগে ভাগ করে প্রথম ভাগকে তিনি চিহ্নিত করেছেন 'নিষ্কলুষ ধান্দাবাজহীন' হিসেবে৷ বলেছেন, "গত বছর ঠিক আজকের দিন পর্যন্ত রাজ্যে যে তৃণমূলটা ছিল, সেটাই নিষ্কলুষ। ধান্দাবাজহীন, অকৃত্রিম, প্রকৃত তৃণমূল।" আর দ্বিতীয়ভাগকে বলেছেন, 'ড্রেনের জল'৷ তাঁর ভাষায়, "তারপর তো বন্যা এল! গঙ্গার জল, ড্রেনের জল সব মিলেমিশে একাকার! তবুও দলে একটা স্ট্রং ফিল্টার আছে বলেই বিশ্বাস। তারা পিছনের সারিতেই থাকবে, সেটাও বিশ্বাস করে দলের কর্মীরা।''

আর এই নিয়েই তৃণমূলের অন্দরে তুফান ছুটেছে৷ দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশ এই পোস্টের ভাষা নিয়ে চরম আপত্তি জানিয়েছেন৷ পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন৷ নির্দেশ অনুসারে ওই পোস্ট মুছে দেওয়া হলেও বিতর্ক থামেনি৷ বরং প্রশ্ন উঠেছে, দলের সঙ্গে থাকা রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এক তরুণ দল সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন কোন অধিকারে? ওই পোস্ট মুছে ফেলার সাফাই হিসেবে দেবাংশু বলেছেন, "শেষ পোস্টের অর্থ হয়তো ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনি। অকারণ বিতর্ক হচ্ছে। তাই পোস্ট ডিলিট করলাম।'' এবার প্রশ্ন উঠেছে, 'ঠিকঠাক' কী বোঝাতে চাইছেন তিনি? অন্য দলের কিছু নেতাকে তৃণমূলে অন্তর্ভুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন, তা পুরোপুরি ভুল? প্রকাশ্যে এমন কথা বলার এক্তিয়ার তৃণমূলের কোনও নেতা-কর্মীর থাকে কি? দলের একজন মুখপাত্রের মুখে এমন কথা উঠে আসার অর্থ, এসব দলেরই কথা৷ তৃণমূল কংগ্রেসের অনেকেই কি ঠিক এমনই ভাবছে ?

'মুখপাত্র' শব্দের অর্থ, যে ব্যক্তি কোনও বিভাগ, সংস্থা বা সংগঠন ইত্যাদির তরফে দায়িত্ব নিয়ে কোনও বক্তব্য পেশ করেন৷ মূলত তাঁর বক্তব্যকে সংস্থা বা সংগঠনের বক্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়াই রেওয়াজ৷ বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্যই ঝাঁকে ঝাঁকে 'মুখপাত্র' নিযুক্ত করে৷ হালের রাজনীতিতে এটাও একটা রেওয়াজ৷ কিন্তু সেই মুখপাত্রদের কেউ কেউ যদি বারংবার নিজের দলকেই গাড্ডায় ফেলে, দলীয় শীর্ষ মহলের গ্রহণ করা সিদ্ধান্তকেই কাঠগড়ায় তোলে, তাহলে ধরে নিতে হয়, এঁরা এই পদের উপযুক্ত নয় অথবা মুখপাত্র মনোনয়নে দল ভুল করেছে৷

আরও পড়ুন: শুভেন্দু থেকে রাজীব, ব্যর্থ সকলেই || স্রেফ দেবের চেষ্টায় কাটবে ঘাটালের দুর্দশা?

রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের অগণিত মুখপাত্র রয়েছেন, তাঁদেরই একজন দেবাংশু ভট্টাচার্য৷ দল ক্ষমতায় আসার পরবর্তী সময়ের প্রোডাক্ট ইনি৷ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা একেবারেই শূন্য বলা যায়৷ কথা বলা আর ব্যবহারিক রাজনীতির মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক রয়েছে৷ দলের মনে হয়েছে, তিনি কথা বলতে পারেন, তাই হয়তো দল তাঁকে 'মুখপাত্র' করেছে৷ কিন্তু দলীয় একজন মুখপাত্র কী বলতে পারেন, কতখানি বলতে পারেন এবং কোন কথা একেবারেই বলতে পারেন না- সেই বিষয়ে কি নির্ধারিত রূপরেখা নেই তৃণমূল কংগ্রেসে? অল্প বয়স, তাই কথাবার্তায় সম্ভবত এখনও ব্যক্তিগত আবেগ অতিক্রম করতে পারেননি তিনি। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দলীয় এই মুখপাত্র আবেগতাড়িত হয়ে প্রায়শই এমন কিছু কথা বলে ফেলেন, যা দলকে যথেষ্টই বিব্রত করে, অস্বস্তিতেও পড়তে হয় দলকে৷ রবিবারও ঠিক সেই কাজটাই করেছেন দেবাংশু৷ যদিও শেষ পর্যন্ত ওই বিতর্কিত পোস্ট মুছে দিতে বাধ্য হন তিনি৷ ধরে নেওয়া যায়, দলের কোনও মহল থেকে ধমক খেয়েই ওই পোস্ট তিনি সরিয়েছেন৷ তবে পোস্ট মুছলেও তা নিয়ে দলের অন্দরেই জারি রয়েছে প্রবল বিতর্ক৷

নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেবাংশুর এমন বেলাগাম পোস্ট কিন্তু এবারই প্রথম নয়৷ এর আগেও একাধিকবার এই একই কাজ তিনি করেছেন৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজের ফেসবুক পোস্টে দেবাংশু লেখেন, "ব্যক্তিগত স্বার্থে কিছু মানুষ ভোটে অশান্তি করেন। তাই লোকাল বডির ভোটগুলোতে অশান্তি বেশি হয়। পুলিশকে ১০০% 'ফ্রি হ্যান্ড' দিতে হবে। প্রয়োজনে বিধানসভার দ্বিগুণ সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হোক। আরেকবার '২০১৮' হলে, আরেকটা '২০১৯' কিন্তু সময়ের অপেক্ষা। বারবার সবটা '২০২১' এর মতন হবে না। আর হাত জোড়া করে বাড়ি বাড়ি ঘুরলেও, কিন্তু মানুষ ক্ষমা করবেন না। যারা অশান্তি করে, ভবিষ্যতে তারা অনায়াসে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সেটিং করে নিতে পারবে। তখন মার খেতে হবে কর্মীদের। মরতে হবে সাধারণ সদস্যদের। কিছু স্বার্থান্বেষী বদমায়েশের জন্য দলের মুখে কালি লাগতে দেবেন না, একজন অতি সাধারণ কর্মী হিসেবে অনুরোধ রইল।"

তৃণমূলের এই মুখপাত্র ঠিক কার উদ্দেশে এই 'সাবধানবাণী' শুনিয়েছিলেন, তা অবশ্য পোস্টে খোলসা করেননি তিনি। কিন্তু ওই পোস্ট নিয়েও দলের অন্দরে জলঘোলা হতে বেশি সময় লাগেনি৷ চর্চা হয় পোস্টের বিশেষ একটি লাইন নিয়ে৷ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, "আরেকবার '২০১৮' হলে, আরেকটা '২০১৯' কিন্তু সময়ের অপেক্ষা।" এই লাইন ঘিরেই বিতর্ক হয় তখন৷ এর কারণ, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট লুঠের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। প্রায় ৩৪ শতাংশ পঞ্চায়েত বিনা ভোটেই চলে যায় শাসক দলের হাতে। পরের বছর, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জোর ধাক্কা খায় তৃণমূল। রাজ্যের মোট ৪২টি আসনের মধ্যে ২২টি জেতে শাসক শিবির। উত্তরবঙ্গ থেকে একটিও আসন পায়নি তৃণমূল। বিজেপি পায় ১৮টি আসন৷ তৃণমূলের অন্দরের বক্তব্য, দেবাংশু আসলে লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরেই দলকে সতর্ক করেছিলেন "আরেকটা '২০১৯' কিন্তু সময়ের অপেক্ষা" বলে৷ দলের এক মুখপাত্রের এই বক্তব্য দলকে সেদিন যথেষ্টই অস্বস্তিতে ফেলে৷

এরপর বিধানসভা ভোটের আগে ঘাসফুল ত্যাগ করে পদ্মে যাওয়া নেতাদের ফের তৃণমূলে ফিরে আসা আটকাতে এই মুখপাত্র ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন, "গদ্দারেরা ফিরলে আমি তৃণমূল ভবনের সামনে শুয়ে থাকব।"

ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় অনেক দলবদলু নেতা-ই গুটি গুটি পায়ে তৃণমূলে ফিরতে শুরু করেছেন। দেবাংশু যাদের দলে ফেরা রুখতে 'দরজা আটকে শুয়ে থাকবেন' বলেছিলেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব একে একে তাঁদেরই বরণ করে নিচ্ছেন তৃণমূলে৷

মুকুল রায় থেকে রাজীব বন্দোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্ত থেকে বাবুল সুপ্রিয়, যাঁরা এক সময়ে তৃণমূল তথা তৃণমূল সুপ্রিমো সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা বলতেই বাকি রাখেননি, তাঁরাই দলে দলে তৃণমূলে আসছেন৷ দেবাংশুর আর দরজা আটকে বসে থাকাও হয়নি৷ মুখপাত্র-র এই ধরনের কথায় 'ভুল বার্তা' গিয়েছিল বলে দলের নেতাদের একাংশ মন্তব্যও করেছিলেন৷ নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে ফেসবুকে পরে দেবাংশু লিখেছিলেন, "সেই সময় দাঁড়িয়ে কর্মীদের উৎসাহ দেখে একথা বলাটা প্রয়োজন ছিল এবং বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম।"

যে কোনও কাজের পিছনেই একটা না একটা যু্ক্তি থাকে৷ অপকর্মের পিছনেও থাকে৷ দেবাংশু একের পর এক বিতর্কিত পোস্ট করছেন, তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ছে দল৷ প্রতিবার কড়া মনোভাব প্রদর্শন করছে দল, সাফাই দিচ্ছে দেবাংশু, তৃণমূলের মতো দেশের অন্যতম শক্তিশালী দলের অন্দরে এমন কার্যকলাপ অনেকের কাছেই অস্বস্তির কারণ৷ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সঠিক মনে করেছেন বলেই মুকুল রায়, রাজীব বন্দ‍্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্ত, বাবুল সুপ্রিয়দের দলে এনেছেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন বলে মত রেখেছেন অনেকে৷ দলীয় নেতৃত্বের সহমতের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত৷ সেখানে এই নেতাদের 'ড্রেনের জল' বলার অর্থ, দলীয় সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা৷ এটা না বোঝার মতো বুদ্ধিহীন দেবাংশু নন৷ তাহলে কেন একথা তিনি বলেছেন?

এটা ঠিক, তাঁর এসব কথায় দলের কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবে আবেগতাড়িত হয়ে দলের শীর্ষ মহলকে নিশানা করার এই কাজ বারংবার চালিয়ে গেলে দলের বাঁধুনি, সুবিন্যাস, শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷

 

More Articles