মহারাষ্ট্রে সরকার ভাঙতে চাইছে বিজেপি? শিবসেনার অন্তর্দ্বন্দ্বে যে জল্পনা উঠে আসছে
হঠাৎ করে যাঁকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি তোলপাড়, তিনি একনাথ শিন্ডে। একনাথ শিন্ডে মহারাষ্ট্রের থানে এলাকার প্রভাবশালী নেতা।
ঘোর সংকট। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা সরকার কি ভাঙনের মুখে? শিবসেনার অন্দরের বিদ্রোহের আঁচ লাগতে চলেছে সরকারের গায়ে। উদ্বেগে উদ্ধব, এখন তিনি কী করে সরকার বাঁচান, সেই দিকে তাকিয়ে দেশ। যদিও সেনা বলতে শুরু করেছে, বিজেপি সরকার ফেলার চেষ্টা করছে।
কী ঘটল
এমএলসি বা বিধান পরিষদের ভোটে বিজেপি-র কাছে হারের কয়েক ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই এবার শিবসেনা দলে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৩ জন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে ‘বেপাত্তা’ মহারাষ্ট্রের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী একনাথ শিন্ডে। শিবসেনা নেতার এহেন পদক্ষেপ ঘিরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। সোমবার মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদের নির্বাচনে শিবসেনার বিধায়কদের বিরুদ্ধে ক্রস ভোটিংয়ের অভিযোগের পর পরই বিধায়কদের নিয়ে ‘গা-ঢাকা’ দিয়েছেন শিন্ডে। ওই বিধায়করা সুরাতের একটি হোটেলে রয়েছেন বলে সূত্রের খবর। ফোনে শিন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা শিন্ডে। দলীয় সংগঠন মজবুত করতে তাঁর বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন শিবসৈনিকদের একাংশ।
মহারাষ্ট্রে কি ভাঙনের মুখে শিবেসনা সরকার? একনাথ শিন্ডের ফোন দীর্ঘক্ষণ ধরে 'আনরিচেবল'! আর তারপর থেকেই এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সূত্রের খবর, সোমবার এমএলসি নির্বাচনের পরই বিধায়কদের নিয়ে সন্ধে সাতটার বিমানে সুরাতের একটি পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে ওঠেন একনাথ শিন্ডে। আর এই ঘটনায় সম্ভাব্য ভাঙনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মহারাষ্ট্রে।
আরও পড়ুন: প্রার্থী খুঁজতে হিমশিম, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের দেউলিয়া দশা
যদিও এই খবর রটে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সঞ্জয় রাউত দাবি করেছেন, ইতিমধ্যেই হদিশ পাওয়া গিয়েছে একনাথ শিন্ডের। তাঁর বক্তব্য, "রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মতো এখানেও চক্রান্ত করা হচ্ছে। উদ্ধব ঠাকরে সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়েছে। তবে শিবসেনা দলের নেতারা সকলেই অনুগত। তাঁরা সকলেই আনুগত্য বজায় রাখবে।"
গোটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে মহারাষ্ট্রের একাধিক এলাকা। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের বাসভবনের সামনে মোতায়েন করা হয়েছে বিশাল পুলিশবাহিনী।
২০ জুন প্রকাশিত হয়েছে মহারাষ্ট্রের এমএলসি নির্বাচনের ফলাফল। রাজ্যসভার নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও বিজেপি-র কাছে জোর ধাক্কা খায় মহারাষ্ট্রের শাসক জোট। ১০টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৫টি আসনে জয়ী হয়। এমএলসি নির্বাচনে প্রতিটি আসনে জয়ের জন্য ২৬ জন বিধায়কের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। বিধানসভায় শক্তি অনুযায়ী বিজেপি-র চার ও জোটের ছয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত। কিন্তু, ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর দেখা যায়, বিজেপি ৫টি আসনে জয়ী হয়েছে। সূত্রের খবর, ছোট দলগুলির বিধায়ক ছাড়াও জোটের বেশ কয়েকজন বিধায়কের সমর্থন পেয়েছে পঞ্চম আসনে জয়ী বিজেপি প্রার্থী। এই ঘটনাকে উদ্ধব ঠাকরে সরকারের কাছে বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন কেউ কেউ। জোট সরকারের কয়েকজন বিধায়ক ক্রস ভোটিং করে বিজেপি-কে জেতাতে সাহায্য করেছে বলে খবর। আর তারপরই একনাথ শিন্ডে ও তাঁর অনুগামী বিধায়কদের নিয়ে সুরাতের একটি হোটেলে আশ্রয় নেওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসতেই মহরাষ্ট্র সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। একনাথ ‘নিখোঁজ’ হতেই উদ্ধব ঠাকরে তড়িঘড়ি বৈঠক ডেকেছেন বিধায়ক ও মন্ত্রীদের। বিধান পরিষদের ভোট মিটতেই মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই মোড়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে শাসক দল। এমএলসি নির্বাচনে শিবসেনা ৬৪টি ভোট পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে ১২টি ভোট উলটো দিকে পড়ে। এরপর থেকে শুরু হয়েছিল জল্পনা। তারপর শিন্ডে বিধায়কদের নিয়ে গা ঢাকা দেওয়ায় সংকট চরমে।
কে এই একনাথ শিন্ডে
হঠাৎ করে যাঁকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি তোলপাড়, তিনি একনাথ শিন্ডে। একনাথ শিন্ডে মহারাষ্ট্রের থানে এলাকার প্রভাবশালী নেতা। বর্তমানে তিনি মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকারে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন। মহারাষ্ট্রের রাজনীতি এখন এই বরিষ্ঠ নেতার হাতে। তিনি জননেতা। শিবসেনার সংগঠন মজবুত করার কাজে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে থানে এলাকায় তিনি সংগঠন মজবুত করেন। তাঁর হাতেই সেনার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রূপ পেয়েছে। তাঁর ছেলেও রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি কল্যাণ থেকে সেনার সাংসদ।
২০০৪, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের ভোটে সেনার টিকিটে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে পরপর জয়ী হয়েছেন। যখন মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকার তৈরি হয়, তিনি আরবান ডেভলপমেন্ট ও পাবলিক ওয়ার্কস দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। এখন তিনি আরবান অ্যাফেয়ার্স দফতরের মন্ত্রী। শোনা যায়, সেনার নেতৃত্বের সঙ্গে ইদানীং তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই কি এই গা ঢাকা?
এমন জল্পনাও মাথাচাড়া দেয় যে, তিনি বিজেপিতে যেতে পারেন। ২০১৯ সালে মহারাষ্ট্রে সেনা সরকার গঠনের আগে অনেক নাটকীয় মুহূর্তের জন্ম হয়েছিল। এই অবস্থায় বিজেপি কি কোনও নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে? যদিও একনাথ শিন্ডের বিজেপিতে যোগদান প্রসঙ্গে বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা সুধীর মুঙ্গান্তিওয়ার বলেন, ‘একনাথ শিন্ডে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগে নেই। তাঁর দলীয় নেতৃত্বের তাঁর নাগাল না পাওয়ার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা অবশ্যই পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছি। মহারাষ্ট্রের স্বার্থে যখনই প্রয়োজন হবে, আমরা পদক্ষেপ করব। এটি একদিন না একদিন ঘটত। কারণ শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন (বিধানসভা নির্বাচন)। এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ সম্পর্কে আমরা তাদের সতর্ক করেছিলাম, কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করেনি।’
মহারাষ্ট্রের অঙ্ক
একনাথ শিন্ডের এই পদক্ষেপে, মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকারের নেতৃত্বে থাকা শিবসেনায় ভাঙনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যদি একনাথ শিন্ডে এবং তাঁর সমর্থক বিধায়করা শিবসেনার থেকে বেরিয়ে আসেন, তাহলে সমস্যা বাড়বে মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকারের। মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকারের মোট বিধায়ক সংখ্যার মধ্যে, শিবসেনার রয়েছে ৫৬, এনসিপি ৫৩, কংগ্রেস ৪৪, বহুজন বিকাশ আঘাদি ৩, এসপি ২ এবং অন্যান্য ১১ জন।
বিপক্ষে থাকা বিজেপি এবং তাদের সহযোগী দলগুলির মোট বিধায়ক সংখ্যা ১১৩। একনাথ শিন্ডে যদি ২২ জন বিধায়ককে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন, তাহলে বিজেপির মোট বিধায়ক সংখ্যা হবে ১৩৫। অন্যদিকে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে থাকতে হবে ১৪৫ বিধায়কের সমর্থন। ফলে এরপরেও বিজেপিকে আরও ১০ জন বিধায়কের সমর্থন জোগাড় করতে হবে সরকার বানানোর জন্য। বিজেপি এত সহজে রণে ভঙ্গ দেবে বলে মনে হয় না। তারা কী ঘুঁটি চালে, দেখা যাক।