চরম সংকটেও ক্যারম খেলা, স্নান সুইমিং পুলে! কেন এই আচরণ শ্রীলঙ্কার জনগণের?

ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সঞ্চিত নেই কোষাগারে। তার জেরেই কয়েকদিন আগে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে। তারপরই ফের ফুঁসছে শ্রীলঙ্কা।

 


না-খেতে পাওয়া অসহায় মুখের সারি। দিনের পর দিন একবেলা খেয়ে আছে শ্রীলঙ্কার আমজনতা। স্বাভাবিকভাবে রাগে ফুঁসছিল দেশ। গণবিক্ষোভ গণবিস্ফোরণের চেহারা নেয়। বিক্ষোভকারীরা কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি ভবনের দখল নেন। তারপর ভিডিও প্রকাশ্যে আসে সুইমিং পুলে তাঁরা সাঁতার কাটছেন। যেন হুল্লোড়ে দিন কাটাচ্ছেন। এতদিনের চরম যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ কি এই উল্লাস? সে কারণ যাইই হোক, চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। এর মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার হদিশ মিলেছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে যে আড়ম্বড়ে দিন কাটাচ্ছিলেন, তাঁর স্বপ্নে গড়া স্বর্গ তছনছ করে দিতেই কি সেখানে বিক্ষোভকারীদের এই তাণ্ডব?

সুইমিং পুলে সাঁতার, সঙ্গে তাস পেটানো
সারা দেশ অর্থসংকটে ধুঁকছে। আর রাষ্ট্রপতি যে বিলাসে দিন কাটাচ্ছিলেন, তা কি টের পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার নাগরিক? তাহলে কেন নিরপত্তাকে পরোয়া না করে প্রাসাদে পৌঁছে যান বিক্ষোভকারীরা? সেখানে গিয়ে কী দেখলেন তাঁরা? চোখ চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়! বৈভবের পাহাড়! ঐশ্বর্যকে ছুঁয়ে দেখা নয়, এভাবেই পাহাড়প্রমাণ রাগের প্রকাশ দেখল বিশ্ব।

শনিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে রাজাপক্ষের প্রাসাদে ঢুকে পড়েন আন্দোলনকারীরা। প্রথমে সেখানে অবাধে ভাঙচুর চলে। শুধু তাই নয়, প্রাসাদের সুইমিং পুলে নেমে কাউকে কাউকে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপতির ব্যবহারের জিম থেকে নিজস্ব শোওয়ার ঘর- আন্দোলনকারীদের তছনছ করতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন: গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে, কোন পথে হাঁটবে এবার শ্রীলঙ্কা?

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ভবনে বিক্ষোভকারীদের উল্লাসের ছবি দেখে সারা বিশ্ব হতবাক। কী চলছে সেখানে?পুর্ণেন্দু পত্রী যেমন বলেছিলেন, ঝরনার জলে স্নান আর ফোয়ারার জলে কুলকুচি। রাজার প্রাসাদ বলে কথা! তার দখল এখন ক্ষুধাতুর মানুষগুলোর হাতে। খিদের জ্বালাও ভুলে তাস পেটাচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার রান্না চাপিয়েছেন প্রাসাদের রান্নাঘরে।

প্রকাশ‍্যে এসেছে আশ্চর্য ভিডিও। প্রাসাদের সুইমিং পুলে ডাইভ দিচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। আনন্দে গা এলিয়ে সুইমিং পুলের শীতল জলে সাঁতার কাটছেন এতদিনের ক্লান্তিতে ডুবে থাকা একটা বঞ্চিত গোষ্ঠী। পুলের চারপাশে তখন ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্ষোভকারীদের হাতে জাতীয় পতাকা। অনেককে রান্নাঘরে রান্না করতে দেখা গিয়েছে। কেউ আবার প্রাসাদের অন্দরে রাজকীয় চালে ক্যারাম খেলছেন, তাস পেটাচ্ছেন। তাঁরাই যেন আজ রাজা! কারণ প্রাসাদ তাঁদের দখলে। আশ্চর্য এই বিক্ষোভে নিরাপত্তারক্ষীরাও নাকি মদত দিয়েছেন, তাই তাঁরা ঢুকতে বাধা দেননি কাউকে। অবাধে তাঁরা ঢুকে পড়েছেন একেবারে রাজা থুড়ি রাষ্ট্রপতির ঘরে। বিশ্রাম কক্ষে বসে কেউ কেউ হাতে তাস নিয়ে অবসর যাপন করছেন। কয়েক রাউন্ড তাস পেটাচ্ছেন মনের আনন্দে। পেটের খাবার জ্বালা হয়ত তখনও লুকোনো, এ হয়তো তার স্ফুলিঙ্গ! তাই এ কোনও উল্লাসের যাপনচিত্র নয়, এ হল যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ।

ভিডিও দেখা যায়, রান্নাঘরের অবস্থা সুইমিং পুলের মতো। বড় টেবিলকে ঘিরে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়েছিলেন। চারিদিকে ছড়ানো জিনিসপত্র। গোয়েন্দা রিপোর্টে আগেই এই ধরনের ঘটনার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। তাই কি এর আঁচ পেয়ে আগেই পালিয়েছিলেন রাজাপক্ষে?

বিছানায় নোটের বান্ডিল
দেশের সংকট কি আদৌ স্পর্শ করেনি রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষেকে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে কলম্বোর আকাশে। কারণ জানা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ভবনে লক্ষ লক্ষ টাকার হদিশ মিলেছে। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোটের বান্ডিল। শুধু লক্ষ বললে ভুল বলা হবে। শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় কয়েকশো কোটি। ভারতীয় মূল্যে যা ৩৯,৩২,৮৩৫.২২ টাকা। এই পরিমাণ টাকা উদ্ধারের পর সেদেশে তীব্র চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে সেই টাকা উদ্ধারের ছবি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করছে। দেশ যখন আর্থিক সংকটের মধ্যে জ্বলছে, সেই সময় এই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল রাজাপক্ষেকে।

ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা টাকা গুনছেন। উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা বিভাগকে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই নিয়ে তদন্ত করে পদক্ষেপ করা হবে। কী পদক্ষেপ? কারণ রাজাপক্ষে তো গা ঢাকা দিয়েছেন!

শ্রীলঙ্কার অবস্থা
১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতালাভের পর শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে ধুঁকছে এই দেশটির অর্থনীতি। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও জ্বালানির সংকটের কারণে দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খাবারের দাম আকাশছোঁয়া। অনেক সময় শ্রীলঙ্কার বাসিন্দারা একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। চরম সংকটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার চরম সংকটে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। ইতিমধ্যে তারা ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সাহায্য করেছে বলে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে।

ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সঞ্চিত নেই কোষাগারে। তার জেরেই কয়েকদিন আগে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে। তারপরই ফের ফুঁসছে শ্রীলঙ্কা। এই অবস্থায় রাজাপক্ষের ঘরে মিলল টাকার গদি। সারা বিশ্ব রাজাপক্ষের এই কীর্তিতে হতবাক।

একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সাধারণের প্রাসাদ-যাপন, নিছক আড়ম্বরকে ছুঁয়ে দেখা নয়, এ হলো এতদিনের ছাইচাপা রাগের উদগিরণ!

More Articles