আদানির হাত ধরে বাংলায় শিল্প-কর্মসংস্থান আদৌ সম্ভব?

বৈশ্বিক বিনিয়োগের মানচিত্রে বাংলার অবস্থানকে আরও গৌরবান্বিত করে তুলে ধরতে বুধবার থেকে শুরু হয়ে গেল বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে এই অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থ-উপদেষ্টা অমিত মিত্র, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের উপস্থিতিতে দেশ-বিদেশের বড় বড় উদ্যোগপতিরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি জানালেন। বিদেশি প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪৯ জন ব্রিটেনের প্রতিনিধি রয়েছেন। অন্যদিকে, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন গৌতম আদানি, আজিম প্রেমজি, হর্ষ নেওটিয়া, সজ্জন জিন্দল এবং সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। তবে এই বাণিজ্য সম্মেলনের সবথেকে বড় লাইম লাইট এদিন থাকল সজ্জন জিন্দাল এবং গৌতম আদানির ওপরেই। সূত্রের খবর, সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে নাকি দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং গৌতম আদানি। তাই, গৌতম আদানির তরফ থেকে যে বাংলা নতুন করে বিনিয়োগ পেতে চলেছে, তা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর প্রত্যাশামতোই, এদিনের বাণিজ্য সম্মেলন থেকে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিলেন গৌতম আদানি।

চাকরি দেবেন আদানি

আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে গৌতম আদানির সংস্থা। এছাড়াও ২৫ হাজার কর্মসংস্থান হবে বলেও ঘোষণা আদানি গ্রুপের কর্ণধারের। কলকাতায় বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলার জন্য বিপুল প্রতিশ্রুতি দিলেন গৌতম আদানি। গোপালকৃষ্ণ গোখলে থেকে রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ হয়ে সরোজিনী নাইডু- সকলের নাম শোনা গেল তাঁর বক্তৃতায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের ভূমিকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেও ভোলেননি গৌতম আদানি। রাজ্যের মহিলা ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ টেনে রাজ্য সরকারের ভূয়সী প্রশংসা শোনা গেল তার মুখে। মমতার ক্যারিশমা এবং তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা রাখেন আদানি।

দিদি বলে সম্বোধন করে এদিনের বক্তৃতায় মমতাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন গৌতম আদানি। নারীর ক্ষমতায়নে মমতা কীভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তা বুঝিয়ে দিতে গৌতম আদানি বলেন, "আপনি সেই ঐতিহ্য সগৌরবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই রাজ্য একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আর আপনি সেই রাজ্যে শিল্প-সংস্কৃতি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। আপনার জনপ্রিয়তার কোনও তুলনা নেই। আপনার মধ্যে যে অসাধারণ ক্যারিশমা রয়েছে, তার কোনও তুলনা হবে না।"

আরও পড়ুন: আশ্বাসে কল্পতরু আদানি, বঙ্গ বিজেপির নৌকা টলোমলো?

মোদ্দা কথা হল, বাংলায় ব্যবসা করতে ইচ্ছুক আদানি গোষ্ঠী। সিঙ্গুরে টাটা প্রকল্প সফল না হলেও আদানি গোষ্ঠী বাংলাকে টার্গেট করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পের প্রতি অনীহা-র যে প্রতিচ্ছবি এতদিন পর্যন্ত বিরোধী গোষ্ঠীর তরফ থেকে তুলে ধরা হচ্ছিল, তাকেই পরিবর্তন করতে চাইছে রাজ্য সরকার, আর এই ব্যাপারে সহায় হচ্ছেন গৌতম আদানি। কিন্তু, এত বিনিয়োগ এবং এত কর্মসংস্থান কীভাবে করবেন তিনি? গৌতম আদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলায় অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে চলেছে তাঁর সংস্থা। এছাড়াও রাজ্যে ২৫ হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলেও তিনি দাবি রেখেছেন। কিন্তু কীভাবে হবে এই কর্মসংস্থান?

রাজ্যে কোন পদ্ধতিতে আদানি গোষ্ঠী এগোতে পারে, সেই নিয়ে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন গৌতম আদানি নিজেই। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকেই তিনি ঘোষণা করেছেন, বাংলায় একটি ডেটা সেন্টার তৈরি করতে চান তিনি। এছাড়াও সমুদ্রের নিচে কেবিল পাতার লক্ষ্য রয়েছে তাঁর। বেলুড়ের লজিস্টিক হাব, কিংবা ওয়্যারহাউজ, সবদিকেই বিনিয়োগের ইচ্ছা রয়েছে গৌতম আদানির। এছাড়াও, তাজপুর বন্দর প্রকল্প তো রয়েছেই। এখনও এই প্রকল্পটি গৌতম আদানির হাতে না এলেও, এই বন্দর প্রকল্পের নিলামে তিনিই অগ্রণী দাবিদার। তাই, তাজপুর বন্দর প্রকল্প গৌতম আদানির হাতে আসা কার্যত সময়ের অপেক্ষা। তার সঙ্গেই আবার রয়েছে সংস্থার আদানি উইলমার গ্রুপের ফরচুন সরষের তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা। এই উৎপাদন বৃদ্ধির সিংহভাগটাই যে তিনি বাংলা থেকে করতে চান, সেটাও ধারে-ভারে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন গৌতম আদানি।

আম্বানি কেন নেই?

আদানি, জিন্দাল, প্রেমজি উপস্থিত থাকলেও, মমতার বাণিজ্য সম্মেলনে আম্বানির অনুপস্থিতি ছিল এই সম্মেলনে আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু। শিল্পমহলের বিশিষ্টদের আলোচনাতেও উঠে এল মুকেশ আম্বানির নাম। এর আগে এই শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে তাঁকে দেখা গিয়েছিল বারকয়েক। তাহলে কি এবারে আদানি আসবেন বলেই সরে এলেন মুকেশ আম্বানি?

আসল কারণ না জানা গেলেও, এই মুহূর্তে সম্পদের দিক থেকে হোক কিংবা বার্ষিক ব্যবসার অঙ্ক, সব দিকেই আদানি গোষ্ঠী কিন্তু রিলায়েন্স গোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী। তার সঙ্গেই, বন্দর থেকে শুরু করে জাতীয় সড়ক, বহু জায়গাতেই আদানির ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে বাংলা। বিভিন্ন মেগা পরিকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলতে তারা যে পরিমাণ অর্থ লগ্নি এবং বিনিয়োগ করে থাকে, সেই তুলনায় ১০ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা লগ্নি খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। এই কারণের জন্যই কি, প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিতে গররাজি মুকেশ আম্বানি?

আরও পড়ুন: মমতার স্বপ্নের তাজপুর বন্দর কি আদানির হাতে? আদৌ লাভ হবে রাজ্যের?

আদানির 'হোমওয়ার্ক' 

শিল্প সম্মেলনের এদিনের অনুষ্ঠানে লাইমলাইট ছিল গৌতম আদানির দিকেই। একদিকে তাঁর হাতে যেমন রয়েছে তাজপুর বন্দর প্রকল্প, তেমনই কিন্তু হলদিয়া বন্দরের উন্নতিকল্পেও তাঁর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। তাই পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে ছিল ইঙ্গিতবাহী। আর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তিনি যেভাবে হোমওয়ার্ক করে এলেন, তাতে বলাই বাহুল্য, বাংলার শিল্প মানচিত্রে তিনি নিজের নাম লেখাতে চাইছেন স্পষ্টতই। দীর্ঘমেয়াদে কি আরও বিভিন্ন প্রকল্পে তিনি বিনিয়োগ করতে পারেন? এই প্রশ্নটা উঠল আদানির বক্তৃতার সঙ্গেই। রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধীদের একাংশ অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতাই তাঁর সাফল্যের মূল কারণ। একসময় তৃণমূলের তরফ থেকেও এই নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কিন্তু এই সমস্ত অভিযোগকে কার্যত এক লহমায় উড়িয়ে দিলেন গৌতম আদানি।

এদিনের শিল্প সম্মেলনে আদানি ঘোষণা করলেন, "পরিকাঠামোর বিপুল অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। কথা দিচ্ছি, প্রযুক্তি-দক্ষতা এবং মানুষের আশা পূরণের চেষ্টা করব। বিপুল কর্মসংস্থান হবে বাংলায়। বিনিয়োগ হবে বিপুল পরিমাণে।" মুখ্যমন্ত্রীও আদানিকে দিলেন যোগ্য সম্মান। তিনি বললেন, "গৌতম আদানি প্রথমবার এসেছেন। আপনার আগ্রহ আমাদের উৎসাহ বাড়াবে।" তাজপুর বন্দর প্রসঙ্গে মমতা বললেন, "তাজপুর সমুদ্র বন্দরের সব প্রস্তুত। অপেক্ষায় রয়েছি এই প্রকল্প শুরু হবার।" গৌতম আদানি যে তাজপুর বন্দর প্রকল্প পেতে পারেন, তা মমতার কথায় কার্যত স্পষ্ট।

বাংলায় বিনিয়োগে আদানি

বছর কয়েক ধরে পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বাংলায় গৌতম আদানির বিনিয়োগের অঙ্ক বাড়ছে। ফরচুন সরষের তেল, বর্ধমান চাল কল, এবং লজিস্টিক হাবে ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করছেন গৌতম আদানি। এছাড়াও তাজপুর সমুদ্র বন্দর তৈরি করতেও আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্যের জাতীয় সড়কের একটি অংশ সম্প্রসারণের কাজের বরাত রয়েছে তাঁর হাতে। তাই, এদিনের বৈঠক থেকে রাজ্য সরকারকে কোনওভাবেই অসন্তুষ্ট করতে চাইলেন না তিনি।

আদানি একা নন

তবে শুধুমাত্র গৌতম আদানি একা নন, এদিনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে বাংলা বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন মঞ্চে উপস্থিত অন্যান্য শিল্পপতিরাও। জিন্দাল গোষ্ঠীর কর্ণধার সজ্জন জিন্দালের কথায়, "এ রাজ্য সোনার পাখি।" অন্যদিকে, রমাপ্রসাদ সঞ্জীব গোয়েঙ্কা (RPSG) গ্রুপের কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বলছেন, "গত এক দশকে অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। তার একমাত্র কারণ বলিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসন।" উইপ্রো কর্ণধার রিশাদ প্রেমজি বলছেন, "সামাজিক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ ইতিবাচক প্রতিফলন রাখছে।" টাটা স্টিলের টিভি নরেন্দ্রনের বক্তব্য, "খড়গপুরে কারখানা সম্প্রসারণ হচ্ছে, আরও হবে।" আইটিসি গ্রুপের সঞ্জীব পুরি বলছেন, "স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে রাজ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। পর্যটনে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।" প্রশংসা শোনা গিয়েছে হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের কর্ণধার সঞ্জীব মেহতার মুখেও। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে তাতে বিনিয়োগ করতে চান বলেও ঘোষণা করেছেন পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। শিল্পপতি নিরঞ্জন হিরানন্দানি বলছেন, "এই শহর বিনিয়োগের শহর।"

মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা

এদিনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে শিল্পপতিদের প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষি এবং শিল্পকে দুই বোন বলে উল্লেখ করে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, দু'টির উন্নতিকল্পেই তাঁদের লক্ষ্য রয়েছে। পরিকাঠামো থেকে কৃষি, সবকিছুতেই আগ্রহ দেখিয়েছেন গৌতম আদানি। তাই তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা তো জানাতেই হত। অন্যান্যরাও বাদ পড়লেন না। এদিনের সম্মেলনে উপস্থিত সকল শিল্পপতিদের উদ্দেশেই বাংলায় বিনিয়োগের বার্তা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার তৃতীয় ইনিংসের শুরুতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এবারে শুধুমাত্র কৃষি কিংবা ভাল প্রশাসনের দিক থেকে নয়, শিল্পের দিক থেকেও পশ্চিমবঙ্গকে সমৃদ্ধ করবেন তিনি। এদিনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে সেই লক্ষ্যেই পথ চলা শুরু করল বাংলা।

লগ্নি বাস্তবায়নের ইতিহাস সুমধুর নয়

বুধবার থেকে রাজ্যের ষষ্ঠ বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন শুরু হলেও বিনিয়োগের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। গত পাঁচটি বাণিজ্য সম্মেলনে কতগুলি বিনিয়োগের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়েছে? বাংলায় যেখানে অন্য রাজ্য থেকে মজুরি কম, সেখানেও ব্যবসায়ীরা কেন ব্যবসা করতে আসেন না? এই প্রদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষকে কেন ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে যেতে হয়? সর্বোপরি, বাংলায় ব্যবসার পরিকাঠামো কতটা উন্নত? সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন রইল মমতার কাছে।

পশ্চিমবঙ্গে যতই বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু পরিকাঠামোগত খামতি রয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ হওয়ার সমস্যা এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তার পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের কিছু অসুবিধা রয়েছে। সেই বিষয়গুলো সমাধান করা আগে প্রয়োজন। আগের পাঁচটি বাণিজ্য সম্মেলনে ১২ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা হলেও, এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম থেকেই শিল্পের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গিয়েছে। কোনও বড় সমাধান না এলে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের পরিস্থিতি তৈরি করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। শিল্পপতিদের কোনওভাবেই আবেগের মাধ্যমে টেনে আনা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মজুরদের মানসিকতা এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকা, সবকিছুই এক্ষেত্রে কাজে লাগে।

সমাধান কোন পথে?

তৃতীয় দফায় রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাখির চোখ ছিল শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের ওপর। তবে কোনওভাবেই বাংলায় ব্যবসা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তাই এবারের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন থেকে শুধুমাত্র এক 'জানালা ব্যবস্থা' কিংবা লগ্নিবান্ধব পরিবেশ নয়, তিনি বাজি রাখলেন সম্প্রীতি, সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং কল্যাণ প্রকল্পের ওপরেও। দাবি রাখলেন, এখন ধর্মঘটের জন্য পশ্চিমবঙ্গে কর্ম দিবস নষ্ট হয় না। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা নিয়েও প্রশংসা শোনা গেল তাঁর মুখে। বিনিয়োগকারীদের সমস্ত ধরনের সহযোগিতায় প্রস্তুত রাজ্য সরকার।

কিন্তু, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ টানা মোটেও সহজ কাজ নয়। জমি-জট, সিন্ডিকেট সমস্যা, সবকিছু নিয়েই চাপে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিনের উদ্বোধনী মঞ্চে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় মন্তব্য করেছিলেন, বিনিয়োগকারীরা চাইছেন রাজনৈতিক স্থিরতা, গণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছ প্রশাসন। তার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং আইনের শাসন প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছিলেন ধনকড়। তার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মমতার পাল্টা দাবি, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, তামিলনাড়ু কিংবা পাঞ্জাব- যাই-ই বলুন, বাংলায় থাকলে আপনি আমার পরিবারের মানুষ। আমাদের শিল্প যাত্রা শুরু হয়েছে, আপনার আস্থা, ভরসা এবং বিশ্বাস রাখুন। আরও সংযোজন, "ধর্মীয় একতা, মন্দির-মসজিদ, গুরুদুয়ার এবং গির্জা সব এক জায়গায় রয়েছে এই রাজ্যে। অমৃতসর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে ফ্রেট করিডোর। ২৪৮৩ একর জমি পুরুলিয়ায় বরাদ্দ হয়েছে শিল্প করার জন্য। জঙ্গলমহল সুন্দরী কর্মনগরী প্রকল্পে ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলা যুক্ত হতে চলেছে জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সঙ্গে। দেউচা পাঁচামি প্রকল্পে এক লক্ষ লোকের কাজ হওয়ার কথা রয়েছে। ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে এই প্রকল্পে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পে ২৮০০ সংস্থা কাজ করছে এই রাজ্যে। ডানকুনি-রঘুনাথপুর ডানকুনি-কল্যাণী এবং ডানকুনি-হলদিয়া শিল্প ফ্রেট করিডোর তৈরি হবে শীঘ্রই। স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় দিয়ে আবাসন শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ল্যান্ডিং স্টেশন, পর্যটন শিল্প- সবকিছুই রয়েছে বাংলায়। বাংলাকে শিল্পে এক নম্বর করে তোলার লক্ষ্য আমার। কর্মসংস্থান বাড়ুক। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সরকার সমস্তরকম সহযোগিতা করবে। যেরকম যা জমি প্রয়োজন, সব ব্যবস্থা করা হবে। বিদ্যুৎ পর্যাপ্ত রয়েছে। শিল্প প্রমোশন বোর্ড তৈরি হয়েছে শিল্পমহলের সুবিধার করার জন্য। শিল্প এবং কর্মসংস্থান আমার গন্তব্য।"

যদিও বিরোধীদের কথায়, প্রতিবারই বিপুল অঙ্কের লগ্নি আসার পরেও শেষে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও প্রকল্প দেখা যায় না। চাকরির ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা তথৈবচ। বিগত ১১ বছরে তেমন কোনও কারখানায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি প্রকল্প থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ উপকৃত হলেও, তাদেরকে চাকরি দিতে রাজ্য সরকার অপারগ। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের উন্নতি হবে কোন পথে? ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, যদি পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি সততই প্রয়োজন হয়, তাহলে রাজ্যকে সবকিছুর আগে নিজেদের জমির সমস্যার সমাধান করতে হবে। আটটি স্তম্ভের ওপর কোনও একটি রাজ্যের উন্নয়ন নির্ভর করে থাকে। পরিকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বাণিজ্য সরলীকরণ, মূলধন বিনিয়োগ, প্রশাসনিক সরলীকরণ, এবং ধর্মঘট-বিরোধী অবস্থান। এই সবক'টি বিষয়ে যদি পশ্চিমবঙ্গ সঠিকভাবে উন্নতি করতে পারে, তবেই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব। ধর্মঘটের সমস্যা হয়তো বাম আমল থেকে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেখানে বাম আমলে প্রতি বছর প্রচুর কর্মদিবস নষ্ট হত ধর্মঘটের কারণে, তা এখন অনেকটাই কমেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও রাজ্যের জিডিপি খুব একটা খারাপ অবস্থায় নেই। কিন্তু, বাকি সমস্ত দিক থেকে উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। জমি-জট, লাল ফিতের ফাঁস কাটিয়ে কড়া হাতে সিন্ডিকেটের মতো সমস্যা দমন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ টানা এতটা সহজ হবে না।

More Articles