কেন জামা খুলে উড়িয়েছিলেন সৌরভ, সেই ম্যাচের যে গল্প আজও অজানা

সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মাঠের মধ্যে জার্সি খুলে ফ্লিনটফের উল্লাসের জবাবে ভারতীয় অধিনায়কের লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে হাওয়ায় ঘোরানোর দৃশ্য। এই গুরুত্বপূর্ণ জয় এবং উল্লাসের পিছনে থাকা বহু কাহিন...

 

১৩ জুলাই, ২০০২। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা লর্ডসের ব্যালকনিতে এক বাঙালির জয়োল্লাস দেখে গর্ব অনুভব করেছিল। সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মাঠের মধ্যে জার্সি খুলে ফ্লিনটফের উল্লাসের জবাবে ভারতীয় অধিনায়কের লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে হাওয়ায় ঘোরানোর দৃশ্য। এই গুরুত্বপূর্ণ জয় এবং উল্লাসের পিছনে থাকা বহু কাহিনি আজও বহু মানুষের কাছে অজানা গল্প হিসাবেই রয়ে গিয়েছে।

২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল খেলা-সংক্রান্ত এক সাক্ষাৎকারে রাহুল দ্রাবিড়, মহম্মদ কাইফ এবং অজিত আগরকার বহু অজানা গল্প বলেছিলেন। তাঁদের মতে সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন যুগ শুরু হয়েছে। দেশ-বিদেশের মাটিতে তারা কিছু ম্যাচ জিততে শুরু করেছে। তারা ম্যাচ জিতলেও রান তাড়া করে ম্যাচ জেতা দল হিসেবে তাদের সুনাম ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে ৩২৫ রান তাড়া করে জয় কার্যত অসম্ভব ছিল। ভারতীয় দলের ব্যাটিংয়ের শুরুটা ভালো হলেও দেড়শো রানের মধ্যে তারা পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল। মহম্মদ কাইফ বলেছিলেন যে, শচীন তেন্ডুলকর আউট হওয়ার পরে তিনি ব্যাট করতে নেমেছিলেন। লর্ডসের ড্রেসিংরুম থেকে লংরুম পেরিয়ে গ্রাউন্ডে পৌঁছতে হয়। সেই সময় কাইফের মনে হয়েছিল লংরুমে উপস্থিত সকল মানুষ যেন তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল, শচীন তো আউট হয়ে গিয়েছে। এইবার তুমি কী করবে? কাইফ যখন মাঠে প্রবেশ করে হাঁটতে শুরু করেন তখন দেখেন যে, বহু লোক স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

এই কথাটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। কারণ সৌরভ, শেহবাগ, দ্রাবিড়, শচীন আউট হয়ে গিয়েছেন তখন। মাঠে রয়েছে বয়স এবং অভিজ্ঞতার বিচারে নবীন যুবরাজ সিংহ এবং মহম্মদ কাইফ। কাইফ নিজে এই ঘটনার ফলে খুব একটা বিস্মিত হননি, কারণ তাঁর পরিবার শচীন তেন্ডুলকর আউট হওয়ার পর খেলা বন্ধ করে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। কাইফ ক্রিজে পৌঁছনোর আগে ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক নাসের হুসেন তাকে বলেছিলেন যে, তোমার তুলনায় একটা বাস ড্রাইভারের কাছে বেশি সুযোগ থাকবে। কাইফ ম্যাচ জেতার পর তার জবাব দিয়ে বলেছিলেন যে, বাস ড্রাইভার হিসেবে আজকের ইনিংস মন্দ নয়।

আরও পড়ুন: ৫০ পার, নানা মাঠে সৌরভের দাদাগিরি চলছে চলবে

অজিত আগরকার এই ম্যাচ সম্পর্কে বলেছেন যে, সেই সময় খুব আশাবাদী মানুষও হয়তো ভারতের এই জয় আশা করেননি। লক্ষ্য ১৮০-২০০ হলে হয়তো দুই অল্পবয়সি খেলোয়াড় কিছু বোলারের সাহায্য নিয়ে কোনওভাবে সেই লক্ষ‍্যে পৌঁছে যেতে পারত, কিন্তু পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরেও ৩২৫-এর লক্ষ্য তাড়া করে জিতে যাওয়ার কারণেই এই ম্যাচ এত গুরুত্বপূর্ণ। এই ম্যাচের আগেও ভারতীয় দল অনেকবার এইরকম লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এই ম্যাচ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সেই সময় তিনশো রানের বেশি তাড়া করে ম্যাচ জেতা সহজ ছিল না। তাই ইংল্যান্ড দল ৩০০ রানের বেশি করে ফেলার কারণে তিনি নিজের এবং দলের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি এবং শেহবাগ ভারতীয় ইনিংসের মজবুত ভিত গড়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। রাহুল দ্রাবিড় সেই ম্যাচে ভালো খেলতে পারেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তিনি পাঁচ রান করে আউট হয়ে যাওয়ার পরে ড্রেসিংরুমে একটা টেবিলের ওপর বসেছিলেন। যখন যুবরাজ সিংহ এবং মহম্মদ কাইফের পার্টনারশিপ তৈরি হয়, তখন তিনি সেই টেবিলে বসে। তিনি নিজের মনে ছোট ছোট লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিলেন, আর সেইগুলো পূর্ণ হওয়ার পর নিজেই মনে মনে খুশি হচ্ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, যেন তাঁর যোগদান পাঁচ রানের থেকে অনেক বেশি। ভারতীয় দল তিনশো রান বানানোর পরে তিনি ব্যালকনিতে এসেছিলেন।

ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির সেই ম্যাচের বহু মুহূর্ত আজও বহু মানুষের কাছে ছবির মতো স্পষ্ট। ইংল্যান্ড দলের অসাধারণ ব্যাটিং দেখে হতাশ হয়ে পড়া থেকে তিনশোর ওপর রান দেখে ভারতীয় দলের খেলার সমালোচনা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ ব্যাটিং থেকে শেহবাগের অনবদ্য কিছু শট, পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে বেশিরভাগ মানুষের খেলা দেখা বন্ধ করে দেওয়া থেকে যুবরাজ কাইফের জুটিতে ভর করে ভারতীয় দলের ম্যাচে ফেরার চেষ্টা দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠা, আউট হওয়ার পরে যুবরাজ সিংহর কেঁদে ফেলা ছবি দেখে মন খারাপ করা, জাহির খানের মহম্মদ কাইফের সেই শেষ দুই রানের সময় উৎকণ্ঠা এবং শেষে ভারতীয় অধিনায়কের লর্ডসের ব্যালকনিতে উল্লাস। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সেই বর্ষার রাতে রং খেলা এবং বাজি ফাটানো হয়েছিল। এই ম্যাচ ভারতীয় দলের সৌরভ-যুগে দ্বিতীয়বার সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, আমরাও যোগ্য, আমরাও পারি।

More Articles