মমতা-ধনখড়ই প্রথম নন, এর আগেও ধুন্ধুমার বেধেছে রাজ্য-রাজ্যপালে

ফের একবার রাজ্য রাজনীতি সরগরম মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের সংঘাতে। যত বেশি সময় গড়াচ্ছে উত্তাপের পারদ ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। দিনকয়েক আগেই মুখ্যমন্ত্রী জনসমক্ষে জানিয়েছিলেন তিনি রাজ্যপালকে টুইটারে ব্লক করেছেন। একই সঙ্গে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেছেন রাজভবন থেকে তাঁর ফোনে আঁড়ি পাতা হচ্ছে।  শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, তাঁর ক্যাবিনেটের একাধিক হেভিওয়েট মন্ত্রীও রাজ্যপালকে অপসারণের দাবিতে সরব হয়েছেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ সুপারকে ভর্ৎসনা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও একদফা সংঘাত সৃষ্টি হয় দুপক্ষের মধ্যে। এবার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর সংবিধান বহির্ভূত কাজ করেছেন ,এই অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী রমাপ্রসাদ সরকার। আগামী সপ্তাহে এই মামলার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতীতেও একাধিকবার রাজ্যপালের কার্যকলাপ নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী গত বছরও রাজ্যপালকে অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন মমতা ও তাঁর ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা। তবে এবারে প্রেক্ষিত ভিন্ন। অনেকের মুখেই শোনা গেছে, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর এমন সংঘাত বেনজির। কিন্তু তেমনটা একেবারেই নয়। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আগেও এমন বহু রাজ্যপাল বাংলায় এসেছেন যাঁদের সাথে রাজ্য তথা তৎকালীন শাসক দলের সম্পর্ক মোটেও সুন্দর ছিল না।

রাজ্যপাল ধর্মবীর বনাম মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়

১৯৬৭ সালে তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ও রাজ্যপাল ধর্মবীরের মধ্যে তুমুল সংঘাত বাঁধে। সেবছর বিধানসভা ভোটের পর ২৮০ টি আসনের মধ্যে ১২৭ টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ ছিলেন তমলুকের অজয় মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী পদে যোগ দেওয়ার পরেই রাজ্যপাল ধর্মবীর চিঠি পাঠিয়ে তিনদিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী চিঠির উত্তরে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পূর্বনির্ধারিত সময় মত যা হওয়ার তা বিধানসভায় হবে। এতেই বেজায় চটে যান ধর্মবীর এবং মন্ত্রিসভা বাতিলের সুপারিশ করেন কেন্দ্রের কাছে।

বামফ্রন্ট সরকার ও রাজ্যপালের সংঘাত

১৯৮৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের নিয়োগকে কেন্দ্র করে বাম সরকার ও তৎকালীন রাজ্যপাল এপি শর্মার মধ্যে সংঘাত তুঙ্গে পৌঁছায়। বাম সরকার মনোনীত প্রার্থী  রমেন পোদ্দারের বদলে রাজ্যপাল সেই পদের জন্য সন্তোষ ভট্টাচার্যের নাম অনুমোদন করেন। এপি শর্মার মতে, ভোটে সন্তোষ ভট্টাচার্য এগিয়ে ছিলেন তাই তিনি যা করেছেন তা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বাম সরকার তা মানতে নারাজ প্রত্যুত্তরে তাঁরা বলেন, অতীতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর থেকে কম ভোট পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাম সরকার।ভোটকে গুরুত্ব দিতে নারাজ তাঁরা। প্রথম দিন কাজে যোগ দিতে গিয়েই বাধা পান সন্তোষ ভট্টাচার্য। পরে তিনি এই পদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান তিনি। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান সরোজ মুখোপাধ্যাযয়ের ডাকা বৈঠকে ঠিক হয়, কেউ রাজ্যপালের সভায় যোগ দেবেন না। রাজ্যপালকে বয়কটের ডাক দেন বাম সরকার। এমনকী জ্যোতি বসুর নবনির্বাচিত মন্ত্রী নিহার বসুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও যোগ দেননি। আটের দশকে বামেরা বলেছিল, রাজ্যপাল নামক পদটিরই কোনো প্রয়োজন নেই।আরেক রাজ্যপাল বি ডি পান্ডেকে  তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত  নাম দিয়েছিলেন বাংলা দমন পান্ডে।

আরও পড়ুন-পিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ, ২০২৪-এ জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারবেন মমতা?

ফলে ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাত এত বেআব্রু ছিলনা কখনই। সৌজন্যের সম্পর্ক রেখেই রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সংঘাত চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। তৃণমূল জমানায় রাজ্যপালকে যেভাবে একের পর এক লাগামছাড়া ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে তা নজিরবিহীন। চলতি বিতর্কের মাঝেই মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, "রাজ্যপালকে অনুরোধ করছি দয়া এই গ্যাস চেম্বারে থাকবেন না,আপনি দয়া করে এবার মুক্তি পান"।উল্টো সুর বিজেপি নেতা জয়প্রকাশের গলাতেও। সরাসরি রাজ্যপালকেই আক্রমণ করে বিজেপি নেতা বলেন, 'আপনার অবস্থানে শাসক দল সহানুভূতি পাচ্ছে না? রাজ্যবাসী রাজ্যপালের থেকে রাষ্ট্রনেতাসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতে রাজ্যের লাভ হচ্ছে? মিডিয়ায় মুখ খুলে, টুইট করে সমাধান সম্ভব? তবে রাজ্যপালের সাথে সম্পর্কের উন্নতির জন্য সরকারের তরফে তেমন প্রয়াসও নজরে পড়েনি সাম্প্রতিক সময়ে।

More Articles