পেট চালাতে করতে হয়েছিল ঝাড়ুদারের কাজ, আজ সেই রিঙ্কুই নয়নের মণি ভারতের ক্রিকেট-ভক্তদের

তবুও এই মরশুমে তেমনভাবে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। কেন পরপর ম্যাচ হারার পরেও খেলানো হলো না রিঙ্কুকে? এই নিয়ে কেকেআর সমর্থকদের মনে ক্ষোভ থাকলেও, সমর্থকদের মনে নিজেকে একটা দামি জায়গায় স্থাপন করে নিয়েছেন রিঙ্কু।

বয়সটা মাত্র ২৬ ছুঁই ছুঁই। কাঁধে রয়েছে ন'জনের সংসারের ভার। কিন্তু তার মধ্যেও আইপিএলে ব্যাট চালিয়ে নিজের আপনজনদের মুখে হাসি ফোটালেন কেকেআর-এর তরুণ তুর্কি রিঙ্কু সিং। লখনউ সুপার জায়েন্টের সঙ্গে মরশুমের শেষ ম্যাচে কলকাতা নাইট রাইডার্সের শেষ ভরসা রিঙ্কু সিং যেভাবে ব্যাট চালালেন, তাতে মুগ্ধ গোটা ভারতবাসী। এমনকী, ম্যাচের শেষ মুহূর্তে একটা ভুল শট খেলে আউট হলেও, রিঙ্কুর এই ইনিংসটা মনে রাখা হবে বহু বছর। শুধু নিজের কাছের মানুষ নয়, রিঙ্কুর এই কেরামতি চোখে জল এনেছে দেশজুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কেকেআর সমর্থকদের চোখেও।

তবে শুধুমাত্র শেষ ম্যাচে না, এর আগেও বেশ কয়েকটি ম্যাচে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স করে কেকেআরকে অক্সিজেন জুগিয়েছিলেন রিঙ্কু সিং। একটা সময় যখন মনে হয়েছিল, চেন্নাই এবং মুম্বইয়ের মতো সিঙ্গেল ডিজিটে শেষ করতে হবে কলকাতাকেও, সেখান থেকে দলকে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে এসেছেন রিঙ্কু সিং। প্লে অফের দৌড় থেকে কেকেআর এখন অনেকটা দূরে থাকলেও রিঙ্কু সিং এর চেষ্টা কখনওই ভোলার নয়।

আইপিএল-এ নাইটদের সংসারে রিঙ্কু সিং এসেছিলেন প্রায় বছরচারেক আগে। ২০১৮ সালে ৮০ লক্ষ টাকায় রিঙ্কুকে দলে নিয়েছিল শাহরুখ খানের ফ্র্যাঞ্চাইজি কলকাতা নাইট রাইডার্স। তবে এর আগে এক বছর ১০ লক্ষ টাকার বেস প্রাইসে পাঞ্জাবের দলে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেসময় পাঞ্জাব তাকে খেলায়নি। ২২ গজে নামতে রিঙ্কুকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় পাঁচ-পাঁচটা সিজন। অবশেষে আইপিএলের চলতি সংস্করণে শ্রেয়স আইয়ারের দলের হয়ে সুযোগ পেয়েছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেছেন শুরু থেকেই। কিন্তু রিঙ্কু সিংয়ের এই যাত্রার পিছনে রয়েছে একটা দীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে দারিদ্রের, হার না-মানা মনোভাবের, এবং সর্বোপরি অপরিসীম উদ্যমের।

 

আরও পড়ুন: ক্রিকেট-ফুটবল নয়, ব্যাডমিন্টনে বিশ্বমঞ্চের রাজা ভারত, চাণক্য গোপীচাঁদ

 

যে কোনও সময় ম্যাচের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তবে দারিদ্রর সঙ্গে লড়াই করে ২২ গজে আসার এই লড়াইটা খুব একটা সহজ ছিল না। উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে একটি হতদরিদ্র পরিবারের তাঁর জন্ম হয়েছিল। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। লেখাপড়া খুব বেশি দূর করতে পারেননি। নবম শ্রেণিতে ফেল করার পরে আর বইখাতা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাননি রিঙ্কু সিং। তারপর থেকেই ক্রিকেটের ব্যাট হাতে তুলে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন ২২ গজে নেমে বোলারদের দাপট-সংহার করার। গড়তে চেয়েছেন নিজের কেরিয়ার। তবে দারিদ্রের কারণে প্রাথমিক দিনগুলোতে তাঁর ক্রিকেট প্র্যাকটিস খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।

আর্থিক অবস্থার বাধা
দারিদ্রের প্রাথমিক দিনগুলোতে তাঁর অবস্থা কতটা খারাপ ছিল, তা নিজেই একটি ভিডিওতে জানিয়েছেন রিঙ্কু সিং। একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। এই ভিডিওতে ২০২১ সালের কথা উল্লেখ করেছেন রিঙ্কু সিং। সেই সময় বিজয় হাজারে ট্রফি খেলতে যাওয়ার সময় তাঁর হাঁটুতে চোট লাগে। সেই কারণে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্বে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর সেই চোটের পর তাঁর বাবা ২-৩ দিন পর্যন্ত কোনও খাবারই নাকি মুখে তোলেননি বলে জানিয়েছেন রিঙ্কু সিং। এই ভিডিওতে রিঙ্কু বললেন, "বিজয় হাজারে ট্রফি খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছিলাম। একটা ম্যাচে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে পড়ে যাই। সেই সময় আমার গুরুতর চোট লাগে। আমার চোখ তখন আইপিএলের দিকে। কিন্তু আমার প্রশিক্ষক বললেন, সুস্থ হতে আরও ছয়-সাত মাস সময় লাগবে। সেই সময় আমার বাবা ২-৩ দিন পর্যন্ত কোনও খাবার মুখে নেন নি। আমি বললাম ক্রিকেটে চোট লাগতেই পারে। কিন্তু তার পরেও চিন্তায় ছিলেন বাবা। আমি বাড়ির জন্য সব কিছু করি। আমি যদি ক্রিকেট খেলতে না পারি তবে আমার পরিবার সমস্যায় পড়ে যাবে।"

 

রিঙ্কুর জন্ম আলিগড়ের একটি অত্যন্ত গরিব পরিবারে। একটি সাক্ষাৎকারে রিঙ্কু সিং জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আসেন। এই সামান্য রোজগারেই তাঁদের সংসার চলত এতদিন। তাঁদের পরিবার থাকত ওই সিলিন্ডার ডিসট্রিবিউশন এজেন্সি-লাগোয়া দুই কামরার একটি বাড়িতে। কিন্তু তারপরে বাবার বয়স বাড়তে থাকে। হাত থেকে চলে যায় গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারির কাজ। বড়দা নেমে পড়েন অটো চালানোর কাজে। মেজদা কোচিং সেন্টারে কাজ করেন। কিন্তু শুধুমাত্র একজনের অটো চালানোতে তো আর সংসার চলে না। তাই রিঙ্কুও নেমে পড়েন রোজগারের খোঁজে। বহুবার দাদা ক্লান্ত হয়ে গেলে তাঁর সেই অটো নিজেও চালিয়েছেন রিঙ্কু সিং। এছাড়াও ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করেছেন একসময়। কিন্তু, আইপিএলের একটা ডাক যেন পুরো পাল্টে দিল রিঙ্কু সিংয়ের পরিবারের ভবিষ্যৎ। ন'জনের পরিবারের দারিদ্র ঘুচল, যখন আইপিএলে ডাক পেলেন ঘরের ছেলে।

 

আইপিএলের নিলামে রিঙ্কু সিংয়ের নাম ওঠার পরে 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এর একটি সাক্ষাৎকারে রিঙ্কু সিং জানিয়েছিলেন, "আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ২০ লক্ষ টাকায় কেউ আমাকে কিনবে। কিন্তু আমি ৮০ লক্ষ টাকা পাব, এটা কখনও আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এই টাকা পাওয়ার পরেই আমার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে, আমাকে আমার ভাইয়ের বিয়ে দিতে হবে। আর আমি আমার বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমাতে পারব। আমরা আরও ভালো একটা বাড়িতে চলে যাব।'

 

জানা যায়, তিন বছর আগে রিঙ্কুর পরিবারের প্রায় ৫ লক্ষ টাকা দেনা হয়ে গিয়েছিল। সেই দেনা শোধ দেওয়া তাঁর পরিবারের জন্য একেবারেই সহজ কাজ ছিল না। নবম শ্রেণিতে ফেল করা রিঙ্কু পড়াশোনায় কোনওদিনই খুব একটা ভালো ছিলেন না। তাই পড়াশোনা দিয়ে কিছু করতে পারবেন, এটা কখনওই তিনি ভাবেননি। তিনি সবসময় ভেবেছিলেন, ক্রিকেট দিয়েই তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। তাই ক্রিকেটের দিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিলেন রিঙ্কু সিং।

 


সাফল্য পাওয়ার পর
কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে নিলামে ওঠার পর রিঙ্কু সিং সবার আগে সেই টাকা দিয়ে ওই ৫ লক্ষ টাকা দেনা পুরোপুরি শোধ করেন। আলিগড়ে এতদিন পর্যন্ত রিঙ্কুদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটা খুব একটা পোক্ত ছিল না। তাই ওই ৮০ লক্ষ টাকা দিয়ে নিজেদের জন্য একটি উন্নত বাড়ি খুঁজে নিলেন রিঙ্কু সিং। তারপরেই দুই দাদার বিয়েতে কিছু করে টাকা দিলেন রিঙ্কু। এছাড়াও বোনের বিয়ের জন্য বেশ কিছু সেভিংস করেছেন বলেও জানিয়েছেন রিঙ্কু।

 

ক্রিকেট কেরিয়ার
যেহেতু প্রথম থেকেই তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না, এবং তিনি নিজেও পড়াশোনাতে খুব একটা ভালো ছিলেন না, তাই প্রথম থেকেই ক্রিকেটই হয়ে উঠেছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। উত্তরপ্রদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলার সময় যে টাকা তিনি পেতেন, সেই টাকা দিয়েই তাঁদের বাড়ির ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেরকমটা একেবারেই হয়নি। সেই সময়টা রিঙ্কুর জন্য খুব একটা সহজ সময় ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় ঝাড়ুদারের কাজ করে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে টেবিল মুছে, অটো চালিয়ে, কোনওভাবে তাঁর সংসার চলত। একটা সময় এমন ছিল, যখন তাঁকে ক্রিকেট অথবা সংসার- দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হতো।

 

কিন্তু, প্রথম থেকেই তার মনে ক্রিকেটার হওয়ার একটা স্বপ্ন ছিল। তাই সেই স্বপ্নকে সফল করার উদ্দেশ্যে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে দারুণ পারফরম্যান্সের পর চান্স পেলেন উত্তরপ্রদেশের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার। ২০১৮/১৯-এ উত্তরপ্রদেশের হয়ে ১০ ম্যাচে ৯৫৩ রান করেন তিনি। এখনও পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৬টি ম্যাচ খেলে ২৩০৭ রান করেছেন তিনি। এই রানের মধ্যে আছে ৫টি সেঞ্চুরি এবং ১৬টি হাফ সেঞ্চুরি।

 

৪১টি এ-লিস্টের ম্যাচ এখনও পর্যন্ত খেলেছেন রিঙ্কু সিং। এই সমস্ত ম্যাচে সব মিলিয়ে ১৪১৪ রান করেছেন তিনি। এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৬৪ ম্যাচে ১০৮১ রান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাঁর পরিবার এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তার সবকিছুই হয়েছে ক্রিকেটের জন্যই। দিল্লিতে একটি টুর্নামেন্টে ম্যান অফ দ্য সিরিজ নির্বাচিত হওয়ার পর রিঙ্কু একটি মোটরসাইকেল পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই তাঁর পরিবার তাঁকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। পরে রিঙ্কুর বাবা ওই মোটরসাইকেলের মাধ্যমে সিলিন্ডার ডেলিভারি করতে শুরু করেছিলেন। পরিস্থিতি ভালো না থাকলেও, কিছু সময়ের জন্য তাঁর পরিবারের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই মোটরসাইকেল।

 

আইপিএল-এ এখনও পর্যন্ত রিঙ্কু সিংয়ের রান সংখ্যা কম থাকলেও তাঁর একটি ইনিংস তাঁকে অনেকের মনে এখনও জীবিত রাখবে। কেকেআর-এর শেষ ম্যাচে এলএসজি-র বিরুদ্ধে পুরো ম্যাচটা প্রায় তিনি বের করে ফেলেছিলেন। ১৫ বলে ৪০ রান করে মারকাটারি ইনিংস খেলে আউট হয়েছিলেন তিনি। ৪টে ছক্কা আর ২টো বাউন্ডারি দিয়ে সাজানো ছিল তাঁর ইনিংস। তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ২৬৬.৬৭। কিন্তু তবুও এই মরশুমে তেমনভাবে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। কেন পরপর ম্যাচ হারার পরেও খেলানো হলো না রিঙ্কুকে? এই নিয়ে কেকেআর সমর্থকদের মনে ক্ষোভ থাকলেও, সমর্থকদের মনে নিজেকে একটা দামি জায়গায় স্থাপন করে নিয়েছেন রিঙ্কু।

 

সোনার তো দূরে থাক, একটা লোহার চামচ মুখে নিয়েও তিনি জন্মগ্রহণ করেন নি। কিন্তু এখন নিজেকে সোনার থেকেও দামি করে গড়ে তুলেছেন রিঙ্কু। এখন কেকেআরের এই ক্রিকেটারের নাম সমর্থকদের মুখে। তাঁর ইনিংস দেখে অভিভূত হয়েছেন খোদ বলিউড সুপারস্টার আমির খান। দেহাতি চেহারা এবং কথাবার্তার জন্য তাঁকে অবজ্ঞা করেছেন অনেকেই। কিন্তু আজকে তাঁর সম্মানটা একটা অন্য স্তরে। যে-সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া পেজের অ্যাডমিনরা তাঁকে নিয়ে একটা সময় 'ট্রোল' করেছিলেন, তাঁরাই আজকে তাঁর সাফল্য দিয়ে করেছেন করলেন বড়ো বড়ো পোস্ট। একটা সময় তাঁকে কেকেআর-এর ওয়াটার বয় বলেও ডাকা শুরু হয়েছিল। সেই রিঙ্কুই আজ বুঝিয়ে দিলেন, ক্রিকেটের মাঠে একজন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সটাই কিন্তু শেষ কথা।

 

 

More Articles