সেকেন্ড ইনিংস ঘরের মাঠে? একটাই পথ খোলা প্রশান্ত কিশোরের জন্য

লাভ-লোকসানের হিসেব কষতে কষতে পরিশ্রান্ত তিনি। তাই রাজনীতির অঙ্কের বাইরে নতুন কিছু করতে চান। ২০২১-এর ২ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই এমন ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ২০২২, ২ মে, ঠিক এক বছর পর সেই প্রতিজ্ঞা পালনের পথেই পা বাড়ালেন প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor)। জানিয়ে দিলেন, ১০ বছর ধরে যে অধ্যায়ে মুখ গুঁজে বসেছিলেন তিনি, এবার তার পাতা ওল্টানোর সময় এসেছে এবং নিজের জন্মভূমি বিহার (Bihar Politics) থেকেই তার সূচনা করতে চলেছেন তিনি। তাতেই সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর যোগদান ঘিরে সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিয়েছে।

কংগ্রেসে যোগদানের প্রস্তাব ফেরানোর পর গত এক সপ্তাহ নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করতে শোনা যায়নি প্রশান্তকে। বরং সংবাদমাধ্যম যখনই তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, প্রতিবার কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়েই কথা বলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাঁর রণকৌশল নয়, আপন ভাগ্য জয় করতে কংগ্রেসকে নিজের ঐতিহ্যে ভর করেই উঠে দাঁড়াতে হবে বলে বারবার জানিয়েছেন তিনি। তা নিয়ে কাটাছেঁড়ার মধ্যেই সোমবার নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকে নতুন পদক্ষেপ করলেন।

তাই সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে সকালে উঠে আসল কাজের কথাটাই পেড়ে ফেললেন প্রশান্ত। সোমবার টুইটারে তিনি লেখেন, ‘গণতন্ত্রে অর্থবহ অংশীদারিত্ব এবং জনসাধারণের অনুকুল নীতি গঠনের সহায়ক ভূমিকার সন্ধানে গত ১০ বছর নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। এখন পাতা ওল্টানোর সময় এসেছে। সময় এসেছে আসল প্রভু, জনগণের কাছে পৌঁছনোর, যাতে তাঁদের সমস্যাগুলিকে আরও ভাল করে অনুধাবন করা সম্ভব হয় এবং জনগণের সুশাসন প্রতিষ্ঠার রাস্তা ধরে এগনো যায়। বিহার থেকেই তার সূচনা।’

আরও পড়ুন: ফেরিওয়ালা প্রশান্ত কিশোর ও কংগ্রেসি জমিদারি: এক অলীক কুনাট্য

বিহারের ভূমিপুত্র প্রশান্ত, জন্মভূমিকে কর্মভূমিতে পরিণত করবেন, এর মধ্যে চমকপ্রদ কিছু না থাকলেও, যেসময় প্রশান্ত নতুন যাত্রাপথের ঘোষণা করলেন, তা যথেষ্টই অর্থবহ। কারণ বিহারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই মুহূর্তে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিজেপি-র সঙ্গে জোট সরকারে আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা নীতীশ কুমার। বিহারের নামমাত্র মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি টিকে রয়েছেন বলে আড়ালে-আবডালে তো বটেই, প্রকাশ্যেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকে। নীতীশকে কোনওভাবে দিল্লিতে সরিয়ে, বিহারে বিজেপি থেকে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করা যায় কি না, গেরুয়া শিবির থেকেই উঠে আসছে সেই প্রশ্ন।

এমন পরিস্থিতিতে মলম-পট্টি লাগিয়ে পুরনো সুহৃদ লালুপ্রসাদ যাদব এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক চাঙ্গা করতে উদ্যোগী হয়েছেন নীতীশ। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু-বিরোধী তকমা ঝেড়ে ফেলতেও তৎপর হয়েছেন তিনি। তাই শরিক দল বিজেপি-র চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই কখনও সটান যাদব পরিবারের ইফতার পার্টিতে হাজির হতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। আবার সপরিবারে যাদবরাও নীতীশের ইফতারের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ছুটে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সংযোগ নেই বলে দু’পক্ষ দাবি করলেও, পাঁচ বছর পর আচমকা নিমন্ত্রণ রক্ষার এই জিগিরকে নিঃস্বার্থ আবেগ বলে মানতে নারাজ সকলেই।

আর তাতেই প্রশান্তর ভূমিকার কথা উঠে আসছে। কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে নীতীশের সঙ্গে দেখাও করেন তিনি। নীতীশের সংযুক্ত জনতা দল (JDU) ছেড়ে বেরিয়ে আসার দু’বছর পর এমন ‘সৌজন্য’ দেখালেন দু’পক্ষ। ২০১৫ সালে প্রশান্তর পৌরোহিত্যেই বিহারে বিজেপি-বিরোধী ‘মহাজোট’ গড়ে উঠেছিল, যার দৌলতে চতুর্থবারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নীতীশ। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিল লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল। তৃতীয় জোটসঙ্গী কংগ্রেসও তাতে আপত্তি করেনি।

কিন্তু লালুপুত্র তেজস্বী যাদব, নীতীশের তৎকালীন ডেপুটির বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে সেই জোটে ফাটল ধরে। তেজস্বী ইস্তফা না দেওয়ায় ২০১৭-র ২৬ জুলাই নিজেই পদত্যাগ করেন নীতীশ। তারপর রাতারাতি বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুনরায় সরকার গড়েন। তেজস্বীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নয়, আসন সংখ্যায় পিছিয়ে থাকা নীতীশ আসলে যাদবদের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়ার ভয়েই বিজেপি-র সঙ্গে ঢের আগে থেকে তলে তলে আলোচনা চালাচ্ছিলেন বলে সেই সময় শোনা যায়।

ব্যক্তিগত স্বার্থে নীতীশের বারবার এই অবস্থান বদলকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সেই সময় তাঁকে ‘পল্টুরাম’ বলে কটাক্ষও করেছিলেন লালু। পশুখাদ্য মামলায় লালুকে জেলবন্দি করার পিছনে তাই নীতীশের হাত দেখেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল নীতীশকে বিজেপি-র সঙ্গে জোট নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। কারণ শরিক দলের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং কর্মকাণ্ড তাঁর গায়েও সংখ্যালঘু-বিদ্বেষী তকমা সেঁটে দিয়েছে। যে তেজস্বী এক সময় তাঁর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন, সেই তিনি একার ক্ষমতায় দলকে ৮০টি (একক সংখ্যাগরিষ্ঠ) আসন এনে দিয়েছেন। তাই মানে মানে এখন বিজেপি-র সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানা গেলেই নীতীশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন বলে মত রাজনৈতিক মহলের।

সেই পরিস্থিতিতে বিহার থেকে নতুন সূচনা করতে চেয়ে জল্পনা উসকে দিয়েছেন প্রশান্ত। ভোটের কৌশল রচনার বাইরে, নীতীশের দলেই রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন প্রশান্ত। এক সময় দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি, যা কিনা এক অর্থে নীতীশের পর দলে দু’নম্বর ব্যক্তির পদমর্যাদা বহন করে। কিন্তু নীতীশ বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলানোর পর থেকেই একাধিক বিষয়ে দু’জনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, মূলত এই দুই বিষয় নিয়েই চরমে পৌঁছয় দ্বন্দ্ব। প্রকাশ্যে তা নিয়ে মুখ খোলায় প্রশান্তকে দল থেকে বহিষ্কার করেন নীতীশ। বাংলা, ত্রিপুরায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে কাজ করার সময় বিহারে প্রশান্তর জন্মভিটের দেওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ায় দূরত্ব আরও বাড়ে।

দেখা-সাক্ষাৎ করে পুরনো ক্ষতে প্রলেপ লাগানো এক, আর ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তা ছাড়া, স্বাধীনতার প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর প্রশান্ত কোনও দলের ছত্রছায়ায় থেকে, ‘বিগ বস’-এর নির্দেশ অনুযায়ী আদৌ কাজ করবেন কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সেক্ষেত্রে নিজের আলাদা দল গড়া ছাড়া সক্রিয় রাজনীতিতে ঝোড়ো ইনিংস খেলা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। তাই দল গঠন করে ভোটের রাজনীতিতে তিনি নাম লেখান, না কি গান্ধীবাদী প্রশান্ত মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ করে দেশের-দশের চাহিদা, সমস্যাগুলি বুঝতে অগ্রণী হন, সেটাই এখন দেখার। ৫ মে পাটনায় সাংবাদিক বৈঠক করবেন তিনি। সেখানেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

More Articles