অজানা সৌরজগতের সন্ধান দিতে পারে দীর্ঘ পথ হাঁটা এই মহাকাশযান

তাদের যাত্রা চলতে থাকবে, অজানার পথে, অসীমের পথে, 'Interstellar Space'-এর মধ্য দিয়ে, যার ৯০ শতাংশই অন্ধকার, শীতল। যেখানে সূর্যের প্রভাব আর নেই।

মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল-মাঝে
আমি মানব, একাকী ভ্রমি, বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে

ভয়েজারের যদি একটা মন থাকত, যদি থাকত চেতনা, তাহলে হয়তো সৌরজগত ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে প্রবেশ করার পর এই কথাগুলিই গুনগুন করত সে। অতি সম্প্রতিকালের এক রিপোর্টও বলছে যে, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করা এই মহাকাশযান হয়তো পথ হারিয়েছে। সে এখন মহাশূন্যে ভ্রমিছে বিস্ময়ে। সে ছুটে চলেছে অনন্তের পথে। হয়তো লক্ষ কোটি বছর পর কোনও সভ্যতা খুঁজে পাবে তাকে। ভয়েজারের মাধ্যমে তারা জানবে পৃথিবীর কথা, জানবে মানবসভ্যতার কথা। হয়তো। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ততদিনে হয়তো মানুষ অতীত হয়ে যাবে, বা পৃথিবী ছাড়িয়ে পাড়ি দেবে ভিনগ্রহের উদ্দেশে। এই মহাকাশযানের ইতিহাসটা একটু ঘেঁটে দেখা যাক।

কথা হচ্ছে মহাকাশযান ভয়েজার ওয়ান এবং টু-কে নিয়ে। যাদের সঙ্গে আর হয়তো সর্বাধিক দশ বছর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে সৌরজগতের দৈত্য, গ্যাস জায়েন্ট বৃহস্পতি এবং শনি এবং সেই সঙ্গে ইউরেনাস ও নেপচুনকে পর্যবেক্ষণ করতে এই দুই মহাকাশযানকে পাঠানো হয়, এবং শুরুতে উদ্দেশ্য এটা হলেও পরে ঠিক করা হয় যে, ওই চারটি গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেই এদের যাত্রা শেষ হবে না। বরং তাদের যাত্রা চলতে থাকবে, অজানার পথে, অসীমের পথে, 'Interstellar Space'-এর মধ্য দিয়ে, যার ৯০ শতাংশই অন্ধকার, শীতল। যেখানে সূর্যের প্রভাব আর নেই।

১৯৭৭ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনার সুবিধে নিয়ে ভয়েজার ওয়ান এবং টু-এর প্রক্ষেপণ হয়। সেই বিরল মহাজাগতিক ঘটনা ছিল বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের প্রায় এক সারিতে চলে আসা। যার ফলে তাদের মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে দুই ভয়েজারই অনেক দ্রুত গতিতে তাদের পথ অতিক্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সম্ভব হয়েছে অনেক সময়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে যাওয়া।

আরও পড়ুন: মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?

এই মহাকাশযান আসলে বানানো হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছরের জন্য। কথা ছিল, সৌরজগতের বিশাল চারটি গ্রহকে কাছ থেকে দেখে, তাদের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হবে সে। পরে পরিকল্পনার পরিবর্তন হয়, এবং আজ ভয়েজার মহাকাশে ৪৪ বছর কাটিয়ে ফেলেছে। মহাকাশের নির্মম, রুক্ষ অবস্থা তাকে এখনও পর্যন্ত টলাতে পারেনি। হ্যাঁ, বেশিরভাগ যন্ত্রাংশই বন্ধ করে দিতে হয়েছে, যাতে তার জীবদ্দশা বৃদ্ধি করা যায়। এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়।

দিনটা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০। বিজ্ঞানী কার্ল সাগান, যিনি এই প্রকল্পের অন্যতম কারিগর ছিলেন, তিনি নাসার কাছে এক বিশেষ অনুরোধ রাখলেন। ভয়েজার তখন শনিকে ছাড়িয়ে চলে গেছে। তিনি বললেন, ভয়েজারের ক্যামেরা একবার পৃথিবীর দিকে ঘোরানো হোক। ওই দূরত্ব থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখায়, তা দেখার জন্য। শুরুতে নাসা রাজি হয়নি। ক্যামেরা পৃথিবীর দিকে ঘোরালে আশঙ্কা ছিল, তা সূর্যের রশ্মিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার। কিন্তু শেষমেষ ক্যামেরা ঘোরানো হয়, এবং ছবি ওঠে আমাদের পৃথিবীর। ৬ বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে। The Pale Blue Dot। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তোলা সবথেকে শক্তিশালী এবং অর্থবহ ছবিগুলির মধ্যে একটা। যে ছবি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা ঠিক কতটা ক্ষুদ্র। রাতের আকাশে গ্রহ, তারা, সবকিছুকে যেমন একটি বিন্দুর আকারে আমরা দেখি, ৬ বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকেও পৃথিবীকে ঠিক ওইরকমই দেখায়। ছোট্ট একটি বিন্দু।

ভয়েজার এখন আমাদের সৌরজগত ছাড়িয়ে চলে গেছে। শুরুতেই লিখেছিলাম সে পথ হারিয়েছে। না, নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য যদিও নেই তার। তবে সব ঠিকঠাক থাকলে এসি+৭৯৩৮৮ নামক এক নক্ষত্রের পরিবারে পৌঁছবে ভয়েজার। সময় লাগবে ৪০,০০০ বছর।

কিছুদিন আগের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজ্ঞানীরা কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ করেছেন। ভয়েজারকে যে সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে অ্যাটিটিউড আর্টিকুলেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম। তার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ভয়েজারের কার্যকলাপ ঠিক মিলছে না। মনে হচ্ছে, এই মহাকাশযান নিজের অবস্থান সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চিত নয়। তবে আশার আলো এটাই, যে ভয়েজারের অ্যান্টেনা এখনও পৃথিবীর দিকেই মুখ করে আছে, যা আমাদের তথ্য পাঠায়। এই মুহূর্তে ভয়েজার পৃথিবী থেকে যে দূরত্বে আছে, তাতে তথ্য আদানপ্রদান করতে প্রায় দু'দিন লাগে। সেই তথ্য আদানপ্রদান করার জন্য যে সিগন্যাল প্রয়োজন, তা এখনও শক্তিশালী। তাই এখনও কিছু বছর আমাদের হাতে সময় আছে।

কিন্তু তা খুব বেশি নয়। ভয়েজার শক্তি পায় তার সিস্টেমে থাকা রেডিও-আইসোটোপ থার্মো-ইলেকট্রিক জেনারেটর থেকে, যা কাজ করে প্লুটোনিয়াম থেকে পাওয়া শক্তির মাধ্যমে। অর্থাৎ, এখানে প্লুটোনিয়াম জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। সেই জ্বালানিও আর বেশি দিন থাকা সম্ভব নয়। তারপরেই চিরতরে এই মহাকাশযানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে নাসার, তথা মানবজাতির।

তারপর কোনও সভ্যতা যদি খুঁজে পায় তাকে অক্ষত অবস্থায়, তাহলে হয়তো শুনবে মানুষের কণ্ঠ, দেখবে মানুষের ছবি। সবই পাঠানো রয়েছে ভয়েজারের সঙ্গে। এই আশায় যে, একদিন ভয়েজারই সেই যোগাযোগ স্থাপন করবে, যা করার জন্য অধীর আগ্রহে কাজ করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা।

More Articles