মোদির ভাগ্যের চাকা কোন দিকে ঘুরবে, ঠিক করবেন যোগীই?

সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সমাজমাধ্যম সব জায়গাতেই এখন আলোচনার মূল বিষয়বস্তু উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন। গত বারের মতো এবারেও ক্ষমতার দাবিদার সেই যোগী আদিত্যনাথ এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবির পর পূর্ব ভারতের স্বপ্নকে কিছুটা সরিয়ে রেখে আবার উত্তর এবং মধ্য ভারতের দিকে নজর দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। বাংলার নির্বাচনে 'তোলাবাজ ভাইপো'-র মতো স্লোগানের জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার স্বপ্ন দেখা বিজেপি উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে আবারও সেই হিন্দুত্বের ধ্বজাকেই আঁকড়ে ধরেছে। আর হাতে এখনও সেই একই হাতিয়ার : বিজেপি মানেই নরেন্দ্র মোদি, একমেবঅদ্বিতীয় ইমেজে ভরসা রেখেই লড়াইটা জিততে চায় বিজেপি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে একাধিক প্রথম সারির বিজেপি নেতারা চষে ফেলছেন গোটা উত্তর প্রদেশ। ২০২২ উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের পাশাপাশি সবার নজর এখন ২০২৪ লোকসতেভা নির্বাচনের দিকেও। ওয়াকিবহালরা বলেন, দিল্লির রাস্তা, উত্তরপ্রদেশ দিয়েই যায়। কথাটা খানিকটা ঠিকই, কারণ উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে ভারতের সবথেকে বেশি লোকসভা আসন রয়েছে ৮০টি। যার মধ্যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দখল করতে পেরেছিল ৬২টি। তবে সেবার আর এবারের সর্বার্থেই তুলনা চলে না।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে ছিল পুলওয়ামার মত কিছু জ্বলন্ত ইস্যু। সর্বোপরি, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তখনো তৈরি হয়নি। গ্রামীণ ভারতের জন্যও উজ্জ্বলা যোজনা, স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মত একাধিক প্রকল্প ছিল বিজেপির হাতে। কিন্তু এবারে বিজেপির জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। এমনিতেই, ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে ২০০ আসনের স্বপ্ন দেখা বিজেপি ৭৭ - এ শেষ করেছে। ৩ থেকে ৭৭, এই উন্নতিটা বিজেপির জন্য অত্যন্ত বড় একটি মাইলস্টোন হলেও, খোয়াবনামা পূরণ হলো না। 

বিজেপির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ দলের প্রমূখদের বারংবার বলেছিলেন, মধ্য ভারত এবং উত্তর ভারতে জয়লাভ করা শুধুমাত্র তাদের লক্ষ্য নয়। বরং, কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানার মত রাজ্য যেখানে বিজেপির ক্ষমতা খুব কম, সেইখানে জয়লাভ করাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য, যদিও ২০২১ এ তা হয়নি। অন্যদিকে, অসমে জয়লাভ করাও বিজেপির জন্য একটি অন্যতম বড় ফ্যাক্টর একটি ছিল ২০২১ সালে। সেখানেও বহাল তবিয়তে নিজেদের ক্ষমতা অটল রেখেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে চিহ্নিত হয় অসম। সম্ভাবনা আছে, অসমের মতোই ২০২৩ সালে ত্রিপুরাতেও নিজেদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চলেছে বিজেপি।

তবে বাংলায় বিজেপির ঝড়কে একাই রুখে দিয়েছিলেন মমতা। বঙ্গের বহু বিজেপি নেতা মনে করেন, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতা পার্টির কোন মুখ না থাকার কারণেই এবারের নির্বাচনে পরাজয় ঘটেছে বিজেপির। কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র মুখ কিংবা আদর্শের নয়। বাংলার নির্বাচনে একটা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল মহিলা ভোটব্যাঙ্ক। পশ্চিমবঙ্গের মতো জায়গায়, যেখানে মহিলা ভোট প্রায় ৪৯ শতাংশ, সেখানে বাড়িতে কর্তা যে দলের সমর্থক, তাকেই ভোট দেবেন বাড়ির মহিলা সদস্যরা, সেটা একেবারেই হয় না। বরং মহিলারা সবদিক বিচার করে তবেই নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, এবং তারা যে কার উপর বিশ্বাসটা রেখেছেন, সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে বাংলার পরিসংখ্যান দিয়ে ২০২২ উত্তরপ্রদেশের ফল কিংবা ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ট্রেন্ডকে বিচার করার কোনো মানে হয়না। তাই বিজেপিও ২০২১ এর হারকে ভুলে গিয়ে ২০২২ এর দিকে নজর দিয়েছে। এই বছরটা বিজেপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর হতে চলেছে। এই বছর রয়েছে পাঁচটি রাজ্যের সাধারণ নির্বাচন, যার মধ্যে একটি উত্তর প্রদেশ। আর উত্তরপ্রদেশের সাধারণ নির্বাচনকে পাখির চোখ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যেভাবে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যোগী আদিত্যনাথ এবং গোটা বিজেপির জন্য প্রচার করছেন মোদি, তাতে এ বিষয়টা স্পষ্ট, ২০২২ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনকে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে সেমিফাইনাল হিসেবেই দেখছেন বিজেপি নেতারা। মোদি সরকারের সম্পূর্ণ ক্যাবিনেট, বিজেপির শীর্ষস্থানীয় সমস্ত নেতারা উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিতে চলেছেন।

দিল্লির উত্তর উত্তরপ্রদেশেই 

তার প্রধান কারণটাই হলো, উত্তরপ্রদেশ হলো ভারতের সবথেকে বড় রাজ্য এবং এই রাজ্যে ভারতের সবথেকে বেশি লোকসভা আসন রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত আসনের মধ্যে সিংহ ভাগই এসেছিল উত্তর প্রদেশ থেকে। ২০১৪ সালে ৭১টি এবং ২০১৯ সালে ৬২টি আসন সংগ্রহ করে বিজেপি খুব সহজেই জয়লাভ করেছিল নির্বাচনে। তাই উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেও জয়লাভ করতেও নিজেদের সমস্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করতে চলেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। 

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে, বিজেপি ব্যবহার করবে তাদের সেই গুজরাট মডেলকেই। ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বিজেপি তৈরি করছে তিনটি আলাদা আলাদা কমিটি। এর মধ্যে একটি হলো সক্ষম মন্ডল, দ্বিতীয়টি সাকারিয়া বুথ এবং তৃতীয়টি হলো পান্না প্রমুখ। গুজরাট নির্বাচনেও এই তিনটি মডেল বিজেপির জন্য লাভজনক প্রমাণিত হয়েছিল। প্রত্যেকটি স্তর থেকে দলের কর্মকর্তাদের উজ্জীবিত করার জন্য এই পন্থা গ্রহণ করেছিল বিজেপি। এখানে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনে নারায়নপুরা এলাকা থেকে পান্না প্রমুখ হয়েছিলেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আর এবারে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বিজেপির তরফ থেকে পান্না প্রমুখ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর দু'জন প্রধান সহকারী।

একই ভাবে এবারের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জোর দিয়েছে তাদের মোর্চার উপরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে গিয়ে মোর্চা সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিজেপির জন্য জনমত তৈরি করা এবং বিজেপিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে উত্তরপ্রদেশের এই মোর্চা সংঘ। তবে এর মধ্যেও সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে বিজেপি সংখ্যালঘু মোর্চা, ঠিক যেরকম ভাবে বাংলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিজেপির মতুয়া ভোট।

আরও পড়ুন-বাড়ির লকার রুম আপনার ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি! বলছেন বাস্তুবিদরা

উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘু মোর্চাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন সেই মোর্চার প্রথম সারির নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি, নানা ঘটনায় যে ড্যামেজ হয়েছে, তা রুখতেও যেন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ওই মোর্চার সদস্যরা-বার্তা এই মর্মেই। এছাড়াও আরএসএস এবং বিজেপির যুগপৎ প্রচারাভিযান তো আছেই। সব মিলিয়ে, ২০২২ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য জোর কদমে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিজেপি।

অন্য দলগুলো কে কোথায়?

উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে অখিলেশ যাদবের হাতেও রয়েছে বেশ কিছু ইস্যু। এর মধ্যে অন্যতম হলো করোনাভাইরাস অতিমারিতে যোগী সরকারের ভূমিকা, উত্তরপ্রদেশের বাড়তে থাকা বেকারত্ব এবং তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি। দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বিজেপি এমনিতেও এর আগে অনেকবার সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, যার নবতম উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়টা খুব ভালোভাবেই জানেন সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব।

এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও গেম প্ল্যান নিয়ে অবতীর্ণ না হলেও, তিনি যখন পুরোপুরিভাবে প্রচারাভিযান শুরু করবেন, তখন তার হাতেও থাকবে বেশ কিছু কৌশল। সমাজবাদী পার্টি প্রথম থেকেই যাদব গোষ্ঠীর উপরে একটু বেশি কাজ করে থাকে। তবে, এবারে অখিলেশ যাদব অনগ্রসর শ্রেণির উপরে লক্ষ্য রাখতে পারেন। তার পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অখিলেশ যাদবের সখ্য-র ব্যাপারটি প্রায় সকলেরই জানা। সেই দিক থেকেও একটা সুবিধা পেতে পারেন অখিলেশ যাদব।

এবারের উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে আরেকটা ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে কংগ্রেস। তবে কংগ্রেসের জয়লাভের সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ বললেই চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ভোটের উপর নিজের আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিলেন, ঠিক তেমনটাই চেষ্টা করছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। উত্তরপ্রদেশের একাধিক জায়গা তিনি চষে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। উত্তরপ্রদেশের নিম্নবর্গের মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হওয়া সহ একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম বার কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে কিছু ভোট পাওয়ার আশা জাগাতে পেরেছে, এবং সেটা শুধুমাত্র প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্যই। 

যোগীর ৫ বছর

উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রচারাভিযানের একটা বড় অংশজুড়ে থাকবেন যোগী আদিত্যনাথ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, 'যদি আপনি আরো একবার মোদিকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান তাহলে, ২০২২ এ যোগীকে মুখ্যমন্ত্রী করুন।' মোদীর নামে ভোট চাওয়া হলেও, বিগত কয়েক বছরে বিজেপির অন্যতম একজন তারকা হয়ে উঠেছেন যোগী আদিত্যনাথ। একজন স্বয়ংসেবক হওয়ার পাশাপাশি, গেরুয়া বসনধারী এই ব্যক্তিটি 'বিকাশ পুরুষ', এবং 'হিন্দু হৃদয় সম্রাট' হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরতে শুরু করেছেন বিগত কয়েক বছরে। 

স্বয়ংসেবক সংঘ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও তিনি অত্যন্ত প্রিয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া বিজেপির জাতীয় সভায় বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচিও পেশ করেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রথম দিকে তার ভূমিকা বিতর্কিত হলেও, পরবর্তীতে নিজের ভূমিকাকে অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন যোগী। ভ্যাকসিনেশনের তালিকাতেও দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে উত্তর প্রদেশ। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস থাকলেও, উত্তরপ্রদেশে ভ্যাকসিনেশনের হার রীতিমতো প্রশংসনীয়।

তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, উত্তরপ্রদেশে মোদি-যোগী যুগলবন্দি যদি জয়লাভ করে, ২০২৪ লোকসভায় অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ পেয়ে যাবে বিজেপি। উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় বার যদি যোগী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতেও অন্যতম একটি মুখ হয়ে উঠবেন যোগী আদিত্যনাথ। নির্বাচন কৌশলী প্রশান্ত কিশোর যতই বলুন না কেন, '২০২২ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন কোনও সেমিফাইনাল নয়', জাতীয় নির্বাচনের দিক থেকে ২০২২ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন অবশ্যই হতে চলেছে ২০২৪ লোকসভার প্রিকুয়েল।

More Articles