দ্রৌপদী নয়, আসল নাম... নিজের প্রকৃত পরিচয় কখনও ভোলেননি রাষ্ট্রপতি

শপথ নিয়েই জানান, তাঁর আসল নাম দ্রৌপদী নয়। তাহলে কী? মহাভারতের বহু নন্দিত এবং আলোচিত চরিত্র দ্রৌপদী। তাঁর নামেই রাষ্ট্রপতির নামকরণ করেছিলেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক।

মহাভারতের সবচেয়ে আলোচিত নারীচরিত্র দ্রৌপদী। মহাকাব্যের ব্যাপ্তির সঙ্গে হয়তো সেদিন জুড়ে গিয়েছিল তাঁর নাম, যেদিন তাঁকে দ্রৌপদী বলে ডেকেছিল স্কুল।

২৫ জুলাই সকালে দেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন দ্রৌপদী মুর্মু। এদিন তাঁকে দেশের শীর্ষ সাংবিধানিক পদ শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি এনভি রমানা। সেই সঙ্গে ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল এক নতুন অধ্যায়। কারণ তিনি প্রথম জনজাতির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণ করেছেন।

তাঁকে নিয়ে ইতিমধ্যে নানা মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তার কারণ অবশ্য তিনি নিজেই। শপথ নিয়েই জানান, তাঁর আসল নাম দ্রৌপদী নয়। তাহলে কী? মহাভারতের বহু নন্দিত এবং আলোচিত চরিত্র দ্রৌপদী। তাঁর নামেই রাষ্ট্রপতির নামকরণ করেছিলেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক।

আরও পড়ুন: প্রথম রাজভোগ এল রাষ্ট্রপতি ভবনে, রাইসিনা হিলে কেমন কেটেছিল সাতটা দিন?

সবুজ-লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে দেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করলেন দ্রৌপদী মুর্মু। শপথগ্রহণের পর তিনি জানান, দ্রৌপদী তাঁর আসল নাম নয়। তাঁর নাম দ্রৌপদী রেখেছিলেন স্কুলের এক শিক্ষক। এক ওড়িয়া ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি জানান, সাঁওতালি ভাষায় তাঁর আসল নাম ছিল `পুটি’। পরে অবশ্যই স্কুল তাঁর নাম বদলে নেন। নতুন নাম হয় দ্রৌপদী। তিনি জানান, যে শিক্ষক তাঁর নাম বদল করেছিলেন, তিনি অন্য জেলার বাসিন্দা ছিলেন।

তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "সাঁওতালি সংস্কৃতিতে নাম কখনও মরে না।" তিনি বলেন, "যদি পরিবারে একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে, সে তার দিদার নাম নেয়। যখন একটি ছেলে জন্মায়, তখন দাদুর নামে তার নামকরণ হয়।" এটাই তাঁদের ঐতিহ্য। দ্রৌপদী আরও জানান, এখনও পর্যন্ত বহুবার তাঁর নাম বদল হয়েছে। এককালে তাঁর নামের উচ্চারণ ছিল 'দূরপদি'। পরে সেই উচ্চারণ হয়েছিল 'দৌরপদি'। শেষ পর্যন্ত তা দ্রৌপদী হয়। তাঁর পদবিও মুর্মু ছিল না। তিনি জানান, জন্মের সময় তাঁর পদবি ছিল টুডু। স্কুল-কলেজে তিনি এই পদবি ব্যবহার করতেন। বিয়ের পর তাঁর পদবি হয় মুর্মু।

গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের মেয়ে পুটি ওরফে দ্রৌপদী প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশোনা করেন ভুবনেশ্বরের রামাদেবী উইমেন্স কলেজে। ওড়িশা সরকারের করণিক হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন দ্রৌপদী মুর্মু। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যের সেচ ও জ্বালানি বিভাগের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ওড়িশার রায়রংপুরের অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। সেই বছর রায়রংপুরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। রায়রংপুর আসনে ২০০০ ও ২০০৯ সালে বিজেপির পক্ষে দাঁড়িয়ে ওড়িশা বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন দ্রৌপদী।

২০০৪ সাল পর্যন্ত বিজু জনতা দল ও বিজেপি জোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে বাণিজ্য ও পরিবহণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলালেও পরে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাঁকে।

২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তফশিলি সম্প্রদায়ের বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতি ছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। ২০১৫ সালে উড়িষ্যার পার্শ্ববর্তী রাজ‍্য ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ করা হয় তাঁকে। তারপর সক্রিয় রাজনীতিতে ইতি টানেন তিনি। শুরু হয় সাংবিধানিক পদে থেকে নতুন দায়িত্ব পালন। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি। এখন তিনি দেশের প্রথম নাগরিক।

২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম ভাষণ দেন দ্রৌপদী। দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নির্বাচিত হওয়া দ্রৌপদী দেশের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। দ্রৌপদী বলেন, "সকলের আশীর্বাদে আমি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছি। আমি প্রগতিশীল একটি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছি। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে।" তিনি আরও বলেন, "আমিই দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভারতের স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতের নাগরিকদের কাছে আমার আবেদন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যাশা পূরণ করতে আমাদের সকলকে একসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে।"

তিনি বলেছেন, "স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল। আর স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পেলাম। দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া আমার একার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি নয়। এটা ভারতের প্রত্যেক দরিদ্র মানুষের প্রাপ্তি। আমার রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রমাণ করে যে, দরিদ্র মানুষরা শুধু স্বপ্নই দেখেন না, তা পূরণ করতেও পারেন।"

আজ তিনি দেশের প্রথম নাগরিক। সাংবিধানিক প্রথান। অনেক জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রাইসিনা হিলসে পৌঁছালেন দ্রৌপদী। তিনি বুঝিয়ে দেন, কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে প্রতিকূলতাকে জয় করা যায়। উড়িষ্যার একটি গ্রাম থেকে তাঁর পথচলা শুরু হয়েছিল। অনেক বাধা সত্ত্বেও লড়াই করে গিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, সংকল্পে স্থির থাকলে উড়িষ্যা আর দিল্লির মধ্যেও দূরত্ব দূর করে ফেলা যায়। যেমনটা করলেন দ্রৌপদী মুর্মু। গ্রামের প্রথম মেয়ে, যিনি কলেজে পা রাখেন। প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া একটা মেয়ের দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে পৌঁছনো মোটেই মুখের কথা ছিল না। এটাই আসলে গণতন্ত্রের শক্তি, সেই শক্তিই বুঝিয়ে দিল ইচ্ছের জোর থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।

More Articles