মাঠে লাফালাফি থেকে টাইব্রেকার, ফিরে দেখা ভারত-পাক ম‍্যাচের পাঁচটি আইকনিক মুহূর্ত

আজও 'আইকনিক মোমেন্টস' হিসেবে দর্শকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ভারত-পাক ম‍্যাচের এই মুহূর্তগুলি।

আর কয়েক ঘণ্টা পরেই দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফের পরস্পরের মুখোমুখি হবে ভারত ও পাকিস্তান। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের আগে উত্তেজনা চরমে। পাকিস্তানের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা এবং হার্দিক পান্ডিয়া জুটি। এই ম্যাচে জাদেজাকে পাবে না ভারত। যথারীতি কে জিতবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল বিভিন্ন ভিডিওর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, অনুশীলনের ফাঁকে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে কথোপকথন ও ভাব-ভালবাসার ছবি। অবশ্য সব সময় কিন্তু ছবিটা এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না।

ভারত-পাক ম্যাচ মানে তো শুধুই ২২ গজে দু'টি দলের লড়াই নয়। এই মহারণে মিশে থাকে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগ, ক্ষোভ, বেদনা, উচ্ছ্বাস, প্রতিশোধ, প্রত্যাশা। প্রতিটা লড়াই ঢুকে পড়ে ইতিহাসের পাতায়। যার স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ম্যাচের ফল যা-ই হোক না কেন, খেলা শুরুর আগে, মাঝে ও পরের নানা ঘটনাও মনে রাখবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।

দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই চিরকালই উপহার দিয়েছে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ, রোমাঞ্চ এবং উত্তেজনা। অতীতে একাধিকবার দুই দলের খেলোয়াড়দের মাঠেই ব্যাট বলের লড়াইয়ের বদলে, কথা কাটাকাটি থেকে বচসায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে। খেলোয়াড়দের বিরোধের কিছু কিছু তো আজও 'আইকনিক মোমেন্টস' হিসেবে দর্শকদের কাছে চরস্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন: রক্ত নেওয়া নয়, পাকিস্তানি জঙ্গিকে রক্ত দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাল ভারতীয় সেনা

১৯৯২ বিশ্বকাপ, জাভেদ মিয়াঁদাদের লাফালাফি
ভারত-পাকিস্তান লড়াই এবং স্মরণীয় মুহূর্তের কথা বললেই সবার প্রথমে যেটি সামনে আসে, সেটি হলো ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে সিডনির ময়দানে জাভেদ মিয়াঁদাদের ক্রিজের মধ্যে অদ্ভুত লাফ। এই বিশ্বকাপেই প্রথমবার ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। কিরণ মোরে এবং মিয়াঁদাদ, দুই লড়াকু মানসিকতার খেলোয়াড়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি, স্লেজিং এবং তার পরের ঘটনা আজ ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। মোরে উইকেটের পিছনে স্লেজিংয়ের পাশাপাশি বারংবার আপিল করে মিয়াঁদাদের একাগ্রতা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। মিয়াঁদাদ এমনিতেই বল টাইম করতে পারছিলেন না। বারবার একই ঘটনা ঘটার পর, মোরে যখন রান আউট করতে ব্যর্থ হন, তখনই তাঁর আপিল করাকে ব্যঙ্গ করে মিয়াঁদাদ ক্রিজে লাফাতে শুরু করেন। তাঁর কাণ্ড দেখে দর্শকরা তো হেসে গড়াগড়ি খান।

Miadad incident

বিরক্ত হয়ে লাফালাফি করছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ

১৯৯৬ বিশ্বকাপ, আমির সোহেলকে সাজঘরের রাস্তা দেখান বেঙ্কটেশ প্রসাদ

Benkatesh Prasad

মধুর প্রতিশোধ বেঙ্কটেশ প্রসাদের

মিয়াঁদাদের এই ঘটনাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সম্ভবত সবথেকে বড় দাবিদার হল বেঙ্কটেশ প্রসাদ ও আমির সোহেলের লড়াই। মিয়াঁদাদ-মোরের ঘটনার ঠিক পরের বিশ্বকাপেই বেঙ্গালুরুতে আমির সোহেল প্রসাদের বলে দুরন্ত স্কোয়ার কাটে বল বাউন্ডারিতে বল পাঠান। তারপরেই অনেকটা আবারও 'ওইখান দিয়েই বল মারব' ভঙ্গিমায়, সোহেল প্রসাদের দিকে তাকিয়ে বাউন্ডারির দিকে ইশারা করেন। তবে পরের বলেই একেবারে সোহেলের অফ স্টাম্প মাঠ থেকেই উপড়ে ফেলেন প্রসাদ। তারপরেই অনেকটা 'বাপি বাড়ি যা' ভঙ্গিমায় সোহেলের দিকে তাকিয়ে সাজঘরে তাঁকে ফেরত পাঠানোর ইঙ্গিত করেন প্রসাদ।

২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপ, বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম টাইব্রেকার
২০০৭ সালে ডারবানে উদ্বোধনী টি-২০ বিশ্বকাপে প্রথমবার মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটের বিনিময়ে ১৪১ রান তোলে। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৫০ রান করেন উথাপ্পা। এছাড়া ধোনি ৩৩ ও ইরফান করেন ২০ রান। মহম্মদ আসিফ ১৮ রানে ৪ উইকেট নেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তানও ২০ ওভারে ৭ উইকেটের বিনিময়ে ১৪১ রানে আটকে যায়। ৫৩ রান করেন মিসবা। ২০ রান করেন ক্যাপ্টেন শোয়েব মালিক। ২০ রানে ২টি উইকেট নেন ইরফান। ম্যাচ টাই হওয়ায় বোল-আউটে ফলাফল নির্ধারিত হয়। সেহওয়াগ, হরভজন ও উথাপ্পা প্রথম তিনটি বল করতে আসেন। তিনজনেই বল স্টাম্পে লাগিয়ে দেন। পাকিস্তানের হয়ে আরাফত, গুল ও আফ্রিদি, তিনজনের কেউই স্টাম্পে বল লাগাতে পারেননি। ফলে ভারত ৩-০ ব্যবধানে বোল-আউট জিতে ম্যাচের দখল নেয়।

Tiebreaker

টাইব্রেকারে জয় ছিনিয়ে নিল ভারত

১৯৮৬ অস্ট্রেল-এশিয়া কাপ, শেষ বলে মিয়াঁদাদের ছক্কা
লর্ডসে ক্যারিবিয়ান বধ করে বিশ্বজয়ের বছরতিনেক পরের ঘটনা। ১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেল-এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত ও পাকিস্তান। একে ফাইনাল তাও আবার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা চরমে। প্রথমে ব্যাট করে সুনীল গাভাসকর ও শ্রীকান্তের জুটিতে ওঠে ১১৭ রান। সানির সঙ্গে বেঙ্গসরকরের জুটিতে উঠল আরও ৯৯ রান। ২১৬ রানে দ্বিতীয় উইকেট পড়লেও গাভাসকর ফিরতেই সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। টেনেটুনে স্কোর গড়াল ২৪৫ পর্যন্ত। রান তাড়া করতে নামা পাকিস্তানের ইনিংসে ধস নামালেন চেতন শর্মা, মদন লালরা। উপড়াতে পারেননি শুধু মিয়ঁদাদের উইকেট। একাকুম্ভ হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন বড়ে মিয়াঁ। বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলছিলেন রান। ১১৩ রানে অপরাজিত মিয়াঁদাদ জানতেন, এই শতরানের চেয়েও বড় কিছু করে দেখাতে হবে সেদিন। সেই ‘বড়’ বস্তুটি লুকিয়ে আছে ইনিংসের শেষ বলে। জয়ের জন্য শেষ বলে চার রান প্রয়োজন। অতএব বাউন্ডারি ছাড়া বিকল্প নেই। পাহাড়সম চাপ মাথায় নিয়ে চেতন শর্মার শেষ বলে ছক্কা হাঁকালেন জাভেদ। ১ উইকেটে এশিয়া কাপ জেতে পাকিস্তান। ইতিহাসের পাতায় চিরকালের মতো খোদাই হয়ে যায় জাভেদ মিয়াঁদাদের নাম। এই প্রসঙ্গে কপিল দেব বলেছিলেন, "আমি এখনও বিশ্বাস করি এটা চেতনের দোষ ছিল না। শেষ বলে চার রান দরকার ছিল, আমি তাকে লো-ফুল টস মারতে বলেছিলাম। ও ইয়র্কার মারার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জাভেদের দিন ছিল, তিনি তার পা নামিয়েছিলেন, বল সংযোগ করেছিলেন এবং একটি ছক্কা মারেন। যখন আমি সেটা মনে করি তখন আমি ঘুমাতে পারি না। ওই ম্যাচের পর আগামী চার বছরের জন্য দলের আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়।"

Benkatesh Prasad

জাভেদ মিয়াঁদাদ (বাঁদিকে) চেতন শর্মা (ডানদিকে)

১৯৯৯ পাকিস্তান ট্যুর অফ ইন্ডিয়া, একাই ১০ উইকেট নেন কুম্বলে
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১০ উইকেট একাই সাবাড় করেছিলেন অনিল কুম্বলে। সেবার ভারত সফরে এসেছিল ওয়াসিম আক্রমের পাকিস্তান। চিপক টেস্টে জিতে দিল্লিতে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে এসেছিলেন শাহিদ আফ্রিদিরা। প্রথম টেস্টে ১২ রানে জিতেছিল পাকিস্তান। আর দ্বিতীয় টেস্টে ঠিক তার উল্টো ছবি। প্রথম টেস্টে যত রানে জিতেছিল পাকিস্তান, তার থেকেও দুশো বেশি রানে দ্বিতীয় টেস্ট হারতে হয়েছিল শাহিদ আফ্রিদিদের। নেপথ্যে ছিলেন অনিল কুম্বলে। একাই দশখানা উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন ভারতকে।

Kumble

একাই ১০ উইকেট নিলেন অনিল কুম্বলে

ম্যাচ বানচাল করতে খেলা শুরু হওয়ার আগে স্টেডিয়ামের পিচ খুঁড়ে দেয় শিবসেনা। দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অক্লান্ত পরিশ্রমে একদিন দেরী করে শুরু হয় এই ঐতিহাসিক খেলাটি। ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টে টসে জিতেছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। প্রথম ইনিংসে ২৫২ রান তোলে ভারত। সবথেকে বেশি, ৫টি উইকেট নিয়েছিলেন সাকলিন মুস্তাক। তবে পাকিস্তানের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৭২ রানে। প্রথম ইনিংসে ৪টি উইকেট নিয়েছিলেন কুম্বলে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৩৯ রান তোলে ভারত। ৪২০ রানের টার্গেট ছিল ওয়াসিম আক্রমদের সামনে। সব কিছুর উর্ধ্বে ছিল সেদিন কুম্বলের ১০ উইকেট। তাঁর দাপটে সেই ম্যাচে ২১২ রানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে সে দিনের ম্যাচে হারিয়েছিল ভারত। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার জিম লেকারের পর, দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এই রেকর্ড সেদিন গড়েছিলেন জাম্বো। দিল্লিতে কুম্বলের স্পিনের ছোবল সামলাতে হিমসিম খেয়ে যান ইনজামাম উল হক, শাহিদ আফ্রিদিরা। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে হরভজন-শ্রীনাথদেরও উইকেট নেওয়ার কোনও সুযোগ দেননি কুম্বলে। স্বাভাবিকভাবেই এই ম্যাচের পর ইতিহাসের পাতাতেও নাম তুলে ফেলেন ভারতের তারকা ক্রিকেটার। এরপর একাধিকবার ভারত-পাক সাক্ষাৎ হয়েছে। তার মধ্যেও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে জাম্বোর জমজমাট ১০ উইকেট।

More Articles