মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?
Saudi Arabia Vs Argentina World Cup 2022: একই ম্যাচে প্রায় ৬টি গোল হওয়ার মতো লক্ষ্য ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি।
শুরুতেই শেষ! মুহূর্তেই চুরমার মেসি ম্যাজিক! একটিমাত্র গোল আর একাধিক ব্যর্থতা দিয়েই, বালির দেশের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সন্তষ্ট থাকতে হল আর্জেন্টিনীয় ভক্তদের। উচ্ছাস শেষ হল নিমেষেই। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধেই ধূলিসাৎ হলেন লিওনেল মেসি, লিসান্দ্র মার্টিনেজ, পাপু গোমেজরা। ২-১ গোলে হেরে গেল এই দল। ম্যাচের শুরুতেই মেসির কেরামতি এবং এমিলিয়ানো মার্টিনেজের যোগ্য সঙ্গতে যে আশার আলো দেখাচ্ছিল আর্জেন্টিনা। তার মধ্যেই প্রত্যাশিত জয়ের আশায় সাপে বর হয় রেফারির সিদ্ধান্ত। পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল পোস্টে লক্ষ্য পূরণ করেন মেসি।
কিন্তু তারপর! মাত্র ১০ মিনিটের তীব্র লড়াই ঝড়ের মতো উড়িয়ে দিলেন সৌদি আরবের ফুটবলাররা। আর সেই ঝড়ের মূল রসদ হয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে একেন একজন! প্রবল পরাক্রম আর মারাত্বক গতির প্রতিপক্ষের সামনে স্তম্ভ হলেন তিনি একাই! মুহূর্তেই প্রায় অর্ধশততম স্থানে থাকা একটি দলকে বিশ্বকাপের শুরুতেই করে তুললেন অভিনব-অনন্য-অনবদ্য।
তিনি কে? এই সৌদি আরবীয় স্তম্ভের নাম মহম্মদ আল ওয়েস (Mohamed Al Owais Saudi Arabia)। সৌদি আরবের জাতীয় ফুটবল দলের গোলকিপার। বিশ্বকাপ ফুটবলের নতুন নক্ষত্র। ৮ মিনিট অতিরিক্ত সময়, একের পর এক খেলোয়াড় পরিবর্তন এবং মারাদোনার দেশের বিখ্যাত সব মুখের সামনেও লড়াই দেখালেন তিনি। মাত্র এক বার ফস্কে গেলেও এই গোলকিপার হয়ে উঠলেন মেসিদের সুনামি রুখে দেওয়ার বাধ। প্রত্যেক মুহূর্তে আর্জেন্টিনার কঠিন রক্ষণ আর গোল করার বাসনায় জল ঢেলে দিলেন তথাকথিত কম পরিচিত এই ফুটবলার। কিন্তু তাঁর মাঠের রেকর্ড বলছে অন্য কথা।
আরও পড়ুন: ‘ছোটো’ টিমের কাছে হেরে ভূত মেসির আর্জেন্টিনা! এই বিশ্বকাপেও ট্র্যাজিক পরিণতি?
মহম্মদ আল ওয়েস
ভালো নাম মহম্মদ বিন খালিদ বিন ইব্রাহিম আল ওয়েস। আরবের মাটিতে ওয়েসের জন্ম হয় ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর। জন্মসূত্রে তিনি আরবের। পূর্ব সৌদি আরবের আল হাসায় জন্ম নেন ৩১ বছরের মহাম্মদ। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই চাইতেন ভালো খেলোয়াড় হতে। সেটা যে ফুটবল, এমন ভাবেননি কখনও। বরাবর ব্যক্তিগত জীবনের কথা প্রকাশ্যে না আনতে চাওয়া এই ফুটবলার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি সকার এবং ফুটবল, এই দুটি খেলার দিকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বারবার। ২০১০ সাল নাগাদ ওয়েস পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন ফুটবলে।
এরপর প্রশিক্ষণ। পাড়ায় পাড়ায় খেলা, বিভিন্ন ছোট ছোট ক্লাব ফুটবলে অংশ নেওয়ার সময়ই নজরে আসেন তিনি। আর কেরিয়ারের জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কর্ম হিসেবে ফুটবল
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তাঁর ছোটবেলার ইচ্ছাপূরণ ঘটে। আল ওয়েস সুযোগ পান সৌদি আরবের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব আল আহিলে। যদিও তার আগেই ২১ বছরের এই খেলোয়াড়ের যোগাযোগ ছিল আল শাহবাব নামের একটি ক্লাবের সঙ্গে। ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সেখানেই জড়িত থাকেন তিনি। এই সময়ে ওয়েসের অনবদ্য রক্ষণ, একের পর এক গোল না হতে দেওয়ার চেষ্টা নজর কাড়তে শুরু করে। জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসেন তিনি।
জাতীয় দলে সুযোগ
বরাবর মারাদোনার ভক্ত ওয়েস ২০২২ সালের জানুয়ারির ৩১ তারিখ সৌদি আরবের জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রায় ৭০০ ইউরো ব্যয়ে তাঁকে দলে নেয় আল হিলালের নির্বাচকরা। তারপর থেকে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। যদিও বিশ্বকাপের প্রস্তুতি তাঁর জীবনে শুরু হয় ২০১৮ থেকেই। আল ওয়েসের ইতিহাসে একাধিক খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ঘটনা ঘটায়, তিনি একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন একদিন জাতীয় দলে খেলবেন।
সফল কেরিয়ার
মেসি, রোনাল্ডো নন, মারাদোনার পর তিনি বরাবর অনুসরণ করেছেন রোনাল্ডিনহোকে। গোলকিপার হয়ে ওঠা শুধু নয়, একজন সার্থক ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে উঠতে আল ওয়েস বারবার শরণ নিয়েছেন ব্রাজিলীয় তারকার।
প্রায় ৬ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার বিশালাকায় এই ফুটবলারের অবসর সময়ের পছন্দ বই পড়া। পছন্দের বই লা ইনভেশন। সঙ্গে সিনেমা দেখতেও ভালো বাসেন তিনি। খ্রিস্টান ধর্মপ্রিয় এই খেলোয়াড়ের প্রিয় খাবার আরবীয় ডালমেটিয়ান। পোষ্য হিসেবে রয়েছে কুকুর। এমনকি ঘুরতেও পছন্দ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকে খানিকটা ব্যক্তিগত থাকতে পছন্দ করেন ওয়েস। সুদর্শন এই জনপ্রিয় ফুটবল তারকার আরবীয় ভক্তকূলে বিপুল মহিলা ভক্ত থাকলেও একাধিক জল্পনার মধ্যেও তিনি জড়াননি কোনও সম্পর্ক বিতর্কে। বরাবর খেলাকেই ধ্যানজ্ঞান করে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি।
বিশ্বকাপে আল ওয়েস
মাত্র কয়েকমাস আগেই জাতীয় দলের চুক্তিবদ্ধ হলেও ওয়েসের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপে নজির সৃষ্টি করা। গ্রুপ পর্বের খেলায় প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনার মতো কঠিন দল হলেও তাঁকে নিয়েও আলোচনা ছিল আগে থেকেই। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, আল ওয়েস প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, তাদের গোলের পথ বন্ধ করতে যথেষ্ট কার্যকরি ভূমিকা নিতে সমর্থ। সৌদি আরবের খানিকটা নড়বড়ে রক্ষণশক্তির ক্ষেত্রে গোলকিপার হিসেবে তাঁর কাজ নজর কাড়তে পারে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী খুব একটা মিথ্যা হতে দেননি তিনি। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই মেসি ম্যাজিক সহ আর্জেন্টিনার বিরাট পরাক্রম ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি একাই। বারবার গোলের কাছাকাছি গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে আর্জেন্টিনা। একবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি ওয়েস। প্রায় ৯৮ মিনিটের ম্যাচের পুরোটাই দাপিয়েছেন তিনি। সহযোদ্ধা আল সেহরির ৪৮ মিনিটের মাথায় গোল, ৫৩ মিনিটেই আল দাওয়াসারির গোলযাপন যেমন সৌদি আরবকে এগিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনই এই নেপথ্য নায়কদের ভূমিকায় অবাক হয়েছে বিশ্ব। রেফারির ভূমিকা, পেনাল্টি কর্নার থেকে একটি মাত্র গোল এবং আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করে একাধিক বিতর্কের মধ্যেও খেলার সম্পূর্ণ সময় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গিয়েছেন ওয়েস। উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক বল রক্ষা করেছেন তিনি। গোল হতে হতেও ব্যর্থ হতে বাধ্য করেছেন বিপরীত দলের খেলোয়াড়দের।
ঠিক এখানেই ফের জল্পনা শুরু হয়েছে। এল কান্নো, আল ফারাজের সঙ্গেই দমিয়ে দিয়েছেন মেসিদের। একই ম্যাচে প্রায় ৬টি গোল হওয়ার মতো লক্ষ্য ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর ১৫ বার আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের পায়ের লক্ষ্যকে হারিয়ে দিয়েছেন ওয়েস।
যে প্রতিভার বিকাশ ঘটছিল ৭ বছর আগে থেকেই। প্রত্যেক মুহূর্তে এক একটি ক্লাবের সঙ্গে খেলায় ওয়েস চিনিয়ে দিচ্ছিলেন জাত। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর একাধিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই প্রাকটিস চলত নিরন্তর। বারবার গোল রক্ষার পথেই এগোতেন তিনি। তথাকথিত প্রান্তিক অঞ্চল থেকে উঠে আসা নিপীড়িত জাতির এক সন্তানের এই লড়াই উদ্বুদ্ধ করেছিল আরব সভ্যতাকে। এবার প্রমাণ করলেন তিনি। শক্ত বিতর্ক আর শত শত জল্পনার মধ্যেই জাত দেখালেন এই আরবীয় কোবরা!