জড়িয়ে হাজার হাজার ছাত্রর ভবিষ্যত, মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড ঘিরে কেন সিঁদুরে মেঘ

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প – 'স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড’। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি এই প্রকল্প চালু করেন। কিন্তু সূত্র বলছে, প্রথম থেকে এই প্রকল্প নিয়ে জেরবার হচ্ছে সরকার।

স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৫২১.২৯ কোটি টাকা। ১ লক্ষ ১৯ হাজার ১৬৯টি আবেদনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ঋণ মঞ্জুর হয়েছে ১৯,৯৯৬টি। এই তথ্য দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে ধার করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারকেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক রমেন্দ্র সিংহ রায়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প – 'স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড’। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি এই প্রকল্প চালু করেন। কিন্তু সূত্র বলছে, প্রথম থেকে এই প্রকল্প নিয়ে জেরবার হচ্ছে সরকার। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীরা যাতে সহজ শর্তে ঋণ পান, তার জন্য ‘স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড’ চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা সময়মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেওয়ায় তাঁদের কার্ড পেতে দেরি হচ্ছে। অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী আবার ঠিকমতো ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র তৈরি করতে পারছেন না। সঙ্গে নথিপত্র জমা দেওয়ার পরেও অনেক ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ঋণ না দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

কী এই স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প?
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, "স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে পড়ুয়ারা। স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের গ্যারেন্টার হবে রাজ্য সরকার।" মমতা বলেন, "প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও তার প্রশিক্ষণের জন্যেও ছাত্রছাত্রীদের স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডে ঋণ দেওয়া হবে।"

আরও পড়ুন: বারবার তালা স্কুলের গেটে, গরমের ছুটি বাড়ার নেপথ্যে আসলে কোন কারণ?

এছাড়া, কোর্স ফি, টিউশন ফি, কম্পিউটার, ল্যাপটপের জন্যও ঋণ দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা এই ঋণের সুবিধে পাবেন।

স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে মমতার সরকার। স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডে সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন পড়ুয়ারা। সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ সুদের হারে পড়ুয়ারা এই ঋণের অর্থ মেটাতে পারবেন। তবে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ককে এককালীন কোনও টাকা পড়ুয়াদের দিতে হবে না। ১৫ বছরের মধ্যে এই টাকা মেটাতে হবে। ব্যাঙ্ক যাতে কোনওভাবেই অভিভাবকদের ওপর চাপ দিতে না পারে, বা অতিরিক্ত শর্ত আরোপ না করে, সে-বিষয়ে রাজ্য সরকার ব্যাঙ্কগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

কীভাবে আবেদন করা যাবে?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ‍্যায় জানান, স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের জন্য পৃথক পোর্টাল করা হয়েছে। তিনি বলেন, স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের জন্য পৃথক পোর্টাল খোলা হয়েছে। এগিয়ে বাংলা পোর্টালে স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের আবেদন করা যাবে। পাশাপাশি, উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের পোর্টালে আবেদন করা যাবে। এছাড়া, ১৮০০১০২৮০১৪ টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করা যাবে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "ছাত্ররা যাতে কোনওরকম হেনস্থার শিকার না হয়, দেখতে হবে। আমরা চাই, আমরা যে সুযোগ পাইনি, তা যেন এখনকার ছাত্রছাত্রীরা পায়।"

তিনি বলেছিলেন, ৮ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে ইতিমধ্যেই ট্যাব কিনতে টাকা দিয়েছে রাজ্য।

ব্যাঙ্কের আপত্তি
প্রশাসন সূত্রের খবর, স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডে ঋণ যেটুকু মিলছে, তার প্রায় সবটাই সমবায় ব্যাঙ্কগুলি থেকে। এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বহু ব্যাঙ্ক বিশেষ কোনও কার্যকর ভূমিকা এখনও পর্যন্ত নেয়নি। বরং, শিক্ষা দপ্তর থেকে পাঠানো আবেদনগুলি মঞ্জুর করার কথা সরকারি তরফে বলা হলেও ব্যাঙ্কগুলি সেসব ফেলে রেখেছে। সেই তালিকায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নামও রয়েছে। এখনও পর্যন্ত বহু ব্যাঙ্কের গড়িমসির চেহারা ধরা পড়েছে।

প্রথম থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি রাজ্য সরকারের এই প্রকল্পে পড়ুয়াদের পাশে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিও এক নীতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখ্যসচিব নির্দেশ পাঠান, জেলায় যেসব ব্যাঙ্ক এই প্রকল্পে অংশ নেবে না, তাদের মাধ্যমে সরকারও কোনও আর্থিক লেনদেন করবে না এবং সেই সব ব্যাঙ্কে থাকা সরকারের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর সুর নরম করে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি।

গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের বেশি পড়ুয়ার আবেদন কার্যত বাতিল করে ব্যাঙ্কগুলি। এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের মাথায় বাজ! তড়িঘড়ি আসরে নামেন মুখ্যসচিব। এরপর পরিস্থিতি পাল্টায়। নবান্ন সূত্রে জানা যায়, গত বছর দুর্গাপুজোর আগেই এক-এক করে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ইউকো ব্যাঙ্ক, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা এগিয়ে আসে। এই প্রকল্পে রাজ্য সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তারা। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গেও চুক্তি হয়। তারপরেও কয়েকটি ব্যাঙ্কের টালবাহানা চিন্তায় ফেলেছে রাজ্য প্রশাসনকে। এই প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার নিজে গ্যারান্টার। তাও ঋণ শোধ নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না ব্যাঙ্কগুলোর। তাই তারা এই গড়িমসি করছে। তবে রাজ্য সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় অনেকটা শক্তের ভক্ত হয়ে সুর নরম করেছে ব্যাঙ্কগুলো।

সরকারি উদ্যোগ
পড়ুয়াদের স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল তৃণমূল। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী বছরের ১ জানুয়ারি ১০ হাজারেরও বেশি পড়ুয়াকে স্টুডেন্টস কার্ডের সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। সেই কথা মাথায় রেখেই গত বছর নভেম্বরে প্রথম রাজ্যজুড়ে বিশেষ শিবির চালু করেছিল রাজ্য সরকার। ঋণ পেতে পড়ুয়াদের যাতে অসুবিধা না হয়, তাই এই শিবিরে ব্যাঙ্ক ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ের খুঁটিনাটি বোঝানো হয়।

পড়ুয়ারা যাতে আরও সহজে স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা পেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে এই বছর এপ্রিলেও স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের জন্য রাজ্যজুড়ে বিশেষ শিবির করা হয়।

আবেদনকারী ছাত্রছাত্রীদের এই সমস্যা দূর করতেই উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে উচ্চ শিক্ষা দফতর। স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড নিয়ে সমস্যা হলে উচ্চশিক্ষা দফতরের হেল্পলাইনে তা জানাতে বলেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। হেল্পলাইন হিসেবে একটি টোলফ্রি ফোন নম্বর- ১৮০০-১০২-৮০১৪ ও একটি ইমেল- support-wbscc@bangla.gov.in- অ্যাড্রেস দেন তিনি।

বদলাচ্ছে পরিস্থিতি
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে চাইছে না। কিন্তু এই সংক্রান্ত সমস্যার কথা জেনে প্রতি মাসে নিয়মিত নজরদারি চালানো হচ্ছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষর সঙ্গে মুখ্যসচিব, অর্থসচিব এবং শিক্ষাসচিব প্রতি মাসে বৈঠক করছেন। আগে এই সমস্যা প্রবল ছিল। কিন্তু এখন ওঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা বুঝতে পেরেছেন। সরকারই গ্যারেন্টার হচ্ছে। আস্তে আস্তে সব সমস্যা মিটছে। এখন বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক ঋণ অনুমোদনের জন্য এগিয়ে এসেছে।

তাহলে স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের উড়ান উড়বে? দেখা যাক।

More Articles