উদয়পুরে লুকিয়ে বড় নাশকতার ছক? দর্জি হত্যার সূত্রে উঠে আসছে যে প্রশ্ন

নিহত কানহাইয়ালাল কিছুদিন আগে নবী মহম্মদকে নিয়ে নুপুর শর্মার মন্তব্যের সমর্থনে একটি পোস্ট করেছিলেন। ১০ মে কানহাইয়ালালের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং তারপর তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

ধস্ত অর্থনীতি। তবু পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই? আবারও সেই প্রশ্নই উঠে এল। উদয়পুরকাণ্ডে জড়িয়ে গেল পাকিস্তানের নাম। বারবার ভারতে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করেছে পাকিস্তান, এমনই অভিযোগ। সম্প্রতি সেই প্রবণতা কমেছে, কিন্তু পাকিস্তান যে তার সন্ত্রাসে মদত দেওয়া থেকে সরে আসেনি, উদয়পুর কি সেই প্রমাণই দিচ্ছে? নৃশংসতার সঙ্গে জড়িয়ে গেল ইসলামাবাদের নাম। কেন? কীভাবে?

খুনের মোটিভ যাই-ই হোক, পাশবিক, নারকীয় কোনও শব্দই যথেষ্ট নয় উদয়পুরের নৃশংসতা বোঝানোর জন্য। শিরশ্ছেদ, তার ভিডিও এবং তা ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রকাশ্যে দর্জির শিরশ্ছেদ করা হয়। অভিযুক্তরা ভিডিও করে। পুলিশ জানায়, জামাকাপড়ের মাপ দেওয়ার অজুহাতে কানহাইয়ালালের দোকানে আসে অভিযুক্তরা। দর্জি তাদের একজনের জামার মাপ নেওয়ার সময়, সে নিজেকে রিয়াজ বলে পরিচয় দেয়। অন্যজন তাকে ক্লিভার দিয়ে আক্রমণ করে। অন্য ব্যক্তি তখন তার মোবাইল ফোনে হত্যাকাণ্ডর ভিডিও শুট করে। যুবককে খুন করে ওই দুই ব্যক্তি ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় এবং পরে ক্লিপটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে।

ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার ওই দর্জি? বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মার পয়গম্বর মন্তব্যকে সমর্থন করায় উদয়পুরের কানহাইয়ালাল নামে দর্জিকে নৃশংস খুনের ঘটনায় গোটা দেশ স্তম্ভিত। সর্বত্র সমালোচনা হচ্ছে। গোটা রাজস্থানে একমাসের জন্য নানা বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। একদিনের জন্য গোটা রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাকস্বাধীনতা শুধুই মুখের কথা! ভারতে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠে আসছে

মঙ্গলবার রাতে এলাকা থেকে কানহাইয়ার দেহ সরাতে পেরেছে পুলিশ। তার মৃতদেহ ঘিরে রেখে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়রা। দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না করলে বিক্ষোভ আরও তীব্র হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন স্থানীয়রা। কানহাইয়ার মুণ্ডচ্ছেদ করার পর একটি ভিডিও পোস্ট করে আততায়ী মহম্মদ রিয়াজ এবং ঘাউস মহম্মদ। সেই ভিডিওতে কানহাইয়ার শিরশ্ছেদের দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নূপুর শর্মাকেও খুনের হুমকি দেয় তারা।

এর কিছুক্ষণ পরই দুই জনকে গ্রেফতার করে পুলিস। এই খুনের ঘটনার পর উদয়পুরে ব্যাপক বিক্ষোভ-ভাঙচুর হয়। বিক্ষুব্ধরা অগ্নিসংযোগ করে খুনের প্রতিবাদ করে। যার জেরে খুনের তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এনআইএ টিম পাঠিয়েছে উদয়পুরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমান, এই ঘটনার নেপথ্যে নাশকতার ছক থাকতে পারে।

হত্যাকারী কারা?
সাসপেন্ড করা বিজেপি নেতা নুপুর শর্মার মন্তব্যকে সমর্থন করে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের কারণে কানহাইয়ালালকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, খুনি ওই দুই ব্যক্তি পাকিস্তান-ভিত্তিক চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

খুনিরা ঘাউস মহম্মদ এবং রিয়াজ আহমেদ। এরাই কানহাইয়ালালকে হত্যা করে তারপর হত্যার কথা স্বীকার করে এবং অন্য একটি ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হুমকি দেয়। ১৭ জুন রেকর্ড করা তৃতীয় একটি ভিডিও মঙ্গলবার হত্যার পর উঠে আসে। সেই ভিডিওতে, দুইজনের মধ্যে একজনকে মঙ্গলবার উদয়পুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো একটি কাজ করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে শোনা যায়।

উদয়পুরে দর্জি কানহাইয়ালাল খুনের ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানের দু’টি ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের যোগ রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। তা নিয়ে শুরু হয়েছে তদন্ত। ঘটনায় দুই অভিযুক্ত মহম্মদ ও রিয়াজকে জেরা করে করাচির দাওয়াত-ই-ইসলামি এবং তেহরিক-ই-লব্বাইক নামে দু’টি সংগঠনের নাম পেয়েছে পুলিস। ওই সংগঠনের ভাবধারায় বিশ্বাস করে এই দুই অভিযুক্ত। জেরায় তাদের কাছ থেকে এমনটাই তথ্য মিলেছে। করাচিতে অবস্থিত ওই দু’টি সংগঠনের সঙ্গে অভিযুক্তদের সরাসরি যোগ ছিল কি না, এছাড়াও খুনের পিছনে তারা ইন্ধন জুগিয়েছে কি না, সমস্তটা তদন্ত করছে পুলিশ।

তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, আততায়ীদের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক দাওয়াত-ই-ইসলামির প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। তারা সম্ভবত এই সংগঠনের সদস্য। ভারতেও এই সংগঠনের শাখা রয়েছে। দাওয়াত-ই-ইসলামির কিছু সদস্য ২০১১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সলমন তাসিরকে হত্যা-সহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত। হামলাকারীদের আইএসআইএসস-এর সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুলিস জানিয়েছে, অভিযুক্ত দু'জনকেই রাজসমন্দ জেলার ভীম এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুনের ধরন দেখে তদন্তকারীরা মনে করছেন, এতে আইএসআইএস-এর যোগ থাকতে পারে। কারণ এভাবেই নাশকতা চালায় আইএসআইএস। তারা খুন করে এভাবেই খুনের দায় স্বীকার করে, এক্ষেত্রে রিয়াজরা যেমন করেছে। তাই মনে করা হচ্ছে, আইএসআইএস তাদের মদত দিয়ে থাকতে পারে।

কানহাইয়ালালকে কেন খুন করা হলো?

নিহত কানহাইয়ালাল কিছুদিন আগে নবী মহম্মদকে নিয়ে নুপুর শর্মার মন্তব্যের সমর্থনে একটি পোস্ট করেছিলেন। ১০ মে কানহাইয়ালালের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং তারপর তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আদালতে হাজিরার পর জামিন পান কানহাইয়ালাল। পরিবারের অভিযোগ, কানহাইয়ালাল লাগাতার হুমকিতে খুব বিরক্ত ছিলেন এবং বেশ কয়েকদিন ধরে দোকান খোলেননি।

নুপুর শর্মার মন্তব্য নিয়ে কম তোলপাড় হয়নি দেশে। দেশের মুসলিমরা তো বটেই, বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র এর সমালোচনায় সরব হয়। এখন প্রশ্ন হল এটা কি শুধু ধর্মীয় আবগের প্রতিফলন? একথা অস্বীকার করে লাভ নেই, মহম্মদ জুবেরের গ্রেপ্তারি ও এই ঘটনা পাশাপাশি ঘটা কেবলই কাকতালীয় নাও হতে পারে। রাজস্থানে কংগ্রেসের শাসন থাকলেও উদয়পুরে বিজেপির রমরমা, সেখানে এমন ঘটনা ঘটা কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিকও বটে। তাছাড়া এই ঘটনা জাতীয় স্তরে নুপুর শর্মা বিতর্ক থেকে বিজেপিকে কিছুটা রেহাই দিতে পারে।

পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। সরকার পরিস্থিতি সামলাতে নাজেহাল। চিন অর্থনৈতিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। ইতিমধ্যে এই ঘটনার সঙ্গে পাক যোগের ক্লু পেয়েছেন তদন্তকারীরা। অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি যেভাবেই ধস্ত হোক পাকিস্তান, সন্ত্রাসের যে বিষবৃক্ষ তাদের মাটিতে লালিত, তা হয়তো কোনওদিনই উৎপাটিত হবে না।

More Articles