ভুক্তভোগী শুধু আর্জেন্টিনা নয়, অফসাইড যুগে যুগেই বদলেছে ফুটবলের ভাগ্য!

Football World Cup Offside History: ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে সেই বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি গোল করেছিল ২৭ টি, যা এখনও পর্যন্ত এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।

এই বছরের বিশ্বকাপকে এককথায় বলতে গেলে একেবারে অঘটনের বিশ্বকাপ বলাই যায়। তবে সব থেকে বড় অঘটন বোধহয় ঘটেছিল সৌদি আরব বনাম আর্জেন্টিনার ম্যাচে। কেবলমাত্র অফসাইড ট্র্যাপে পড়ে সেই ম্যাচে অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ প্রতিপক্ষ সৌদি আরবের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল লাতিন আমেরিকার এই দলটি। সেই হারকে কাটিয়ে উঠে গ্রুপ তালিকার শীর্ষে আর্জেন্টিনা থাকলেও, এই অফসাইড ট্র্যাপ বিষয়টি হয়তো বহু বছর জীবিত থাকবে মেসিদের মনে। তবে, অফসাইডের ঘটনা বিশ্বকাপে এই প্রথম নয়। ২০১০ সালের আফ্রিকা বিশ্বকাপের একটি অফসাইড এভাবেই বদলে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকাপের ভাগ্য। যদিও সেবার ভুল ছিল রেফারির, কিন্তু মাশুল গুনতে হয়েছিল গোটা জার্মানিকে। ২০১০ সালে আফ্রিকা বিশ্বকাপে স্রেফ রেফারির ভুলের কারণেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের সেই গোলটি। জার্মানির বিপক্ষে এই গোল বাতিল না হলে হয়তো এই বিশ্বকাপের ছবিটা কিছুটা অন্যরকম হতে পারত। হয়তো স্পেনের হাতে না গিয়ে অন্য কোনও দলের হাতে উঠত ফুটবলের সেরার শিরোপা। তাছাড়া সমালোচনা হয়েছিল রিকার্ড কাকার বিরুদ্ধে দেওয়া সেই লাল কার্ডের সিদ্ধান্ত নিয়েও। অফসাইড থেকে শুরু করে বহু কারণেই ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপ ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। ফলে জনরোষ সামাল দিতে বাধ্য হয়ে নড়েচড়ে বসে ফিফা।

আর এর পরেই বিতর্ক এড়াতে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফিফা নিয়ে এসেছিল একটি নতুন প্রযুক্তি যার নাম দেওয়া হয়েছিল গোল লাইন টেকনোলজি বা জিএলটি। এখানেই শেষ নয়, ফুটবল ম্যাচ পরিচালনাকে আরও নির্ভুল করতে ২০১৮ সালে রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে হাজির হয় ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভার প্রযুক্তির। আর এবারে ২০২২ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সেমি অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

অফসাইডের উৎপত্তি কীভাবে?

যুগ পালটায়, আধুনিকতার ছোঁয়ায় পড়ে খেলাতেও বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। যে কোনও খেলাই কিন্তু কয়েকটা নিয়মের মধ্যে বন্দি থাকে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নিয়ম পরিবর্তিত হয়। সেরকমই ফুটবল খেলাও বেশ কিছু নিয়মে আবদ্ধ। কিছু নিয়ম খেলোয়াড়দের পক্ষে থাকলেও কিছু নিয়ম আবার রেফারির পক্ষে। ফুটবল খেলার থেকেও কঠিন হয়ে ওঠে এর কয়েকটি নিয়ম বোঝা। ফুটবল খেলায় সমর্থকদের মধ্যে সবথেকে বেশি তর্ক বাঁধে এরকম একটি নিয়ম নিয়েই, যার নাম অফসাইড।

১৮৬৩ সালে সর্বপ্রথম অফসাইডের সূচনা হয়। ১৮৭২ সালে সর্বপ্রথম অফিশিয়াল ম্যাচে অফসাইডের প্রচলন করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত অফসাইডের নিয়ম ছিল- প্রতিপক্ষের তিনজন খেলোয়াড় সামনে থাকতে হতো (একজন গোলকিপার)। আর তিনজনের কম হলেই হয়ে যেত অফসাইড। অর্থাৎ যদি সামনে একজন খেলোয়াড় এবং গোলকিপার থাকে তাহলে ধরা হতো অফসাইড।

আরও পড়ুন- মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?

অফসাইডের সেই নিয়ম ১৯২৫ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। তবে এরপর নিয়মে সামান্য কিছু পরিবর্তন আসে, যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলে। এই নিয়ম অনুযায়ী, সামনে অন্তত দু'জন খেলোয়াড় থাকতে হবে, গোলকিপার সহ। ১৯৯০ সালে অফসাইডের নিয়মে আসে আরও কিছু পরিবর্তন যা এখনও চলছে। ২০০৫ সালে এবং ২০০৯ সালে অফসাইডের নিয়মে আরও কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। সেই হিসেবে দেখা যায়, বর্তমান সময়ের অফসাইডের তুলনায় আগের অফসাইড কোনও অংশেই কম শক্তিশালী ছিল না, বরং বলতে গেলে সেই সময় অফসাইডের নিয়ম ছিল আরও বেশি কঠিন।

তবে, বর্তমান ফুটবলে অফসাইডের নিয়মেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ২০১৫ সালে এই নিয়মে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত নিয়ম ছিল, আক্রমণে যাওয়া কোনও খেলোয়াড় বল ছাড়া কোনও ডিফেন্ডারের আগে যেতে পারবেন না। বল নিয়ে ডিফেন্ডারকে পার হতে হবে নয়তো বল পাস পাওয়ার সময় ডিফেন্ডারের সমান্তরালে অথবা পেছনে থাকতে হবে। নতুবা সেটি অফসাইড বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই নিয়মে কিছু পরিবর্তন করে ফিফা জানিয়ে দেয়, এতদিন পর্যন্ত অফসাইডে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও খেলোয়াড় বল স্পর্শ করলে তবেই অফসাইড ঘোষণা করা হতো। তবে এখন তিনি যদি বলের দিকে এগোন অথবা বল ধরার চেষ্টা করেন, তাহলেও রেফারি বাজাবেন বাঁশি।

VAR প্রযুক্তি

নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে এবছরের বিশ্বকাপে প্রযুক্তির আরেকটি ব্যবহার দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। ২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কাতার বিশ্বকাপে সেমি অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি প্রবর্তন করেছে ফিফা। ফিফা আশাবাদী, বিশ্বকাপের পরেও এটির ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। ফিফার প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-পরিচালক জোহান্স হোলজমুলার এই প্রযুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। এই নতুন প্রযুক্তিটি প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার মাঠে তাদের সঠিক অবস্থান ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কাছে পাঠায়। সংগৃহীত ডাটাগুলি একটি অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া হয়ে যা অফসাইড নির্ণয়ের সময় বিশ্লেষণ করা হয়। সেমি অটোমেটেড প্রযুক্তির সুবিধার্থে ম্যাচে ব্যবহৃত অ্যাডিডাস বলের কেন্দ্রে একটি সেন্সর লাগিয়ে দেওয়া হয়, যা ভিডিও রুমে প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার ডেটা পাঠায়। সঠিকভাবে বলটি আঘাত করার ঠিক মুহূর্তটি শনাক্ত করে সেই টেকনোলজি।

মূলত এই টেকনোলজির দৌলতেই গোল বাতিল হয়েছে আর্জেন্টিনার, গোল বাতিল হয়েছে ইকুয়েডরের, বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছে জাপান, এশিয়ান ফুটবলের হয়েছে জয়জয়কার। তবে, অফসাইড নিয়ে বিতর্ক যেরকম আগে ছিল সেরকম ভবিষ্যতেও থাকবে। জানা যাক ফুটবল বিশ্বের কিছু এমন অবাক করা ঘটনার কথা যার নেপথ্যে ছিল অফসাইড!

১. ১৯৫৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল

এটা সেই বিশ্বকাপ, যেখানে ফেরেঙ্ক পুস্কাসের হাঙ্গেরি রূপকথার মৃত্যু ঘটিয়ে নতুন রূপকথা লিখেছিল পশ্চিম জার্মানি। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? তার উত্তরে অবশ্যই পেলে, মারাদোনা কিংবা রোনাল্ডো বা মেসিদের নাম আসবে। তবে, সেই বিশ্বকাপে যদি মিরাকেল না হতো, তাহলে হয়তো এই তালিকায় সবার আগে স্থান পেতেন পুস্কাস। আর সেই মিরাকেলটি ছিল অফসাইড!

১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে সেই বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি গোল করেছিল ২৭ টি, যা এখনও পর্যন্ত এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। অপরাজিত হয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় হাঙ্গেরি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি, যে দলকে গ্রুপ পর্বে ৮-৩ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল হাঙ্গেরি। বার্ণের ওয়ানকড্রপ স্টেডিয়ামে ৬২,৫০০ জন দর্শকের সামনে সেদিন হয়তো বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে তুলে নিতে পারতেন পুস্কাস। শক্তির নিরিখে যোজন যোজন পিছিয়ে ছিল জার্মানি। কিন্তু, ওয়াল্টারের দল যে হার মানতে শেখেনি, সেটা সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম জার্মানি।

মাত্র ৮ মিনিটের মাথায় ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। তবে, ক্রিকেটের মতো ফুটবলও যে অনিশ্চয়তার খেলা সেটা প্রমাণিত হয়েছিল এই বিশ্বকাপে। জ্বলে ওঠার জন্য ফাইনাল ম্যাচকেই বেছে নিয়েছিলেন হেল্মুট রান। দু' মিনিট পর দশ মিনিটের মাথায় ম্যাক্স মোরালক্স ব্যবধান কমালেন। ১৮ মিনিটের মাথায় হেলমুট রান গোল করে সমতায় আনেন পশ্চিম জার্মানিকে। এই গোলটি ছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে অন্যতম সেরা গোল। গ্রুপ পর্বে ৮-৩ ব্যবধানে হেরে যাওয়া হাঙ্গেরির সামনেও ওই ম্যাচে রুখে দাঁড়িয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। তবে কিছুতেই কিছু লাভ হচ্ছিল না।

তবে, সুসময়ের চাকা ছিল জার্মানির পথেই। ৮৪ মিনিটে স্রোতের বিপরীতে অধিনায়ক ওয়াল্টারের কর্নার কিক থেকে আলতো টোকায় হাঙ্গেরির জালে বল পাঠিয়ে দেন জার্মানির ফাইনালের হিরো হেলমুট রান। ৮৬ মিনিটের মাথায় পুস্কাস সেই গোল ফেরত দিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই অঘটন ঘটায় অফসাইড! এই জালে পড়েই বিশ্বকাপ ছিটকে যায় পুস্কাসে হাত থেকে। আর জার্মান দলের প্রথম মহানায়ক হয়ে রইলেন ওয়ালটার।

২. ২০১০ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার বিতর্কিত গোল

হ্যান্ড অব গড থেকে শুরু করে অনেক কিছুই জড়িয়ে রয়েছে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযানের সঙ্গে। তবে, ২০২২ সালে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যে দলটি অফসাইড ট্র্যাপে পড়ে বারবার রেফারির কাছে আবেদন জানিয়েছে, সেই একই দল কিন্তু ২০১০ আফ্রিকা বিশ্বকাপে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে করেছিল অফসাইডে গোল। সেই বিশ্বকাপে মেক্সিকো বনাম আর্জেন্টিনার ম্যাচে ২৫ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড কার্লোস তেভেজ ১-০ গোলের ব্যবধানে এগিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। তবে গোল করার সময় তেভেজ ছিলেন পুরোপুরিভাবে অফসাইড কারণ সেই সময়ে মাঠের একেবারে শীর্ষে দৌড়াচ্ছেন মেসি। তবে, ভার বা অন্যান্য অত্যাধুনিক কিছু প্রযুক্তি সেই সময় ছিলই না বলতে গেলে। তাই কিছু করার ছিল না মেক্সিকোর।

৩. ১৯৮৬ বিশ্বকাপ, বেলজিয়ামের জোড়া অফসাইড গোল

১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার ম্যাচে কী হয়েছিল তো প্রত্যেক ফুটবলপ্রেমীই জানেন। তবে বেলজিয়াম বনাম রাশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটিও কম বিতর্কের ছিল না। শুরু থেকেই সোভিয়েত রাশিয়া ছিল বেলজিয়ামের থেকে অনেকখানি এগিয়ে। তারা ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল বেলজিয়ামের থেকে। কিন্তু সেই ম্যাচটি জিতে যায় বেলজিয়াম, তাও আবার দু'টি অফসাইড গোলের দৌলতে।

ম্যাচের ৭৭ মিনিটের মাথায় বেলজিয়ামের ফরওয়ার্ড জান কুয়েলেমানস গোল করে সমতা ফিরিয়েছিলেন বেলজিয়ামের। তবে সেই সময় ৫ গজ অফসাইডে ছিলেন তিনি। সেই সময় যদি ভার প্রযুক্তি থাকত তাহলে হয়তো ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ছবিটা অন্যরকম হতে পারত।

৪. ইউরো ২০২০ - করিম বেনজিমার গোল বাতিল

২০২০ সালের ইউরো কাপে জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ম্যাচে এই অফসাইডের ফাঁদে পড়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের এই মুহূর্তে সবথেকে ভরসাযোগ্য খেলোয়াড় করিম বেনজিমা। কয়েক ইঞ্চির জন্য তিনি অফসাইড ছিলেন আর সেই কারণেই বাতিল হয়ে যায় গোল। আর ওই একটি অফসাইডের দৌলতেই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল ২০২০ সালের ইউরো কাপের ভাগ্য।

More Articles