ডি কোম্পানির সঙ্গে যোগ? নাকি আরিয়ানের পক্ষ নেওয়ার মাশুল গুণছেন নবাব মালিক?

টানা ৮ ঘণ্টার জেরার পরে গ্রেফতার করা হয়েছে মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী তথা এনসিপি নেতা নবাব মালিককে। দাউদ ইব্রাহিমের পরিবারের সাথে বেআইনি লেনদেনের মামলায় তাঁকে আটক করেছেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট( ইডি)। নবাবের অভিযোগ তাঁকে ‘ মিথ্যা অভিযোগে’ ফাঁসানো হয়েছে। দফতর থেকে বের করে আনার সময় মালিক উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে জানিয়েছেন,” মাথা নত করব না। ভয় পাই না। লড়াই করব এবং জিতব। সত্যটা সকলের সামনে আনবো।“ এনসিপি এবং মহারাষ্ট্রের শাসক জোটেরও মত নবাবের গ্রেফতারি আদতে বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতির ফল। কিন্তু কে এই নবাব মালিক? হঠাৎ কেন তাঁর বিরুদ্ধে কেন আদাজল খেয়ে নামল কেন্দ্র? বিশদে জেনে নেওয়া যাক তাঁর পরিচয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে ।

কে নবাব মালিক ?   

মুম্বইয়ের অনুশক্তি নগর থেকে পাঁচবার বিধায়ক পদে নির্বাচিত হয়েছেন নবাব মালিক।  ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির জাতীয় মুখপাত্র এবং বর্তমানে রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য। তিনি বর্তমানে মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু উন্নয়ন,ওয়াকফ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা দফতরের মন্ত্রী। ১৯৫৯ সালে উত্তরপ্রদেশের ধুশওয়া গ্রামে জন্ম হয় নবাবের।খুবই সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭০ সালে পরিবারের সাথে মুম্বই চলে আসেন এবং কুরলাতে ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র বেচা কেনার ব্যবসা শুরু করেন তিনি ও তাঁর বাবা। তাই অনেকে তাঁকে ‘কাগজওয়ালা’ বলেও ডাকেন।১৯৮৪ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন কংগ্রেস নেতা প্রয়াত গুরুদাস কামাতের বিরুদ্ধে। ১৯৯২-৯৩ সালে দাঙ্গার সময় যোগ দেন সমাজবাদী পার্টিতে। বেশ কয়েকবার ভোটেও জেতেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হিসেবে। তবে ২০০১ সালে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সে বছরই যোগ দেন এনসিপিতে। দলে যোগ দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান মালিক। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে বিচারপতি পি বি সাওয়ান্তের কমিশন দুর্নীতির অভিযোগে ওঠায় ২০০৫ সালে মন্ত্রীত্ব পদ ছেড়ে দেন তিনি।  এর তিন বছর পর ২০০৮ সালে অশোক চাভান পরিচালিত ক্যাবিনেটে শ্রমমন্ত্রীর পদ পেলেও ২০০৯ সালে কংগ্রেস-এনসিপি জমানায় বঞ্ছিত হন মালিক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মালিক ১,০০৭ ভোটে হেরে যান।

দাউদ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ কেন ?

ইডির আধিকারিকদের দাবি,নবাবের বেশকিছু লেনদেন থেকে মনে করা হচ্ছে তাঁর সাথে দাউদ ইব্রাহিম এবং তাঁর ভাই ইকবাল কাসকারের যোগাযোগ রয়েছে। এর স্বপক্ষে প্রমাণও রয়েছে মালিকের বিরুদ্ধে এমনই দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, মালিক দাউদের বোন হাসিনা পারকারকে ৫৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। অবৈধ ভাবে একটি জমি নেওয়ার জন্যে এই ৫৫ লক্ষ টাকার ডিল হয়েছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে।আদতে ওই জমির মালিক ছিলেন মুনিরা প্লামবার। ইডির অভিযোগ, হাসিনা পারকারকে টাকা দেওয়ার অর্থ দাউদকে সাহায্য করা।দাউদ সহযোগী ছোটা শাকিল,জাভেদ চিকনাদেরও টাকা পাঠিয়েছেন মালিক।

মুনিরা প্লামবার ও তাঁর মা সেই জমির দেখাশোনা করতে পারতেন না এমনকি তাঁরা জমির আশেপাশেও যেতে পারতেন না। আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়েই নাকি নবাব মালিক ও হাসিনা পারকার অবৈধভাবে ওই জমির দখল নিয়েছেন। বর্তমানে ওই জমির দাম ৩০০ কোটি টাকা কিন্তু খুব সামান্য অর্থেই কিনে নিয়েছেন এই জমি। তদন্তের সূত্রে হাসিনা পারকারের বাড়িতেও হানা দেন ইডির আধিকারিকরা। অন্তত ১০ জায়গায় অভিযান চালিয়ে বুধবার শেষ বেলায় দাউদের ভাই ইকবাল কাসকরকেও গ্রেফতার করেছে ইডি।

ইডির আদাজল খেয়ে নামার কারণ কী?

মহারাষ্ট্রের দাপুটে নেতা মালিক রাজনৈতিক জীবনে একাধিক বিতর্কিত মন্তব্য করে সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছেন। সম্প্রতি শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানের মাদক মামলায় গ্রেফতারি নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। নারকোটিক্স কন্ট্রোল সংস্থার সিনিয়র অফিসার সমীর ওয়াংখেড়ের বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ দেগেছিলেন নবাব। তাঁর অভিযোগ ছিল বিজেপি চক্রান্ত করে আরিয়ানকে ফাঁসিয়েছে। নবাবের বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে অবশেষে সরিয়ে দেওয়া হয় ওয়াংখেড়েকে। উল্লেখ্য, এর আগে মাদক মামলায় নবাব মালিকের জামাইকেও গ্রেফতার করেছিলেন সমীর ওয়াংখেড়ে। সমীরের ধর্ম নিয়েও মন্তব্য করেছিলেন নবাব।

শুধু মাদক মামলা নয় গতবছর রিপাবলিক টিভির টিআরপি বিতর্কেও তাঁর মন্তব্য আগুনে ঘি ঢেলেছিল। রিপাবলিক টিভির স্টিং অপারেশনে চ্যানেলের এডিটর- ইন- চিফের  বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে। স্টিং অপারেশনে দেখা গিয়েছিল, মালিক আন্দাজ করেছিলেন টিআরপি বিতর্কের জেরে অর্ণব গোস্বামী আত্মহত্যা করবেন। এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার বলেছেন,’নবারের গ্রেফতারি কেন্দ্রের ক্ষমতা অপব্যাবহারের উদাহরণ। মালিক সর্বসমক্ষে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাই তাঁকে আটক করেছে ইডি’।

মালিকের গ্রেফতারি উস্কে দিচ্ছে নব্বইয়ের দশকে ব্রিজভূষণ চরণ সিংয়ের দাউদ যোগসূত্রের কথা। সেসময় চরণ সিং ছিলেন সমাজবাদী পার্টির নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি নাকি দাউদের ডি কোম্পানির শুটারদের আশ্রয় দিতেন।সেই মামলায় কাল্পনাথ রাই, চরণ সিং এমনকি তাঁর সেক্রেটারিকেও আটক করা হয়। সমাজবাদী দল ত্যাগ করে একসময় বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। বাকিদের জেল হলেও উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস বলে ঘোষণা করে। বর্তমানে তিনি বিজেপি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ। তবে মহারাষ্ট্র সরকার এখনই মালিককে মন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিতে নারাজ। এখন দেখার মালিকের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়!         

More Articles