রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় বিদায় নিচ্ছেন বাংলা থেকে? মমতার 'সৌজন্যে' চূড়ান্ত জল্পনা

এই মুহুর্তে আলোচ্য বিষয়, কোনও ভাবে ধনকড়ের নামও কি বিজেপির তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে? যদিও এ সব কথার সত্যতা কোনও মহলই স্বীকার করেনি, তবুও এটি বড়সড় জল্পনা তো বটেই৷

দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝেই বিধানসভা অধিবেশন শুরুর আগের দিন,বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলায় হঠাৎই রাজভবনে হাজির হয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে আচমকাই সাক্ষাৎ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎই রাজভবনে যাওয়ার পর নানা জল্পনাই মাথাচাড়া দিয়েছে রাজনৈতিক মহলে৷ চর্চা চলছে, এটি কী নেহাতই 'সৌজন্য-সাক্ষাৎ' ছিল, না'কি ধনকড়কে আগাম 'ফেয়ারওয়েল' দিলেন মুখ্যমন্ত্রী ? এই ধরনের জল্পনায় মাত্রা যোগ করেছে আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন৷ একাধিক মহলে এই মুহুর্তে আলোচ্য বিষয়, কোনও ভাবে ধনকড়ের নামও কি বিজেপির তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে? যদিও এ সব কথার সত্যতা কোনও মহলই স্বীকার করেনি, তবুও এটি বড়সড় জল্পনা তো বটেই৷

বাংলার রাজ্যপালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্বের ইতিহাস দীর্ঘদিনের৷ প্রতি মুহুর্তেই চলছে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা৷ ধনকড়কে রাজ্যপালের পদ থেকে সরাতে সংসদে সরব হয়েছেন তৃণমূল সাংসদরা৷ হাই কোর্টে মামলাও হয়৷ সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রতিনিয়ত নিশানা করেছেন ধনকড়কে৷ ওদিকে চারদিন আগে রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব পাশ হয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভায়। গত ২৬ মে ক্যাবিনেটে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। সেদিনই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রকাশ্যে বিষয়টি ঘোষণা করেছিলেন৷ এই বার্তা প্রকাশ্যে আসার পরই শোরগোল ওঠে রাজ্যে৷ বিধানসভার চলতি অধিবেশনেই এ সংক্রান্ত বিল পাশ করাতে চলেছে সরকার৷ তার পর ওই বিল পাঠানো হবে রাজভবনে, রাজ্যপালের সম্মতি- সইয়ের জন্য৷ এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, ধনকড় কি খুব সহজে এই বিলে সই করবেন? নাকি ঝুলিয়ে রাখবেন অনির্দিষ্টকাল? অথবা পাঠিয়ে দেবেন রাষ্ট্রপতির কাছে ?

আরও পড়ুন-মমতা-ধনখড়ই প্রথম নন, এর আগেও ধুন্ধুমার বেধেছে রাজ্য-রাজ্যপালে

পরিস্থিতি যখন এমনই, ঠিক তখনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে বেরিয়ে সরাসরি চলে যান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে৷ কী কারণে এই সাক্ষাৎ, তা এখনও স্পষ্ট নয়৷ এই সাক্ষাতের আগাম কোনও খবরও ছিল না৷ এদিন রাজ্যপালকে নিজের আঁকা একটি ছবি উপহার দেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ ওই ছবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের নাম সই করে দেওয়ার অনুরোধ করেন রাজ্যপাল৷ সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে করে দেন নিজের সই৷ উপহার পেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানান ধনকড় দম্পতি৷ রাজ্যপালও কিছু স্মারক তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। প্রায় ঘণ্টাখানেক রাজভবনে থাকার পর বেরিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী৷ সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের একটি ভিডিও আপলোড করেন জগদীপ ধনকড়। সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, রাজভবনে ঢুকেই জগদীপ ধনকড়ের স্ত্রী সুদেশ ধনকড়ের সঙ্গে কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীকেও সৌজন্য বিনিময় করতেও দেখা যায়। ভিডিও-র সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিও আপলোড করেছেন ধনকড়৷ সেই ছবিতে দেখা গিয়েছে, নিজের আঁকা ছবিতে সই করে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তা দেখছেন রাজ্যপাল। এই সব ছবির ক্যাপশনে রাজভবনের তরফে লেখা হয়েছে, "আজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজভবনে এসেছিলেন। তিনি নিজের আঁকা ছবি রাজ্যপালকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন।"

সাম্প্রতিক অতীতে একাধিকবার রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে বাদানুবাদের ঘটনা ঘটলেও কোনও সাক্ষাৎকারেই নিয়মমাফিক সৌজন্য প্রদর্শনে ঘাটতি দেখা যায়নি৷ তার ব্যতিক্রম এদিনও ঘটেনি।

পশ্চিমবঙ্গের ২৮ তম রাজ্যপাল হিসেবে ২০১৯-এর ৩০ জুলাই শপথ নেন জগদীপ ধনকড়৷ তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টিবিএন রাধাকৃষ্ণণ। ২০১৯-এর ২০ জুলাই এই ধনকড়কে পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োগ করেন দেশের রাষ্ট্রপতি৷ পূর্বতন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির স্থলাভিষিক্ত হন ধনকড়। রাজস্থানের ঝুনঝুনু কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়া লোকসভার প্রাক্তন ওই সাংসদ এক সময় কিছুদিনের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন৷ শপথ গ্রহণের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন আইনজীবী ধনকড় কলকাতা, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি এবং বিশ্বভারতীর উপাচার্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন।

রাজ্যপাল হিসেবে ধনকড় যতদিন বাংলায় আছেন তার অর্ধেকের বেশি সময় তিনি ব্যয় করেছেন রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিবাদে৷ শাসক দলের তরফে বার বার তিনি বিদ্ধ হয়েছেন 'বিজেপি'র প্রতিনিধি' বা 'বিজেপির রাজ্য সভাপতি' হিসেবে৷ এই ধরনের আক্রমণেও থামেননি তিনি৷ কখনও ট্যুইট করে, কখনও কোনও জেলায় গিয়ে, কখনও সাংবাদিকদের সামনে সমানে তোপ দেগে গিয়েছেন ধনকড়৷ শাসক দলের তরফে বার বার তাঁকে অনুরোধ করা হয়, কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের আইনসম্মত পাওনা আটকে রেখেছে, তা আদায়ে সরব হোন, রাজ্যপাল হিসেবে রাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়ান৷ কিন্তু কোনও কিছুই কানে তোলেননি ধনকড়৷ ফলে ক্রমশ চওড়া হয়েছে রাজ্যপাল-রাজ্য বিরোধ৷ রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থেকে রাজ্যপালকে অপসারণের প্রক্রিয়া সরকার চূড়ান্ত করার পর রাজ্যপালের সঙ্গে আরও একটি বড় মাপের বিবাদের আশঙ্কা যখন সর্বস্তরে মাথাচাড়া দিয়েছে, ঠিক তখনই মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ রাজভবনে পা রাখার ঘটনাটি তাই জল্পনা বাড়িয়েছে৷ আর যেহেতু এ সবই জল্পনা, তাই যে কোনও জল্পনার অঘোষিত ফরমূলা মেনে ধনকড়ের বিদায়ের জল্পনাও এই মুহুর্তে পল্লবিত হয়েছে নানা ভাবেই৷

More Articles