ক্রিকেটই একদিন স্বপ্ন দেখিয়েছে, মাঠে ভারতকে কড়া টক্কর দিয়ে দেশকে অক্সিজেন জোগাতে পারবে শ্রীলঙ্কা?

আজ ভারতকে কড়া টক্কর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে শ্রীলঙ্কাও।

যে কোনও খেলাই হোক না কেন, আন্ডারডগ-রা জিতলে যে পরিবেশ তৈরি হয়, সেই পরিবেশ শক্তিশালী টিম ৫ বার বিশ্বকাপ জিতলেও তৈরি হয় না। আন্ডারডগদের জয়ের নজির অনেক থাকলেও বিশ্বজয়ের নজির খুবই কম আছে। এমনটাই ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে। সে-বছর বিশ্বকাপ জিতে তামাম ক্রিকেট-বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল 'আন্ডারডগ' শ্রীলঙ্কা। ১৯৯৬ সালের ১৭ মার্চ লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল শ্রীলঙ্কা। এক শিক্ষক বলতেন, বাবা-মার আদরে বড় হওয়া, সব সময় সব রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে, একগাদা টিউশন এবং রেফারেন্স নোটস পেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া ছেলের থেকে সংসারের পেট চালিয়ে কোনওরকমে পড়াশোনার খরচা জোগাড় করে সাধারণ নম্বর পেয়ে পাস করা ছেলেটিরই কৃতিত্ব বেশি। তবে এখানে ছেলেটি শুধু সাধারণ নম্বরই পায়নি, বরং বিশ্ব জয় করেছিল। যদি সেই সংসার ১৯৯৬-এর শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট টিম হয়, তাহলে সেই ছেলেটি ছিল ক্যাপ্টেন অর্জুন রণতুঙ্গা।

Sri Lanka cricket team

১৯৯৬-এর সেই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট টিম

শ্রীলঙ্কায় তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। বিদ্রোহী তামিল লিবারেশন টাইগারদের হামলার ভয়ে রাত ন'টার পর মানুষ ঘরের বাইরে তেমন থাকত না। ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কাও ওই টুর্নামেন্টের যৌথ আয়োজক ছিল। কিন্তু কলকাতায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপরই অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ জানিয়ে দেয়, নিরাপত্তার ভয়ে তারা শ্রীলঙ্কায় দল পাঠাবে না। এই প্রসঙ্গে ওই দলের কোচ ডেভ হোয়াটমোর বলেছিলেন, "দারুণ ঝকমকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো। আমরা দেশে ফিরে গেলাম। গিয়েই খবর শুনে মাথায় বাজ পড়ল। অন্যান্য দল তাদের খেলা শুরু করল, আর হোটেলে বসে টিভিতে আমরা তা দেখছিলাম।"

এই ঘটনায় যথারীতি খুব বিরক্ত হন শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুন রণতুঙ্গা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, সংবাদমাধ্যমকে তিনি সরাসরি বলেই দেন "ফাইনালে আমরা অস্ট্রেলিয়াকে চাই।" বিশ্বকাপ শুরুর আগে শ্রীলঙ্কাকে কেউই ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের পরেই শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট চিরতরে বদলে যায়। এই সময়ে শ্রীলঙ্কা দলে একঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার। তার মধ্যে যুদ্ধের কারণে স্পনসরজনিত সমস্যা। এসবের মাঝে পুরো দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন। তারই কিছু সূক্ষ্ম চাল বদলে দিয়েছিল বিশ্বকাপের গতি। সনৎ জয়সূর্য, অরবিন্দ ডি'সিলভা, রমেশ কালুহিতরানা, চামিন্ডা ভাস, মুথাইয়া মুরালিধরনরা ঝলসে ওঠেন মাঠে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে নাস্তানাবুদ করে, সেমিফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে শ্রীলঙ্কা ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। অরবিন্দ ডি'সিলভা অস্ট্রেলিয়ার রানের চাকা আটকে রাখেন। ৪২ রান দিয়ে তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কাকে ২৪১ রানের টার্গেট দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে যে সেঞ্চুরি অরবিন্দ ডি'সিলভা করেন, তা ছিল এককথায় অদ্বিতীয়। এবং শেষমেশ ম্যাচ উইনিং রান আসে সেই সংসার চালানো ছেলে অর্থাৎ ক্যাপ্টেন অর্জুন রণতুঙ্গার ব্যাট দিয়ে।

arvind d'silva

ফাইনালের নায়ক অরবিন্দ ডি'সিলভা

জেতার পর উল্লাসে ফেটে পড়েছিল পুরো শ্রীলঙ্কা। রাতে রাজধানী কলম্বো এবং অন্যান্য শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয়োল্লাস করেছিল।

আরও পড়ুন: মাঠে লাফালাফি থেকে টাইব্রেকার, ফিরে দেখা ভারত-পাক ম‍্যাচের পাঁচটি আইকনিক মুহূর্ত

Sri Lanka

বিশ্বজয়ী শ্রীলঙ্কা

রণতুঙ্গা, ডি'সিলভাদের তৈরি করা পথেই হেঁটেছেন মাহেলা জয়র্বধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, দিলশন, ম্যাথিউজরা। ২০০৭ এবং ২০১১ সালে ওয়ান ডে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে তারা। আর ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাও ঘরে তোলে দ্বীপরাষ্ট্রটি। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কার অবস্থা বেশ করুণ। তাদের ক্রিকেটের মধ্যগগনের সূর্য দিন দিন নামছে অস্তাচলে। সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনেদের বিদায়ের পর এই শ্রীলঙ্কা পুরোপুরি অচেনা হয়ে গেছে। নিজেদের খুঁজেই পাচ্ছে না। র‌্যাঙ্কিংয়ে এই দলটির খুবই বাজে অবস্থা। এত বাজে অবস্থা লঙ্কানদের আর কখনও হয়েছে কি না, সন্দেহ। যে-কারণে, ওমানে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব (বাছাই পর্ব) খেলতে হচ্ছে তাদের।

Team Sri Lanka

২০১৪-র টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী শ্রীলঙ্কা দল

গত কয়েক মাস ধরে অর্থনৈতিক সংকট খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রের সর্বত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। পাঁচ সপ্তাহে দু'বার জরুরি অবস্থা জারি করতে হয় দেশে। বিক্ষোভকারীদের কপালে জোটে অসংখ্য মার এবং বিরোধী নেতাদের ভাগ্যে জোটে জেল। তবে বিক্ষোভের আঁচ বাড়তে থাকায় সুযোগমতো পালিয়ে যান সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। একই অবস্থা হয় সেই দেশের প্রেসিডেন্ট গোতায়াবা রাজাপক্ষেরও। এইরকম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে এশিয়া কাপ আয়োজন থেকে সরে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড। তবে সেখানকার সাধারণ জনগণের আশা ক্রিকেট দিয়েই দেশে হবে নতুন দিনের সূচনা। কুশল পেরেরা, দিমুথ করুণারত্নে, দাসুন শানাকা, হাসারঙ্গাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আপামর শ্রীলঙ্কাবাসী। এহেন পরিস্থিতিতে এই এশিয়া কাপ শ্রীলঙ্কাবাসীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আপনারা বুঝতেই পারছেন। এই দলের কাছে সুযোগ আছে সেই ১৯৯৬ দল হয়ে ওঠার।

পরিস্থিতি খানিকটা সেরকম দিকেই ইঙ্গিত করছে। সুপার ফোর-এর প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারিয়ে লিগ তালিকার শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। তাদের সুযোগ রয়েছে ফাইনালে ওঠার। তার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দলকে হারাতেই হবে তাদের। তাহলে ফাইনালের দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকবেন শনাকারা। সেই কারণে, ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের ১০০ শতাংশ দিতে তৈরি শ্রীলঙ্কা। অপর পক্ষে সুপার ফোর-এর প্রথম ম্যাচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হেরে কিছুটা মানসিকভাবে চাপে আছে রোহিত শর্মার দল। ফাইনালে উঠতে গেলে শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান, দু'-দলকেই হারাতে হবে রোহিতদের। আগের ম্যাচের ভুলের কথা না ভেবে নতুন ম্যাচ হিসেবে খেলতে নামবে ভারত। একই সঙ্গে কড়া টক্কর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে শ্রীলঙ্কাও। বলাই বাহুল্য, একটি দুর্দান্ত ক্রিকেট ম্যাচের সাক্ষী থাকতে চলেছি আমরা।

More Articles