দলে নড়বড়ে হলেই শুরু রিসর্ট-রাজনীতি, এই ধারার শেষ কোথায়
কোনও বিশেষ দল নয়, প্রায় সব জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলই নতুন নতুন রিসর্ট রাজনীতির অধ্যায় সংযোজিত করছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়।
পশ্চিমবঙ্গ এখনও এই ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছে। ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পশ্চিমের রাজ্যগুলো গা ভাসিয়েছে রিসর্ট রাজনীতিতে। ভারতের বহুদিনের ট্র্যাডিশন এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। হঠাৎ করে আবার আলোচনায় রিসর্ট রাজনীতি। সৌজন্যে মহারাষ্ট্র। ঘোর সংকটে উদ্ধব ঠাকরের সরকার। শোনা যাচ্ছে, অনুগামীদের নিয়ে মোদির রাজ্যে কোনও এক হোটেলে গা ঢাকা দিয়ে আছেন একনাথ শিন্ডে। আর এরপরই আবার সেই রিসর্ট রাজনীতি সামনে এল। হালফিল বিধানসভা নির্বাচন বা রাজ্যসভার ভোটেও এই রিসর্ট রাজনীতির সাক্ষী থেকেছে দেশ।
রাজস্থান
আশঙ্কা ছিল, মধ্যপ্রদেশের পর এবার কি বিজেপির পাখির চোখ রাজস্থানের দিকে? আর সেই আশঙ্কার কেন্দ্রে কংগ্রেসের রিসর্ট রাজনীতি। রাজস্থানের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলতের অভিযোগ, বিধায়ক কেনা-বেচা শুরু করতে চাইছে ভারতীয় জনতা পার্টি। দলবদলের জন্য বিধায়কদের ২৫ কোটি টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ ছিল বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ ছিল, বিধায়কদের ওপর আস্থা নেই কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বের। তবে ঝুঁকি নিতে চায়নি কংগ্রেস। দলের সমস্ত বিধায়ককে জয়পুরের রিসর্টে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কংগ্রেস বিধায়কদের সেখানে যোগাসন করানো হয়েছিল। দেখানো হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর ওপর তৈরি সিনেমা। এটা যে শুধু কংগ্রেসের সংস্কৃতি, তা কিন্তু না। বিরোধী দল বিজেপিও তাদের বিধায়কদের রিসর্টে নিয়ে তুলেছিল।
২০২০-র জুলাইয়েই কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী সচিন পাইলট। তাঁর সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন ১৮ জন কংগ্রেস বিধায়ক। বাকি বিধায়কদের বাঁচাতে সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট তাঁদের নিয়ে তুলেছিলেন ফেয়ারমন্ট হোটেলে। পাইলট আবার অনুগামীদের নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন বিজেপি-শাসিত হরিয়ানায়। সেই সময় রটেছিল, পাইলট বিজেপির দরজা ধাক্কাচ্ছেন। পরে অবশ্য তা সত্যি প্রমাণিত হয়নি।
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে সরকার ভাঙতে চাইছে বিজেপি? শিবসেনার অন্তর্দ্বন্দ্বে যে জল্পনা উঠে আসছে
মধ্যপ্রদেশ থেকে শিক্ষা
মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যও অনেকটাই নির্ভর করেছিল রিসর্ট রাজনীতির ওপর। ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশের বেশ কয়েকজন কংগ্রেস বিধায়ককে এক বিজেপি বিধায়কের তত্ত্বাবধানে বেঙ্গালুরুতে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। তখনই ঘোর অনিশ্চয়তা দেখা যায় কমলনাথ সরকারের ভবিষ্যত নিয়ে। প্রথমে বেশ কয়েকজন বিধায়ক নিয়ে শিবির বদল করেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। তারপরই পড়ে যায় কমলনাথ সরকার। এরপর রাজস্থানের ক্ষেত্রে আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি কংগ্রেস।
গোয়া, উত্তরাখণ্ড
গত বিধানসভা নির্বাচনে গোয়া আর উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস এবং বিজেপি সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে। কংগ্রেস তার প্রার্থীদের নির্বাচনের ঠিক পরেই উত্তর গোয়ার রিসর্টে সরিয়ে নিয়েছিল। দলের দাবি ছিল, বেশ কয়েকজন নেতার জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান আছে। তাই সরানো হয়েছে। একই জিনিস দেখা গেছে উত্তরাখণ্ডেও। সেখানে কংগ্রেসের প্রার্থীদের কর্নাটকে সরানো হয়েছিল। দায়িত্বে ছিলেন দলের পুরনো এবং বিশ্বস্ত ভরসা ডিকে শিবকুমার।
মহারাষ্ট্র
২০১৯ সালে মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-এনসিপি-র সঙ্গে সরকার গঠনের জন্য শিবসেনা বিজেপির হাত ছাড়ার পর বেশ কয়েকদিনের জন্য নাটক চলে। সব দলই বিধায়কদের ওপরে কড়া নজর রাখে। ২৫ নভেম্বর, সুপ্রিম কোর্ট যেদিন মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আস্থা ভোটের সিদ্ধান্ত নেয়, তার আগের দিন শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের বিধায়করা মুম্বইয়ের একটি হোটেলে জড়ো হন। সংখ্যাটা ছিল ১৬২, এমনটাই দাবি করা হয়। তারপরে শিবসেনা-নেতৃত্বাধীন সরকার। বর্তমানে ডামাডোল।
কর্নাটক
২০১৯-র জুলাই মাসে বিএস ইয়েদুরাপ্পা নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কংগ্রেস-জেডিএস জোটকে আস্থাভোটে হারিয়ে দেয়। তার আগে ২০১৮ সালে ইয়েদুরাপ্পাকে রাজ্যপাল সরকার গঠন করতে ডেকেছিলেন। সে সরকার মাত্র দুইদিন টিকেছিল, কারণ ইয়েদুরাপ্পা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারেননি। ২০১৯ সালে, কংগ্রেস, জেডিএস ও বিজেপি তিন দলই নিজেদের বিধায়কদের বিভিন্ন রিসর্টে রেখে দিয়েছিল। এরপর রাজনীতির অলিন্দ দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় রিসর্ট রাজনীতি।
তামিলনাড়ু
এডাপ্পাডি পালানিস্বামী ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তখন ১২২ জন বিধায়ক তাঁর পক্ষে ও ১১ জন বিধায়ক পনিরসেলভমের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। পনিরসেলভম ২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে অস্বীকার করেন এবং অভিযোগ করেন তাঁর উপর জোর খাটাচ্ছেন এআইডিএমকে নেত্রী ভি কে শশিকলা। শশিকলা তাঁর বিধায়কদের চেন্নাইয়ের কাছে এক রিসর্টে পাঠিয়ে দেন। দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ড হওয়ায় শশি নিজে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। কিন্তু গোল্ডেন বে রিসর্টে বসেই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর ভবিষ্যৎ।
অতীত বিহার
২০০০ সালে জনতা দল (ইউনাইটেড) নেতা নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর মেয়াদ ছিল সাত দিনের কারণ তার পরেই তিনি আস্থা ভোটে হেরে যান। সে সময়ে কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল উভয়েই দলত্যাগের ভয়ে বিধায়কদের পাটনার হোটেলে রেখেছিল।
ভবিষ্যতের জল্পনা
সারা দেশ এখনও দেখছে অগ্নিপথ নিয়ে বিক্ষোভের আগুন কীভাবে জ্বলতে পারে! সবচেয়ে বেশি আগুন জ্বলেছে বিহারে। বিজেপি শরিক হয়েও নীতীশের দলের ভেতর থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে বিরুদ্ধ মত দেখা গেছে। তার ওপর এত আগুন! বিক্ষোভ দমাতে পারত না সরকার? এ কীসের ইঙ্গিত? এনডিএ জোটে নীতিশের অবস্থা যে ভালো নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ভোটের ফলে।
একবার সেই দিকে নজর দেওয়া যাক। গত বিধানসভা নির্বাচনে ৭৫টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হয়েছিল তেজস্বীর আরজেডি। বিজেপি পেয়েছিল ৭৪ আসন। সংযুক্ত জনতা দল পেয়েছিল ৪৩ আসন, গত বারের চেয়ে ২৮ কম। অন্যদিকে বিজেপি গত বারের চেয়ে ২১ আসন বেশি পেয়েছিল। অর্থাৎ জেডিইউ-র ব্যর্থতা ঢেকে দিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৯ আসন, গত বারের চেয়ে আট কম। বলাই বাহুল্য, একক বৃহত্তম দল হয়েও সরকার গড়তে পারেননি তেজস্বী। তার ওপর এই ফল বলছে, গতবারের চেয়ে ২৮ আসন কম পেয়ে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন নীতীশ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও এ যে তাঁর পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়, তা বলাই বাহুল্য। সমীকরণ আর ক্ষোভ-বিক্ষোভ যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আগামী দিনে পাটলিপুত্র নতুন করে কোনও ঘোড়া কেনাবেচার সাক্ষী থাকবে না তো?
রাজ্যসভার ভোট ও রিসর্ট রাজনীতি
এই দেশে সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচনও বাদ যায়নি রিসর্ট রাজনীতির ছোঁয়াচ থেকে। রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে দলের প্রায় ৭০ জন বিধায়ককে উদয়পুরের রিসর্টে বন্দি করে রেখেছিল কংগ্রেস। রাজধানী জয়পুর থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। হরিয়ানায় আবার দলের বিধায়কদের ছত্তিশগড়ে সরিয়েছিল কংগ্রেস। কারণ, ছত্তিশগড় কংগ্রেস শাসিত রাজ্য। আর, হরিয়ানা বিজেপির। হরিয়ানার রাজধানী চণ্ডীগড় থেকে ছত্তিশগড়ের দূরত্ব ১,৪৭০ কিলোমিটার। তা সে যত দূরই হোক না-কেন, যাতায়াতে খরচ যতই বাড়ুক না-কেন, নজরদারিটাই আসল। এ যেন এক ধারাবাহিক ইতিহাস।
কোনও বিশেষ দল নয়, প্রায় সব জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলই নতুন নতুন রিসর্ট রাজনীতির অধ্যায় সংযোজিত করছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়।