টাটা থেকে দেবী শেট্টি, বাংলা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কী ভাবনা?

বাংলার বিশ্ব বাণিজ্য শীর্ষসম্মেলন ২০২২-র  প্রথম দিনেই মোট বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এমনটাই জানিয়েছেন। সমাপ্তি ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন সর্বমোট ১৩৭ টি সমঝোতা স্মারক এবং লেটারস্‌ অব ইন্টেন্টে সই করা হয়েছে বিনিয়োগের জন্য। এতে ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলেই মনে করছে সরকার। তাঁর ব্লু প্রিন্ট অনুসারে, মুখ্যসচিবের নির্দেশনায় একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হবে, যারা বিশেষভাবে এই বিনিয়োগ গুলি দ্রুত সুষ্ঠু ব্যবহারের ব্যবস্থা করবে। চাষাবাদ, এমএসএমই, রপ্তানি, সার্ভিস সেক্টর এবং পর্যটনের সেক্টোরাল কমিটি গঠিত হয়েছে সম্মেলনে। এই কমিটি গুলি শিল্পপতিদের নিয়ে মাসে একবার সভা করবে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই কমিটগুলিই ঠিক করবে নতুন নিয়মনীতি কী হবে, কীভাবে আরো বেশি কর্মসংস্থান করা সম্ভব, আরো বেশি বিনিয়োগ বাংলায় আনা সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা করবে। এই শীর্ষ সম্মেলনে ৪২টি দেশ থেকে ৪৩০০ জন অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। আগামী সম্মেলনের ২০২৩-এর ১ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হবে বলেই সরকারি ঘোষণা।

গত বুধবার আদানি গ্রুপ বাংলায় ১০০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামী দশ বছরে এই বিনিয়োগ খেপে খেপে হবে বলে জানিয়েছেন আদানি গ্রুপের প্রধান গৌতম আদানি। শীর্শসম্মেলনের প্রারম্ভিক সেশনে আদানি জানান, বিশ্বমানের বন্দরের পরিকাঠামো গড়ে তোলা, ডেটা সেন্টার, সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে কেবলের মধ্যে দিয়ে যা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, ডিগিটাল ইনোভেশনের কেন্দ্র, ওয়েরহাউস এবং লজিস্টিক্স পার্ক—এই সমস্ত খাতে ঐ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ কাজে লাগানো হবে। হলদিয়ায় আদানির একটি ভোজ্য তেলের কারখানা রয়েছে। তাজপুরের গভীর সমুদ্র বন্দরের সর্বোচ্চ দরদাতা এ পর্যন্ত আদানিই। কিন্তু রাজ্য এখনও আদানিকে তাজপুর দেয়নি। আদানি জানান, “আদানি গ্রুপের শীর্ষকর্তাদের পশ্চিমবঙ্গে আনব। পরিকাঠামো ও কর্মচালনায় আমাদের দক্ষতা এবং আমাদের অভিজ্ঞতা আমরা ভাগ করে নিতে চাইছি। যে মানের প্রযুক্তি আমরা আনতে চাইছি, তাতে পশ্চিমবঙ্গের পরিকাঠামোও উন্নত হয়ে উঠবে।”

তিনি দাবি করেন, এই বিনিয়োগের ফলে ২৫০০০ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হবে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা সরকারের ‘উৎকর্ষ বাংলা’ বা ‘সবুজ সাথী’র মতো প্রকল্পগুলির অত্যন্ত প্রশংসা করেন আদানি। এই এত কাজের জন্যেই মমতার জনপ্রিয়তা জাওও অক্ষুণ্ণ, মানুষ এখনও তাঁকে ভরসা করে বিশ্বাস করে—মত আদানির।

জেএসডব্লিউ-এর চেয়ারম্যান এমন কোনও অঙ্কের প্রতিশ্রুতি দেননি। তবে ৯০০ মেগা ওয়াটের বিরাট একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। এই মাপের পরিকল্পনা অন্তত সাত-সাড়ে সাত হাজার কোটির বিনিয়োগ পেতে পারে বলেই আশা করা হচ্ছে।

অন্য দিকে হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের এম ডি সঞ্জীব মেহ্‌রা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কার্যকলাপ একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে দিনের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের নিয়মনীতি বদল করতে তাঁরা সক্ষম,। এতেই প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের স্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।” তিনি আরোও বলেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সেই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার সাহস ও ক্ষমতা রয়েছে। বাংলায় বর্তমানে হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের চারটি ফ্যাক্টরি রয়েছে। এবং এমএনসি ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচার ও বাজারে বিনিয়োগ চালু রাখবে।

টাটা স্টিলের এম ডি এবং সিইও টিভি নরেন্দ্রন মমতার প্রশংসা করেন, সরকারের প্রশংসা করেন এবং ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। সিআইআইকে ন্যাশনাল পার্টনার রূপে আমন্ত্রিত করার জন্য এবং বিনিয়োগ শীর্ষসম্মেলনের জন্য তিনি রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আরো বলেন, টিসিএস এবং টাটার হোটেল শাখাটি বাংলায় আরো বাণিজ্যবিস্তার করবে। হীরানন্দিনী গ্রুপের প্রধান নিরঞ্জন হীরানন্দিনী ১৫০০ কোটির বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন তথ্যকেন্দ্র ও ইন্দাস্ট্রিয়াল লজিস্টিক পার্কের জন্য। “কোভিড মহামারীর সময় দেশের অর্থনৈতিক হাল যখন বিপর্যস্ত, সে সময় পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি দেখে আমি চমকিত”, জানান তিনি। উইপ্রোর চেয়ারম্যান ঋষদ প্রেমজী বলেন, কোম্পানি দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রোজেক্ট শুরু হবে, এবং তাতে কয়েকশো কোটি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।

আরও পড়ুন-আদানির হাত ধরে বাংলায় শিল্প-কর্মসংস্থান আদৌ সম্ভব?

ডঃ দেবীপ্রসাদ শেট্টি শহর কলকাতায় একটি হাজার বেডের হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। এতে থাকবে চিকিৎসা, সার্জারি, অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং অন্যান্য সুবিধা ইত্যাদি নানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। মমতার উপরে ভরসা তাঁর বরাবর অর‍্যেছে বলেই জানান দেবী শেট্টি। নারায়ণ হেলথ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান শেট্টি জানান, হাসপাতালটিতে অঙ্কোলজি সার্জারি এবং অর্থোপেডিক অপারেশনের সুবিধাও থাকবে। দু থেকে তিন বছরের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবেন তিনি। সরকারকে তিনি আরো নার্সিং কলেজ খোলার পরামর্শ দেন। “আপনি বরাবরই নারী ক্ষমতায়ন চেয়ে এসেছেন আমরা জানি। আজ তার পরম সুযোগ। রাজ্যে হাজার খানেক নার্সিং কলেজ গড়ে তোলা হোক। প্রতি হাসপাতাল থেকে অন্তত ১০০ খানা বেড দানের অনুরোধ করা হোক। এতে নার্সিং কলেজ স্থাপনের সুবিধা হবে। মাত্র বছর চারেকের মধ্যে কয়েক হাজার উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার যথেষ্ট পরিমাণ রোজগার করতে শুরু করবে। আপনিই পারবেন, আর কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।”--মমতাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলেন শেট্টি।

More Articles