যুদ্ধ চাই না স্লোগান উঠছে রাশিয়ার প্রতিবাদী মিছিলেও, শেষ হয়ে এল তবে পুতিনের দিন?

কোনও দেশেরই সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না। যুদ্ধ রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষমতার খেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষেত্রগুলিতে তাই বেশিরভাগ দেখা গিয়েছে দেশের ভিতরেই যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ প্রতিরোধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ মনে করা যায় এই প্রসঙ্গে আরেকবার। ঘৃণার বীজ সাধারণ মানুষের মধ্যে বুনে দেওয়া হয় প্রতিটি মুহূর্তে। তবু সেই ঘৃণা যখন ফ্যাসিস্ট আক্রমণের সমর্থনে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়, তখন ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দেয় যে সমস্ত জার্মান নাৎসি ছিল না। সাময়িক ঘৃণার উন্মাদনাও চিরস্থায়ী হয় না। দেশে দেশে বিক্ষোভ তৈরি হয় যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা নিয়ে বিশ্ব সরগরম। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নেতারা একের পর এক ধোঁয়া ওঠা ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু পরিস্থিতির খুব একটা বদল দেখা যাচ্ছে না।

এ অবস্থায় পথে নেমেছেন রাশিয়ার সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে তাদের স্বর। “নো টু ওয়র” আর “সেম অন ইউ” হাজার হাজার কণ্ঠে অনুরণিত হতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানান ভিডিওতে। স্তব্ধ শহরের ফাঁকা রাস্তায় প্রশাসন টহল দিচ্ছে। সেই টহল উপেক্ষা করে হাজার হাজার প্রতিবাদী মিছিল করে চলেছেন ফুটপাথ বেয়ে। সমবেত প্রদর্শন হচ্ছে। কিন্তু এ সবের কী জবাব দিচ্ছেন পুতিন? ভিডিওতে প্রতিবাদীদের তাড়া করে গ্রেফতার করতে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান মিলিটারিকে। বেলাগাম গ্রেফতার চলছে যারাই যুদ্ধের প্রতিবাদ করছেন। ইয়েকেটারিনবার্গের উরালস শহরে বারো জন গ্রেফতার হওয়ার ভিডিও সামনে এসেছে। একজনকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে পুলিশ–এমনটাও দেখা গিয়েছে। রয়টার্স বলছে, গত রবিবার প্রায় ৪,৩০০ প্রতিবাদীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

যদিও সামাজিক মাধ্যমের প্রত্যেকটি ফুটেজ এবং ফোটোগ্রাফ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে পারেনি রয়টার্স। তবে রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কয়েকদিন আগে জানিয়েছিল ৩,৫০০ যুদ্ধবিরোধী মানুষকে আটক করেছে পুলিশ। শুধু মসকৌতেই আটক হয়েছেন ১৭০০ জন। সেন্ট পিটার্সবার্গে ৭৫০ জন। অন্যান্য শহরে ১০৬১ জন। তাঁদের বয়ান অনুযায়ী মোট ৫২০০ জন এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। যদিও ওভিডি-ইনফো প্রোটেস্ট মনিটরিং গ্রুপের রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৬টি শহরে আটক হয়েছেন কমপক্ষে ৪৩৬৬ জন প্রতিবাদী। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ওভিডি ইনফো-র মুখপাত্র মারিয়া কাজনেৎসোভা, তাবালিসি থেকে ফোনে জানান, “বাঁধন দিনদিন শক্ত হয়ে উঠছে। এখন আমরা সামরিক সেন্সরশিপ দেখছি। দিনদিন বেড়ে চলেছে প্রতিবাদও। সাইবেরিয়ার শহরগুলিতে পর্যন্ত এ ধরনের আটকের ঘটনা কদাচিৎ দেখা যেত–এখন হরদম হচ্ছে।”

এমন প্রতিবাদ শেষ ২০২১-এর জানুয়ারিতে দেখেছিল রাশিয়া। বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনি তখন স্নায়ুঘাতক বিষের হামলা থেকে সদ্য সুস্থ হয়েছেন। দীর্ঘদিন জার্মানিতে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। সুস্থ হয়ে দেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করে পুতিনের সরকার। সেদিনও প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। রাশিয়ার রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম এই বিপুলাকারে প্রতিবাদ প্রদর্শনের কথা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করছে ক্রমাগত। কোথাও কোথাও ছোটখাটো খবর হলেও এ নিয়ে দেশের ভিতরে নিজেদের মিডিয়ায় কোনও বড় রকমের খবর হতে দিচ্ছে না রাশিয়া। আর আই এ নিউজ এজেন্সি-র খবরে বলা হয়েছে, “মসকৌর মানেজানিয়াকে ‘মুক্ত’ করেছে পুলিশ। কিছু ‘বেআইনি’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনকে আটক করা হয়েছে। এরা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল।” সংস্থাটি কয়েকটি ভিডিও ফুটেজও দেখিয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ক্রেমলিনের সমর্থকরা মসকৌর বাঁধ ধরে মিছিল করে এগোচ্ছেন। তাদের হাতে রাশিয়ার পতাকা। এবং সেখানে “Z” ও “V” চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এই চিহ্ন রাশিয়ান সেনার ট্যাঙ্কের চিহ্ন, যা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এমনকি চার্চ পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে যুদ্ধে। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কাইরিল বলেছেন পশ্চিম একটু বেশিই স্বাধীনতার কথা বলে। এ একধরনের ইলিউশন মাত্র। আজ রাশিয়ার নিজস্ব মূল্যবোধের পরীক্ষার দিন।” রাশিয়ান স্টেট পোলিং এজেন্সি ভিটিএসআইওএম ২৭ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছে পুতিনের গ্রহণযোগ্যতা নাকি ৬ শতাংশ বেড়ে ৭০% হয়েছে এরই মধ্যে। এখন দাবি করা হচ্ছে তা নাকি ৭১%-এর কাছকাছি।

তবে বিশ্বের কাছে পুতিনের ভাবমূর্তি ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নানারকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের তরফে। রাশিয়ার অভ্যন্তরেও দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে যুদ্ধের প্রতিবাদ। আলম্যাটির বৃহত্তম শহর কাজাকিস্তানের সম্প্রতি ২০০০ জনের একটি যুদ্ধবিরোধী প্রদর্শনী হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে পুতিনের প্রভূত সমালোচনা করা হয়। লেনিনের মূর্তির হাতে নীল ও হলুদ বেলুন বাঁধা হয়। গত রবিবার নাভালনি ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও বিশ্বের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের কাছে প্রদর্শনের আবেদন করেন। তাতে বিরাট সাড়া পাওয়া যায়। অনেকে রাশিয়ার ভিতরেই গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনার কথা ভাবছেন। বিপ্লব হয়ে আচমকা পুতিনের রাজত্বের দিন শেষ হয়ে আসবে–এমন সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যে চেহারায় পুতিনকে দেখছে বর্তমান রাশিয়া, তাতে পুতিনের ক্ষমতা যে আর খুব বেশিদিন নেই, আ বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। কী পথে পুতিন-মুক্ত হবে রাশিয়া তা সম্পূর্ণ রাশিয়ার জনগণের উপর নির্ভর করবে। তবে যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা বজায় রাখার পটভূমি তৈরি করেছে পুতিন, তাতে এই কাজ খুব সহজ হবে না। অন্তত অনায়াসে প্রতিবাদীদের দমন পীড়ন সেইদিকেই ইঙ্গিত করছে।

More Articles