নেশায় ডুবে ভূস্বর্গের নতুন প্রজন্ম, নেপথ্যে রয়েছে সন্ত্রাসের ছক?

'নারকো টেরর ইন কাশ্মীর’, অর্থাৎ ড্রাগ আসক্তির সন্ত্রাস চলছে কাশ্মীরে। প্রতি ঘণ্টায় একজন করে মাদকাসক্ত ভর্তি হন নেশামুক্তি কেন্দ্রে। যার মধ্যে অধিকাংশ স্কুল এবং কলেজপড়ুয়া।

তখনও ভারী বুটের শব্দে ঘুম ভাঙত উপত্যকার। নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গোলাগুলির শব্দ। রাস্তায় সাঁজোয়া গাড়ির লাইন। ভবিষ্যতের চিহ্নমাত্র দেখতে পেত না তরুণরা। এরপর সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল। উন্নয়নের বার্তা দিয়ে দিনবদলের আশ্বাস। আদৌ কি পরিবর্তন হয়েছে? বোধহয় না। ভূস্বর্গে একটা প্রজন্ম ড্রাগ, হেরোইনে নিমজ্জিত। সাম্প্রতিক এই গবেষণায় যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে।

কী বলছে গবেষণা
'নারকো টেরর ইন কাশ্মীর’, অর্থাৎ ড্রাগ আসক্তির সন্ত্রাস চলছে কাশ্মীরে। প্রতি ঘণ্টায় একজন করে মাদকাসক্ত ভর্তি হন নেশামুক্তি কেন্দ্রে। যার মধ্যে অধিকাংশ স্কুল এবং কলেজপড়ুয়া। এই আসক্তদের মধ্যে আবার এক তৃতীয়াংশ মহিলা। এমন তথ্য উঠে এল সংবাদমাধ্যম নিউজ ১৮-এর একটি প্রতিবেদনে। প্রশাসনের দাবি, উপত্যকায় এই মাদকাসক্তির পিছনে রয়েছে পাকিস্তানের পরিকল্পিত ছক। তাই একে 'নারকো টেরর’ বলা হচ্ছে।

রাজ্য সরকার যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার ২.৮ শতাংশ জনগণ নিয়মিত ড্রাগে আসক্ত। ৫২,৪০৪ সংখ্যার বিশাল জনগণ ড্রাগের ওপর নির্ভরশীল সরাসরি। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ হেরোইনে আসক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমবয়সিরা এইভাবে নেশায় ডুবে গেছে।

আরও পড়ুন: নতুন অশোক স্তম্ভ ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক, যে শিল্পী বানালেন এই মূর্তি

সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড ডিরেক্টরেট অফ হেলথ-এর সঙ্গে একযোগে একটি সমীক্ষা চালায় রাজ্য সরকারের সংগঠন- ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, শ্রীনগর। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, তাঁরা আগেই এরকম একটা বিষয়ে সন্দেহ করেন, তারপর তাঁরা ১০ জেলায় সমীক্ষা চালান। সমীক্ষার যে ফল তাঁদের হাতে এসেছে, তাতে তাঁদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়!

সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেকার ও চাকরিহীনদের মধ্যে ড্রাগ নেওয়ার প্রবণতা বেশি। এই প্রতিবেদনের দাবি, ২০১৬ সালে শ্রীনগরে সরকারি মেডিক্যাল কেলেজে ওএসটি সেন্টারে ৪৮৯ জন ড্রাগাসক্ত ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজারে। ২০১৯ সালে সেটা হয় ১০ হাজার। সব মিলিয়ে গত ৫ বছরে জম্মু-কাশ্মীরে নেশাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে ২,০০০ শতাংশ।

স্বাভাবিকভাবে, এই পরিসংখ্যানে উদ্বিগ্ন জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। তাদের আরও যা ভাবাচ্ছে, তা হলো নেশাসক্তের বয়স। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সের স্কুলপড়ুয়ারা হেরোইনের নেশায় বুঁদ হচ্ছে। নেশামুক্ত কেন্দ্রে থাকা এই রোগীদের সবার আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কেউ উচ্চবিত্ত পরিবারের, তো কেউ সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের। উপত্যকাজুড়ে হেরোইন-আসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান প্রজন্ম এভাবে নেশায় বুঁদ হচ্ছে কেন? তারা কোনও ভবিষ্যতের ঠিকানা দেখতে পাচ্ছে না বলেই কি এভাবে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে? মোদি সরকারের প্যাকেজ-পরিসংখ্যান বেশ চমকে দেওয়ার মতো। তাতে কি উপত্যকার মানুষের জীবন বদলাচ্ছে না?

পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র
এর পিছনে পাকিস্তানের পরিকল্পিত ছক দেখছে প্রশাসন। গোয়েন্দা সূত্রে তেমনটা খবর পাওয়া গেছে বলে দাবি। সম্প্রতি মনে করা গিয়েছিল, উপত্যকায় জঙ্গি দৌরাত্ম কমেছে, কিন্তু বলাই যায়, সন্ত্রাসের এটি অন্য চেহারা। প্রশাসন বলছে, সীমান্ত দিয়ে আফিম ও চারাচালান বেড়েই চলেছে। এক নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো-র আধিকারিকের কথায়, বিশ্বের ৯০ শতাংশ আফিম উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। সেগুলি পাঠানো হয় পাকিস্তানে। পাক ব‍্যবসায়ীদের একাংশ সেসব মাদক চালান করেন কাশ্মীরে। অবশ্য প্রশাসন আমদানি হওয়া দ্রব্যে নজরদারি শুরু করেছে। পুলিশ প্রশাসনের দাবি, পাক মাটিতে ঘাঁটি গাড়া কিছু জঙ্গি সংগঠন রয়েছে এই হেরোইন চক্রের পিছনে। উপত্যকায় পাকড়াও হওয়া বহু জঙ্গির কাছ থেকে অস্ত্র ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে হেরোইনের প্যাকেট।

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে মারণ হামলা চালিয়েছিল জইশ-ই-মহম্মদ। পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলায় ঝরে গিয়েছিল দেশের ৪০ জন জওয়ানের প্রাণ। ভারত এর জবাব দিতে দেরি করেনি। পুলওয়ামা হামলার ১২ দিন পর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে এয়ারস্ট্রাইক চালিয়েছিল বলে দাবি করেছিল।

এখন কাশ্মীরে নারকো টেরর স্ট্রাইকের পিছনে কোনও সন্ত্রাসী ছক কাজ করছে কি না, তা তদন্ত বলবে।

৩৭০ ধারা বাতিল ও উন্নয়ন?
কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর আদৌ কি উপত্যকার উন্নয়ন হয়েছে? এখন কি ভূস্বর্গের ঘুম ভাঙে টিউলিপের গন্ধে? না কি বারুদ এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে? কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে যে তথ্য দেয়, তাতে কাশ্মীরবাসী খুশিতে আত্মহারা হতেই পারেন। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর প্রধানমন্ত্রী মোদির উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় দেওয়া চাকরি পেতে ২১০৫ জন অভিবাসী কাশ্মীর উপত্যকার ফিরে এসেছেন। সম্প্রতি রাজ্যসভায় এই তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে মন্ত্রী জানান, প্রধানমমন্ত্রীর উন্নয়নের প্যাকেজের অধীনে ২০২০-'২১ সালে মোট ৮৪১টি নিয়োগ করা হয়েছে। ২০২১-'২২ সালে ১২৪৬টি নিয়োগ করা হয়েছে। যতই সরকার এই দাবি করুক, বিরোধীরা অন্য দাবি করছে।

নরেন্দ্র মোদি সরকার সংসদের উভয় কক্ষের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ বিলোপ করে। ফলে স্বতন্ত্র রাজ্যের পরিবর্তে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা হারিয়েছে।

বিরোধীদের দাবি, এর ফলে কাশ্মীরে বেড়েছে বন্দুকবাজের ঘটনা। ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০৩ জন সন্দেহভাজনক জঙ্গি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৬ জনই স্থানীয়। এরা সকলেই প্রকৃতই সন্ত্রাসী কি না, তাই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কিছু মানবাধিকার সংগঠন।

ভারত সরকার বলছে, ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরে উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীদের দাবি, এরপর কোনও উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টে ধস নেমেছে পর্যটনশিল্পে, যেটা এতদিন ছিল ভূস্বর্গের স্বম্পদ। বিরোধীদের দাবি, ২০১৯ সালের পর থেকে ৫ লক্ষ কাশ্মীরি চাকরি হারিয়েছেন।

পাকিস্তান ড্রাগের মোড়কে সন্ত্রাস রপ্তানি করছে কি না, কিংবা উন্নয়নের নামে সরকার 'ফাঁকা আওয়াজ’ দিচ্ছে কি না, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। মোদ্দা কথা হলো, এর মাশুল দিতে হচ্ছে উপত্যকার নবীনদের। তারা কোনও ভবিষ্যতের দিশা দেখতে পাচ্ছে না। তাই কি নেশার ঘোরে ডুবে যাচ্ছে একটা প্রজন্ম?

More Articles