স্বাধ্বী প্রজ্ঞা বললে সাত খুন মাফ, বাক-স্বাধীনতা নেই জিগনেশের? কেন গ্রেফতার!
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সালটা ২০১৯। লোকসভায় বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে ‘দেশভক্ত' বলেন। এই নিয়ে সেই সময় তোলপাড় হয় সংসদ ও সংসদের বাইরে। সেই কথা আবার মাথাচাড়া দিল। কারণ জিগনেশ মেবানি মোদির সমালোচনা করে গ্রেফতার হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনা বাক্-স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাক্-স্বাধীনতা কি এই দেশে সবার জন্য একরকম নয়?
১৯৪৮ এর ৩০ জানুয়ারি। ভিড়ের মাঝে গর্জে উঠল গডসের বন্দুক। নিমেষে ঝাঁঝরা জাতির পিতা। পরে হত্যার অপরাধে ফাঁসি হয় গডসের। এহেন গডসেরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজও। মহারাষ্ট্রে এক সভায় গডসেকে গান্ধীর মতোই দেশপ্রেমিক বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ব্যাপক জয়ের পর, উন্নাও কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী সাক্ষী মহারাজ পার্লামেন্ট হাউসের বাইরে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার বিশ্বাস নাথুরাম গডসে একজন জাতীয়তাবাদী এবং মহাত্মা গান্ধীও জাতির জন্য অনেক কিছু করেছেন। গডসে ছিলেন একজন ক্ষুব্ধ মানুষ। তিনি কিছু ভুল করতে পারেন কিন্তু দেশবিরোধী ছিলেন না। তিনি একজন দেশপ্রেমিক।”
আরও পড়ুন-উমর খালিদের বক্তব্য কি সত্যিই উসকানিমূলক? মনে করেন না অনেকেই
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা সংসদের দুই কক্ষেই এ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা সাক্ষী মহারাজের ক্ষমাপ্রার্থনারও দাবি তোলেন। লোকসভায় দুঃখপ্রকাশ করতে হয় সাক্ষী মহারাজকে, “আমি সংসদ ও দেশের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি… আমি ওঁকে দেশপ্রেমিক বলে মনে করি না। আমি সম্ভবত ভুল করে বলে ফেলেছি।” বিরোধীদের চাপে পড়ে সাক্ষী মহারাজ ঢোক গিললেও বিজেপির বিভিন্ন তাবড় নেতা বিভিন্ন সময়ে গডসের বন্দনা করেছেন। কার্যত এর মূল্য চোকাতে হয়নি তাঁদের।
কেন পুরনো কাসন্দি ঘাটবার প্রয়োজন হল?
কারণ সম্প্রতি মধ্যরাতে গুজরাতে গ্রেফতার হন দলিত নেতা জিগনেশ মেবানি। অসম পুলিসের একটি দল তাঁকে গ্রেফতার করেছে। সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনায় একাধিক টুইট করেছিলেন জিগনেশ। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্ন হল বিজেপি নেতারা গডসের বন্দনা করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন! আর কণ্ঠ ছাড়ার মাশুল দিতে হল এক দলিত নেতাকে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের এই কী চেহারা!
গুজরাতের বিধায়ক তথা দলিত নেতা জিগনেশ রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চের আহ্বায়ক। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার যে দিন কংগ্রেসে যোগ দেন, সে দিন গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টিকে সমর্থন জানান জিগনেশও। তাঁর অনুগামীরা জানিয়েছেন, বুধবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ পালানপুর সর্কিট হাউস থেকে জিগনেশকে গ্রেফতার করে অসম পুলিস। গ্রেফতারির সময় পুলিস এফআইআর-এর কোনও প্রতিলিপি দেখাতে পারেনি বলে অভিযোগ। তা নিয়ে কংগ্রেস নেতা-সমর্থকরা চেপে ধরলে সাম্প্রতিক টুইটের জেরে জিগনেশের বিরুদ্ধে মামলার নথি দেখায় তারা। এর পর রাতেই জিগনেশকে আহমেদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। জানা গেছে, সেখান থেকে ট্রেনে চাপিয়ে অসমের গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এ ভাবে জিগনেশকে গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হওয়া এই তরুণ তুর্কি বরাবরই সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় সরকার, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-সহ একাধিক ধর্মীয় কট্টরপন্থী সংগঠনের বিরুদ্ধে সরব হন তিনি। অভিযোগ, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক একাধিক টুইট করেছিলেন জিগনেশ। অভিযোগ পেয়ে তাঁর সেই সমস্ত টুইট মুছেও দেয় টুইটার কর্তৃপক্ষ।
অসমের কোকরাঝরের ভবানীপুরের বাসিন্দা, জনৈক অনুপকুমার দে-র অভিযোগের ভিত্তিতে জিগনেশকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ১২০-বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র), ১৫৩-এ (দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতায় ইন্ধন জোগানো), ২৯৫-এ (ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানা), ৫০৪ (শান্তিভঙ্গের লক্ষ্যে উস্কানিমূলক মন্তব্য) ৫০৬ (অপরাধমূলক ভাবে ভয় দেখানো) ধারায় এবং তথ্য প্রযুক্তি আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, তিনি এই বিষয়ে কিছু জানেন না। কোথা থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রশ্ন আসছে?
দিল্লির জেএনইউর ‘আজাদি’ বিতর্কের সময় কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদের সঙ্গে শিরোনামে এসেছিলেন জিগনেশ মেবানিও। প্রাক্তন সাংবাদিক জিগনেশ পরবর্তী সময় রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চের আহ্বায়ক হন। নির্দল হিসেবে ভোটে লড়াই করে গুজরাতের বিধায়কও হন এই সমাজকর্মী। তবে ২০২১ সালে কানহাইয়া কুমারের সঙ্গে একই মঞ্চ থেকে কংগ্রেসকে সমর্থনের ঘোষণা করেন এই তরুণ তুর্কি। বছর শেষেই যখন মোদির রাজ্যে নির্বাচন, তার আগে এই তরুণ তুর্কির গ্রেপ্তারির জেরে একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার দিনটিকে যখন গোটা দেশ 'শহিদ দিবস' হিসেবে পালন করেছে, তখনই বাপুর হত্যার সেলিব্রেশনে মেতে ওঠে উত্তরপ্রদেশের হিন্দু মহাসভার কয়েকজন সদস্য। গান্ধীজির ছবিতে গুলি করে তার ভিডিয়ো রেকর্ড করে রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক পূজা শকুন পাণ্ডে। সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরই পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। প্রশ্ন হল জাতির জনকের হত্যাকারীকে বারবার `দেশভক্ত’ হিসেবে মাথায় তুলে রেখেছে বিজেপি ও তার সহযোগী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। তারপরেও তাঁদের বহাল তবিয়েতে থাকার নজির দেখা যায়। যোগীর রাজ্যে হিন্দু মহাসভার এই ঘটনা কি হিংসার নামান্তর নয়? তাহলে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে কেন কাঠগড়ায় উঠতে হবে জিগনেশকে?
কিন্তু এরপরেও জিগনেশকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হওয়ার মাশুল দিতে হয়। পুলিস কোনও সদুত্তর না দিতে পেরে তাঁকে গ্রেফতার করে। সবেমাত্র ভারত থেকে ঘুরে গেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাঁর অফিস বারবার ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আখ্যা দিয়েছে। জিগনেশের গ্রেফতারি কি ঘুণ ধরা গণতন্ত্রকে তুলে ধরল না? জাতির জনকের হত্যাকারী যে দেশে বন্দিত, সেখানে জিগনেশের বিচার পাওয়ার আশা উজ্জ্বল না ক্ষীণ? দেখা যাক।