নন্দীগ্রাম থেকে রামপুরহাট-ফিরে দেখা গণহত্যার বাংলা

রাজনৈতিক হিংসার বলি রামপুরহাটের বগতুই গ্রাম। ঘুমের মধ্যে ১০ জন মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলল কারা? এই নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই চলছে বিতর্ক। থেমে থাকেনি বিরোধীরাও। ঘটনার উপযুক্ত বিচার চেয়ে পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে তাঁরা। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গোটা ঘটনার রিপোর্ট তলব করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু রাজনৈতিক গণহত্যার ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। শেষ দু'দশকের বেশি সময় ধরেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বলি সাধারণ মানুষ থেকে পার্টি কর্মী। ফিরে দেখা এমনই কিছু নৃশংস রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাসকে-

নানুর- সুচপুর হত্যাকাণ্ড

২০০০ সালের ২৭ জুলাই বীরভূম জেলার নানুর ব্লকের সুচপুর গ্রামে একটি চারবিঘা জমির প্লট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় সিপিএম এবং তৃণমূলের মধ্যে। নানুরে মূলত ভূমিহীন, উপজাতি, মুসলিমদের বসবাস। সেখানেই তৃণমূল সমর্থক কয়েকজন ভাগচাষী সিপিএমের বিরোধিতা করলে তৎকালীন সিপিএমের দুই নেতা মনিরুজ্জামান এবং নিত্য নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিপিএম ক্যাডাররা ১১ জন তৃণমূল সমর্থিত ভাগচাষীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। সেই ১১ জন গণহত্যার শহিদের নাম শেখ নিজাম, রাসুল বক্স, শেখ বাবুর, শেখ সালামত, শেখ হারাই, সরণ মেটে, শেখ সফিকুল, শেখ শফিক, শেখ আসরাফ, শেখ সাইফুর এবং শেখ আলি হোসেন। তখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা নিহত গ্রামবাসীদের ‘ডাকাত’ এবং দুষ্কৃতী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সিপিএম-এর এই নৃশংস হত্যালীলার পর থেকেই নানুরে নিজেদের রাজনৈতিক জমি শক্ত করতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস।

ছোট আঙারিয়া হত্যাকাণ্ড

২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার ছোট আঙারিয়া গ্রাম উঠে এসেছিল সংবাদ শিরোনামে। নেপথ্যে রাজনৈতিক হত্যা। তখন ধীরে ধীরে জঙ্গলমহলে নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করছে তৃণমূল। ৪ জানুয়ারি তৃণমূল কর্মী বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে এক গোপন সাংগঠনিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। খবর পেয়ে সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা সুশান্ত ঘোষের নির্দেশে সেই বৈঠকের ওপর চড়াও হয় সিপিএম ক্যাডাররা। এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিপিএম কর্মী তপন ও সুকুর আলি। ১১ জন তৃণমূল কর্মীকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। পরে সেই তৃণমূল কর্মীদের কঙ্কাল উদ্ধার হয় ঘটনাস্থল থেকে। কোনোভাবে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন বক্তার মণ্ডল। পরবর্তীকালে তাঁর দেওয়া জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই মূল অভিযুক্ত তপন ও সুকুর কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনার ও নেপথ্যে ছিল তৃণমূল- সিপিএমের রাজনৈতিক জমি দখলের বিবাদ।

নন্দীগ্রাম গণহত্যা

২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এক ঐতিহাসিক দিন। সালেমের কেমিক্যাল হাব এবং জমিগ্রহণ নিয়ে তখন এমনিই উত্তপ্ত নন্দীগ্রাম। মূল ঘটনার সূত্রপাত ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ওইদিন লক্ষ্মণ শেঠের নিয়ন্ত্রণাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের তরফ থেকে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি নোটিশ জারি করা হয়। তার কিছুকাল আগেই ঘটে গিয়েছে সিঙ্গুর। ফলে নন্দীগ্রামে ও জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা শুরু হয়। নন্দীগ্রামে সিপিএম এবং পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ চলতেই থাকে। ১৩ মার্চ তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে জানান গ্রামে সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাস ছড়াচ্ছে পুলিশ। আর তারপর দিনই ঘটে সেই রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড। প্রশাসনের তরফে জানানো হয় কাটা রাস্তা মেরামত করতে পুলিশ গেলে বিরোধী ও ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা তাদের বাধা দেন। দু'দিক দিয়ে গ্রামে ঢুকতে চেষ্টা করে পুলিশ। সেখানেই পুলিশ এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের দাবি ছিল বারবার মাইকিং করা সত্ত্বে ও রাস্তা ছাড়েনি গ্রামবাসীরা। এরপরই সেখানে কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেটের পর গুলি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় ১৪ জনের। বিরোধীরা দাবি করেন ওইসময় ধর্ষিত হয়েছেন বহু মহিলা। কিন্তু কার নির্দেশে গুলি চলেছিল তা নিয়ে শুরু হয় ধন্দ। আঙুল ওঠে সরকারের প্রধান তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দিকে। পরবর্তীকালে সিবিআই নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনায় বুদ্ধদেব কে ক্লিনচিট দেয়। এই ঘটনাই রাজ্যরাজনীতিতে তৃণমূলের জমিকে আরও শক্ত করে দেয়।

নন্দীগ্রাম অপারেশন সূর্যোদয়

১৪ মার্চের পর থেকে অল্প অল্প করে নন্দীগ্রামে জমি হারাতে শুরু করে সিপিএম। অবশেষে ২০০৭ সালেরই ১০ ই নভেম্বর নন্দীগ্রাম পুনর্দখল করে সিপিএমের ক্যাডার বাহিনী। সিপিএমের ভাষায় এটাই অপারেশন সূর্যোদয়। ১১ নভেম্বর সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘ নন্দীগ্রাম সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে।নতুন সূর্যোদয় হয়েছে নন্দীগ্রামে’। এই ঘটনায় তোলপাড় হয় রাজ্য রাজনীতি। অপারেশন সূর্যোদয়ের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন কে খুন করা হয়। নিখোঁজ হন বহু মানুষ। এই ঘটনার দুদিন পর মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন’। এই ঘটনা প্রশ্ন তোলে খোদ সরকারের প্রধান কি রাজনৈতিক হিংসায় মান্যতা দিয়েছিলেন সেদিন? বুদ্ধবাবুর এই বক্তব্যের পরই গোটা রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানি বৃদ্ধি পায়।

নেতাই গণহত্যা

মায়ের মৃতদেহ জড়িয়ে বসে কাঁদছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়ে। এই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়েছিল। ছবির আকুতি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা রাজ্যকে। ২০১১ সালের ৭  জানুয়ারী নেতাই গ্রামের সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়িতে সিপিএম-এর শিবির বসেছিল। এই বাড়ি থেকেই তখন নিয়ন্ত্রিত হত গোটা নেতাই গ্রাম। ৭ জানুয়ারির কয়েকদিন আগে এই বাড়ি থেকেই গ্রামের মানুষদের কাছে নির্দেশ যায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ছেলেদের অস্ত্রচালনা শিখতে হবে। গ্রামবাসীরা এই নির্দেশ অস্বীকার করে ৭ জানুয়ারি দল বেঁধে রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির সামনে জমায়েত হয়। এরপরই রথীনের বাড়ি থেকে জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর ওপর গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে প্রায় ৪০ রাউন্ড গুলি চলেছিল সেদিন। প্রথমেই গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পরেন সরস্বতী ঘড়াই ও ফুলমনি মাইতি। এই সরস্বতীর মেয়ে শ্রাবণীর ছবিই ভাইরাল হয় সংবাদ মাধ্যমে। গোটা ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়।

ডোমকলের রাজনৈতিক সংঘর্ষ 

বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের ডোমকল। অবস্থানগত ভাবে ভারত- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত এই ব্লকে ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩ প্রত্যেকবারই পঞ্চায়েত ভোটে রক্ত ঝরেছে। মুর্শিদাবাদ বরাবরই কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। কিন্তু সেখানে তৎকালীন শাসকদল সিপিএম ও জমি ছাড়েনি। যদি ও বেশিরভাগ সময়েই ডোমকল থেকেছে কংগ্রেসের হাতেই। তবু ও সিপিএম- কংগ্রেস রাজনৈতিক সংঘর্ষ এতগুলো বছরে এখানে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩৭ জন মানুষ। পরবর্তী কালে রাজ্যে সিপিএম- কংগ্রেস জোট করলে এই রাজনৈতিক হিংসা অনেকখানি কমে আসে।

রামপুরহাট গণহত্যা

তৃণমূল জমানার সবথেকে নারকীয় গণহত্যা দেখল রাজ্য ২০২২ -এর ২২  মার্চ। ২১ মার্চ তৃণমূল নেতা ভাদু শেখকে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে একদল দুষ্কৃতী। ভাদু শেখের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বগতুই গ্রামে সোনা শেখের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ভাদু শেখের অনুগামীরা। জীবন্ত দগ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয় ১০ জনের। সেই রাতে গ্রামে ঢুকতেই পারেনি পুলিশ। পরের দিন বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গ্রামে গিয়ে মৃতদেহগুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় গ্রাম ছাড়ছেন বহু মানুষ। ২০২২ এর এই ঘটনা রাজ্য রাজনীতির ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। গোটা ঘটনায় মুখ্যসচিবের কাছে রিপোর্ট তলব করেছেন রাজ্যপাল। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙখলাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল।

More Articles