ফেরিওয়ালা প্রশান্ত কিশোর ও কংগ্রেসি জমিদারি: এক অলীক কুনাট্য
থিতু হওয়া হলো না ফেরিওয়ালার। টালবাহানা চলল, গড়িমসি চলল, নানা জন নানাবিধ কল্পনা-পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু কার্যত সবকিছুতে জল ঢেলে ফের ঝোলা উঠিয়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন রাজনৈতিক ফেরিওয়ালা প্রশান্ত কিশোর। রুদ্ধশ্বাস নাটকের অবসানে যেন দু'পক্ষই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু গ্যালারিতে বসে টানটান নাটক উপভোগ করা আম আদমি কী পেলেন, কী হারালেন?
প্রশান্ত কিশোর এবং কংগ্রেস- সোশ্যাল মিডিয়ার নাট্যমোদীদের সামনে এই দু'পক্ষই পালা নিয়ে নিজস্ব বয়ান দাখিল করেছে। কংগ্রেস বলছে, তাঁকে ঠিক কোন ভূমিকায় চাইছে দল, তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষমেষ প্রশান্ত কিশোর রাজি হননি। প্রশান্ত কিশোর অবশ্যই দু'কদম এগিয়েই খেললেন। কংগ্রেসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন একথা স্বীকার করে নেওয়ার পাশাপাশি প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেসের পুরনো ঘা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর মত, কংগ্রেসের যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস আগে সেইসব সমস্যাগুলোর সমাধান করুক, যার শিকড় অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত।
কোন সমস্যা? প্রশান্ত ভেঙে বলেননি। কিন্তু রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন পরিবারতন্ত্র, পিতৃতন্ত্রের যে বীজ স্বাধীনতার আগেই কংগ্রেসের মাটিতে বপণ করা হয়েছিল, তা আজ সুদে-মূলে বনস্পতি হয়েছে। রাহুল গান্ধীর নিস্ক্রিয়তা হাল আমলে বারবার প্রমাণিত হলেও তিনি মুকুটহীন স্তাবক-পরিবৃত রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেই চলেছেন, নেতৃত্বদানের প্রশ্নে তাঁকে বা গান্ধী পরিবারের সব সদস্যকে বাদ দিয়ে আমূল সংস্কারের কথা ভাবার ক্ষমতা আমলাতান্ত্রিক কংগ্রেসিদের নেই। সাম্প্রতিক অতীতে অশোক গেহলট- সচিন পাইলট, অমরিন্দর সিং-নভজ্যোত সিং সিধুর প্রকাশ্য কাজিয়া সংবাদমাধ্যমের সূত্রে দেখেছে গোটা দেশ। ফলে কংগ্রেস যে অভ্যন্তরীণ লবির লড়াইয়ে অতি দীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে কারও বাকি নেই। সু-নেতৃত্বের অভাব এবং সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে বারংবার সরব হয়েছে জি২৩ গোষ্ঠী। কিন্তু কখনওই বিভেদরেখা মুছে ফেলে এক হতে পারেননি কংগ্রেসি নেতারা। বলা ভালো, তেমন নেতৃত্বই কংগ্রেস পায়নি, যিনি সকলকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারেন।
আরও পড়ুন: প্রশান্ত কিশোরের প্রত্যাখ্যানই কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেক?
প্রশান্ত কিশোর ঘরপোড়া গোরু, অতীতে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে ব্যর্থতার কথা তিনি নিশ্চয়ই ভোলেননি। পূর্বাপর জেনেই তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে রফাসূত্র খুঁজতে গিয়েছিলেন। কোনও আশার আলো না থাকলে প্রশান্ত কিশোর এই পথে পা বাড়াতেন না। বাংলায় তৃণমূলের ব্যাপক জয়ের পর যখন কংগ্রেসকে সরিয়ে রেখে একটি তৃতীয় বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলা যায় কি না, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল, তখন প্রশান্ত কিশোর তাঁর মত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে লড়তে হলে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই লড়তে হবে। এখনও বিরোধী হিসেবে কংগ্রেসের কোনও বিকল্প নেই। কংগ্রেসের ক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসংশয় এই প্রশান্ত কিশোরই যখন জুতোটা গলানোর প্রশ্ন এল, ঈষৎ তফাৎ রাখলেন। বারংবার বৈঠকের পরেও যখন তাঁকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না, তখন বুঝতে হবে, প্রশান্ত কিশোর বুঝতে পেরেছেন কংগ্রেসের এই অসুখগুলো এত সহজে সারার নয়। তাছাড়া '২৪-এর যুদ্ধের নীল নকশা সাজানোর জন্য তাঁকে খোলা মাঠ দেবে না এই দল, তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেবে না দলের একাংশ- তা বুঝতে পেরেই প্রস্তাব নাকচ করলেন পিকে, যাবার আগে অসুখটিকেও চিহ্নিত করে গেলেন।
প্রশান্ত কিশোর প্রবল অ্যাম্বিশাস। কোনও দল বা মতের প্রতি তাঁর আনুগত্য নেই। তিনি রাজনীতির সওদাগর। ভালো 'ডিল' যেখানে, সেখানেই তিনি যাবেন। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস জিততেই প্রশান্ত কিশোর আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ চষে ফেলেছেন, দেখা করেছেন আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। এরপর কংগ্রেসের তীরে তরী ভড়ানোর যে সংকল্প তাঁর মনে উঁকি দিয়েছিল তাতে আবেগের কোনও জায়গা ছিল না। বিজেপির প্রশান্ত কিশোরকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁর হাত ধরে স্ট্যালিন হোন বা মমতা আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের ক্ষমতা বাড়িয়েছে। আসমুদ্রহিমাচল চরচর করে বেড়েছে প্রশান্ত কিশোরের গ্রহণযোগ্যতা। এই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কোনওটাই সর্বভারতীয় বিরোধী মুখ হয়ে ওঠার মতো শক্তিশালী নয়। কিন্তু প্রত্যেকেই প্রশান্ত কিশোরকে ভরসা করে। এই ব্র্যান্ড ইমেজকেই লগ্নি করতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কংগ্রেস যদি নিঃসংশয়ভাবে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিত, তবে তিনি বাকিদেরও চুম্বকের কাছে টেনে আনতে পারতেন। তৈরি হত শক্তিশালী বিরোধী ছাতা, এমনটাই ভেবে থাকবেন পিকে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি যে এই বাজার-সমীক্ষা করেছিলেন, তা বোঝা যাবে গত এক বছরে তার চলাচলের ফিরিস্তি দেখলেই। কিন্তু তাতে ভবি ভোলবার নয়।
এহেন নাটকের অবসানে দেশের লোকসকল যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে বাড়ি ফিরলেন, তা হল, নরেন্দ্র মোদির বিজেপির বিরোধিতা করার যথেষ্ট প্রস্তুতি বিরোধী শিবিরের নেই। নেই যোগ্য নেতৃত্ব। রয়েছে মতানৈক্যের পাহাড়। খোলা মনে নেতৃত্বদানের জন্য যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের প্রচেষ্টাকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে বিজেপি নেতারা নিশ্চয়ই মুচকি হাসি হাসবেন।
বিজেপি হারুক বা জিতুক, গত কয়েক দশক ধরে তারা লাগাতার চেষ্টা করেছে তাদের আদর্শের ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা করতে। গ্রামে-গ্রামান্তরে হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে দেওয়া থেকে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ভার্চুয়াল স্পেসে হিন্দুরাষ্ট্রের রবরবা তোলা, বিজেপির সমস্ত চলাচলই সুনিয়ন্ত্রিত,পরিকল্পিত। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াই করতে হলে দরকার একটি জোরালো প্রতিসংস্কৃতির বোধ। প্রশান্ত কিশোরের সওদাগরি মনোভাব, বেচুবাবু-সুলভ দরকষাকষি, তিন পা এগিয়ে দু'পা পিছিয়ে আসা যেমন কংগ্রেসের অসুখের বিপ্রতীপে তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য-ব্যর্থতার যাত্রার নিরিখে সুবিবেচনা, ঠিক তেমনই রাজনৈতিক দায়মুক্ত, বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তও বটে। এহেন দায়হীন, নিজেরটুকু বুঝে নেওয়া, আখের গোছানো, ইগোসর্বস্ব দলীয় সংস্কৃতি নিয়ে বৃষস্কন্ধ বিজেপির বিরোধিতা? ভারতীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য আজ এক মর্মান্তিক দিন।