পুতিনের সঙ্গে হিটলারের তুলনা? ঠিক কতটা সাদৃশ্য রয়েছে দুই নেতার সিদ্ধান্তে...

রাশিয়ার সর্বাধিনায়কের গালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন অ্যাডলফ হিটলার। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনের ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই ছবিটি টুইট করা হয়। টুইটের তলায় লেখা, ‘দিস ইজ নট অ্যা মিম, বাট আওয়ার অ্যান্ড ইওর রিয়েলিটি রাইট নাও’। এমন দাবি স্বভাবতই নেট দুনিয়ায় তীব্র সাড়া ফেলে দেয়। কিন্তু সত্যিই কি রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নাৎসি জার্মানির ফুয়েরারের তুলনা চলে?

যদি ইতিহাসের দিকে আমরা একবার ফিরে তাকাই তাহলে এই মিল খুঁজে পাওয়া কিন্তু খুব কাকতালীয় নয়। পুতিন এবং হিটলারের রণনীতির মিল অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। বর্তমানের  সেন্ট পিটার্সবার্গ তখনের লেনিনগ্রাদে পুতিনের জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ালেখার পর পুতিন যোগ দেন রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি তে। কেজিবি তে দীর্ঘদিন কাজ করার সূত্রে ইউরোপের কূটনীতির হাল-হকিকত প্রথম থেকেই পুতিনের নখদর্পণে। কোন কাজের ফল কেমন হতে পারে তা বিলক্ষণ জানেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট।

ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে পুতিনের যে যুক্তি ছিল তা থেকে হুবহু মনে পড়ে যায় ১৯৩৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তিকরণের আগে হিটলারের বক্তব্য। সেদিন জনসমক্ষে হিটলার দাবি করেছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান ভাষাভাষী নাগরিকরা স্বাধীনতা চায়। সেই দায়িত্ব থেকেই হিটলার আক্রমণের পথে হেঁটেছিলেন। প্রায় একই স্বর উঠে আসে ইউক্রেন আক্রমণ প্রসঙ্গে পুতিনের গলায়। গত সপ্তাহের গোড়ার দিকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট জানিয়েছিলেন ইউক্রেনের একটা অংশে দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার একাংশ নাগরিক অপমান ও যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন। তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব নিতেই তিনি ইউক্রেন আক্রমণের রাস্তায় হেঁটেছেন। কিন্তু পুতিনের এই যে দাবি তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং রাশিয়ার জনগণকে নিজের বীরত্ব দেখানোর কারসাজি মাত্র তা একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রমাণিত। অতীতে ডনবাস আক্রমণের সময়ে ও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট একাধিক ভুয়ো তথ্য সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। ডনবাসের একটি সমাধি ক্ষেত্রে সারি সারি কবর দেখিয়ে রাশিয়ার প্রশাসন দাবি করেছিল কীভাবে সেখানে রাশিয়ান নাগরিকদের গনহত্যা করা হয়েছে। পরে ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে দেখা যায় আসলে এই সমাধিগুলি বহু পুরোনো। এর সঙ্গে ডনবাসের কোনও সম্পর্ক নেই। এই ক্ষেত্রে হিটলারের ফেক প্রোপাগান্ডার সঙ্গে মিলে যায় পুতিনের ভাষ্য।

আবার পুতিনের ক্ষমতায় আসার সময় থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের অন্যান্য দেশের সম্পর্ক খুব সুখের ছিল না। পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে পুতিনের নেতৃত্বেই রাশিয়া প্রথমবারের মত জি-এইট সন্মেলনের আয়োজন করে। এর মধ্যে দিয়েই রাশিয়ার সেই জোটে অন্তর্ভুক্তিকরণ ঘটে।

২০০৮ সালে সাউথ ওশেটিয়া অঞ্চলে নিজেদের অধিকার প্রতিস্থাপনে জর্জিয়া আক্রমণ করে রাশিয়া। সেই সময় প্রবল নিন্দার মুখে পড়তে হয় রাশিয়ান প্রেসিডেন্টকে। কিন্তু হুমকির মুখে পিছু হটার লোক নন পুতিন। আবার ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অধিকারে আনার জন্য পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ করেন পুতিন। পুতিনের এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের প্রতিবাদ স্বরুপ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকা রাশিয়ার সঙ্গে যাবতীয় বানিজ্যের অবসান ঘটায়। জি- এইট থেকেও অপসারিত হয় রাশিয়া।

বর্তমানে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রসঙ্গে ও পশ্চিমী দুনিয়ার পুতিনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসের পথ অনুসরণ করলে প্রশ্ন ওঠে ১৯৩৯ এ পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে যে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন হিটলার সেই পথেই কি পা বাড়াচ্ছেন পুতিন? রাশিয়ার আশে পাশে একের পর এক দেশে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে কি ইউরোপকেই যুদ্ধের বার্তা দিচ্ছেন পুতিন? লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বিপন্ন করে একটি দেশের ওপর নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চালিয়ে নিজের ফ্যাসিস্ট রূপটিকেই বিশ্বের দরবারে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

এর পরিণাম কী? এই যে সর্বগ্রাসী রণনীতি, কথায় কথায় পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি -র পিছনে যেন ৩০-৪০ এর দশকের হিটলারকে খুঁজে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে কি এত সহজেই থামবেন পুতিন? নাকি এরপর সরাসরি ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের দিকে এগোবে তার সাম্রাজ্যবাদের রথ! উত্তর দেবে সময়।

More Articles