দেশের সেরা শিল্পী রাস্তায়, মাটিতে লুটোচ্ছে পদ্মশ্রী, এর নাম আচ্ছে দিন?

২০২০ সালের ২০ নভেম্বর বিরজু মহারাজ এবং চিত্রশিল্পী যতিন দাসের মতো পদ্ম পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পীদের নোটিস পাঠিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারি বাসস্থান খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় দিল্লি হাই কোর্ট। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে ‘অমানবিক’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন অনেকেই, ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সরকারি নোটিসপ্রাপ্ত শিল্পীরা। এবার ফের ‘অমানবিক উচ্ছেদ’-এর অভিযোগ উঠল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিককালে ভাইরাল হওয়া এক ছবিতে পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী গুরু মায়াধর রাউতকে তাঁর বাসভবন থেকে উচ্ছেদ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে, এঁদের সরকারি বাসভবনে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল, তাই এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা নির্বিচারে মায়াধরের বেশ কিছু জিনিসপত্র রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছেন। এমনকী, তাঁর পদ্মশ্রী সম্মাননাও রাস্তায় ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। সমগ্র ঘটনার জেরে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মায়াধরের কন্যা মধুমিতা রাউত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ৯০ বছরের এক অসুস্থ শিল্পীকে এভাবে হেনস্থা হতে হল কেন? 


রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে দিল্লির ‘এশিয়ান গেমস ভিলেজ’-এ সরকারি আবাসন লিজ দেওয়া হয়েছিল মায়াধর রাউতকে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী কোটায় আবাসন পেয়েছিলেন আরও তিরিশজন পদ্ম পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কেন্দ্রের অভিযোগ, ২০১৪ সালেই সেই লিজের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে। তারপরেও প্রায় ৮ বছর সরকারি আবাসনে অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন কোনও কোনও শিল্পী। ইতিমধ্যে তাঁদের আবাসন খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নোটিস পাঠায় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু সেই নোটিসের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মায়াধর এবং আরও কয়েকজন শিল্পী আদালতের দ্বারস্থ হন। যদিও সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় তাঁদের পরাজয় ঘটে। 

আদালতে পরাজয়ের পর মায়াধর এবং অন্যান্য শিল্পীদের ২৫ এপ্রিলের মধ্যে সরকারি আবাসন ফাঁকা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কেন্দ্রের অভিযোগ, আদালতের নির্দেশের পরেও মায়াধর-সহ ৮ জন শিল্পী সরকারি আবাসন ছাড়তে অস্বীকার করেন। কেন্দ্রের বক্তব্য, এর ফলে বাধ্য হয়ে তাঁদের উচ্ছেদের পদক্ষেপ নিতে হয়। মায়াধরের কন্যা মধুমিতা জানিয়েছেন, ২৬ মে সকালে হঠাৎ করেই একদল পুলিশ নির্বিচারে তাঁদের জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলতে আরম্ভ করেন। তাঁদের কাছে উচ্ছেদের আইনি নোটিস চাওয়া হলে তা দেখাতে অস্বীকার করেন তাঁরা। পুলিশের এমন আচরণের ফলে সংবাদমাধ্যমের কাছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেছেন মধুমিতা। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর বাবা শিষ্যদের তালিম দিয়ে কোনওরকম অর্থ উপার্জন করেননি, শিষ্যদের ভারতীয় গুরু-শিষ্য পরম্পরায় তালিম দিতেন মায়াধর। তিনি এও জানিয়েছেন, তাঁর বাবার নিজস্ব কোনও জমি বা বাড়ি নেই এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাত্র তিন হাজার টাকা পড়ে আছে। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার এমন ‘অবিবেচক’-এর মতো সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। 

আরও পড়ুন: স্বাধ্বী প্রজ্ঞা বললে সাত খুন মাফ, বাক-স্বাধীনতা নেই জিগনেশের? কেন গ্রেফতার!

মায়াধরের উচ্ছেদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিক মহলের একাংশ। তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার তাঁর টুইটে মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সমগ্র ঘটনায় রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন মায়াধরের কন্যা। তিনি মনে করেন, কংগ্রেস আমলে সরকারি আবাসনে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন  বলেই মায়াধরের বিরুদ্ধে এমন অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার। 


ইতিপূর্বে করোনা পরিস্থিতিতেই বিরজু মহারাজের মতো শিল্পীদের সরকারি আবাসন খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। সেবারও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পদ্মভূষণপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী যতিন দাস। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি ‘এসিয়েড ভিলেজ’-এর সরকারি আবাসনের বাসিন্দা ছিলেন। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ফলে প্রবল সমস্যায় পড়তে হয় তাঁকে। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মতো বহু শিল্পী সরকারের বিভিন্ন কমিটিতে দীর্ঘদিন ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে রাতারাতি বাড়ি খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তাঁদেরকেই বিপদের মুখে ঠেলে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের কাছ থেকে দেশের শিল্পীদের কি এই আচরণই প্রাপ্য? প্রশ্ন থেকে যায়।

More Articles