মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?

১৩ জুলাই নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা জানালেন, একেবারে হৃদস্পন্দনের মতো রেডিও তরঙ্গ ধরা দিয়েছে কানাডার সুবিশাল টেলিস্কোপে। এমনটি এর আগে কখনও ধরা পড়েনি আবিশ্ব কোনও টেলিস্কোপেই।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রকাশিত মহাজগতের ছবির রেশ কাটেনি বিশ্ববাসীর। তারই মধ্যে ১৩ জুলাই নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা জানালেন, একেবারে হৃদস্পন্দনের মতো রেডিও তরঙ্গ ধরা দিয়েছে কানাডার সুবিশাল টেলিস্কোপে। এমনটি এর আগে কখনও ধরা পড়েনি আবিশ্ব কোনও টেলিস্কোপেই।

এই গবেষণায় বস্টনের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি, কানেকটিকাটের ইয়েল ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটি, কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি, টরেন্টো ইউনিভার্সিটির মতো বেশ কিছু নাম করা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ বা টিআইএফআর এবং পুনের ন্যাশানাল সেন্টার ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোফিজি়ক্সও যুক্ত রয়েছে।

এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষক ড. ড্যানিয়েল মিশিলি (Dr. Daniele Michilli) আজ একটি সাক্ষাৎকারে ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, "একেবারেই হৃদস্পন্দনের গ্রাফ বা লেখচিত্র যেরকম দেখায়, সেরকমই দেখতে এই রেডিও তরঙ্গের গ্রাফ।"

আরও পড়ুন: অন্য সৌরজগতে প্রাণের হদিশ দেবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ?

তাহলে কি প্রাণের স্পন্দন পেলেন গবেষকরা?

প্রকাশিত গবেষণাপত্রে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ধরণের তরঙ্গকে বলে ফাস্ট রেডিও বার্স্ট (Fast Radio Burst) বা FRB, যাদের স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড। কিন্তু সীমিত এই সময়ের মধ্যেই যে পরিমাণ শক্তি বিচ্ছুরিত হয় , তা তৈরি করতে সূর্যের এক বছর সময় লাগে। এই ধরণের রেডিও তরঙ্গের সন্ধান প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালে।

কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ (Lightyears) থেকে ধেয়ে আসা এই তরঙ্গ ধরা পড়েছে উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ CHIME বা দ্য কানাডিয়ান হাইড্রোজেন ইন্টেনসিটি ম্যাপিং এক্সপেরিমেন্টে (The Canadian Hydrogen Intensity Mapping Experiment) । এই ফাস্ট রেডিও বার্স্টের নামকরণ করা হয়েছে, FRB 20191221A।

জানা যাচ্ছে, এই রেডিও তরঙ্গের (FRB 20191221A) অনেকগুলি অংশ (Multicomponent) রয়েছে এবং দু'টি অংশের (Component) মাঝে ২১৬.৮ মিলিসেকেন্ডের ব্যবধান রয়েছে। রেডিও তরঙ্গটি সর্বমোট স্থায়ী হয়েছিল ৩ সেকেন্ডের জন্যে। নয়টি বা তারও বেশি অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে ভেসে আসা এই ফাস্ট রেডিও বার্স্ট।

ড. মিশিলি ইনস্ক্রিপ্টকে আরও জানিয়েছেন, "এই তরঙ্গ ভেসে আসছে কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে, যার থেকে প্রমাণ হয়, এই তরঙ্গের উৎস আকাশগঙ্গা কোনওমতেই নয়। আমাদের ছায়াপথের বাইরের কোনও উৎস থেকেই এটি এসে টেলিস্কোপে ধরা দিয়েছে।"

"এই ধরনের তরঙ্গ তখনই দেখা যায়, যখন সুদূরে কোনো নিউট্রন-স্টার (Neutron-star) তৈরি হয়", জানাচ্ছেন ড. মিশিলি। টেলিস্কোপে ধরা পড়া তরঙ্গ থেকে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র গবেষকরা ধারণা করছেন, এই তরঙ্গ নিউট্রন-স্টার ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থ্রি, ফোর থেকে ভেসে আসছে।

যদি ধেয়ে আসা এই ফাস্ট রেডিও বার্স্ট প্রমাণ করে মহাকাশে কোথাও নিউট্রন-স্টারের জন্ম হচ্ছে, তাহলে কেন রহস্যময় বলা হচ্ছে এই তরঙ্গকে? ড. মিশিলি জানাচ্ছেন, "সত্যি বলতে, নিউট্রন-স্টার তৈরি হচ্ছে মহাকাশে কোথাও, তা জোর দিয়ে এখনই বলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন আরও গবেষণা। তবে এরকম তরঙ্গ তখনই টেলিস্কোপে ধরা পড়ে, যখন নিউট্রন-স্টার তৈরি হয়। তাই আমরা সেরকমই ধারণা করছি।"

বা 'দ্য কানাডিয়ান হাইড্রোজেন ইনটেনসিটি ম্যাপিং এক্সপেরিমেন্ট'-এর সাহায্যে এখনও অবধি ১২৮ মিলিসেকেন্ডের বেশি রেডিও বার্স্ট মাপা যায় না। গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, এর ফলে ১২৮ মিলিসেকেন্ডের থেকে দীর্ঘ রেডিও বার্স্ট ধেয়ে এলেও, হয়তো তা মাপা যায়নি এই অসুবিধের কারণে। "এই কারণেই আমরা এই টেলিস্কোপটিকে আরও উন্নত করে তোলার চেষ্টা করছি এই মুহূর্তে", জানাচ্ছেন ড. মিশেলি।

কানাডার এই টেলিস্কোপটি দিয়ে খুব দ্রুত মহাকাশের বিভিন্ন বস্তুর অবস্থানের মানচিত্র বোঝা যায় এবং এর ফিল্ড ভিউ প্রায় দুশো স্কোয়ার ডিগ্রি। মহাকাশ থেকে ভেসে আসা ৪০০ থেকে ৮০০ মেগাহার্ৎজে়র যে কোনও তরঙ্গ এই টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। এই টেলিস্কোপে ধরা পড়া যে কোনও সংকেতকে হাইড্রোজেন ঘনত্বের একটি ত্রি-মাত্রিক মানচিত্রে পরিণত করা যায়। এবং যার ফলে খুব সহজেই মহাকাশের বিস্তার সম্পর্কে জানা যাবে বলে গবেষকদের ধারণা। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় অবধি, FAST-এ এক হাজারেরও বেশি ফাস্ট রেডিও বার্স্ট ধরা পড়েছে।

সাম্প্রতিকে প্রকাশিত এই গবেষণায় জানা যাচ্ছে, FRB 20191221A ছাড়াও আরও দু'টি ফাস্ট রেডিও বার্স্ট তরঙ্গ ধরা দিয়েছে টেলিস্কোপে, যাদের নামকরণ করা হয়েছে FRB 20210206A এবং FRB 202110213A । এই দুটি যথাক্রমে ২.৮ এবং ১০.৭ মিলিসেকেন্ডের কাছাকাছি স্থায়ী হয়েছিল।

এর কিছুদিন আগেই ন্যাশানাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজা়র্ভেশনের অফ চায়না-র (National Astronomical Observation of China) জ্যোতির্বিদরা পৃথিবীর বৃহত্তম টেলিস্কোপ অর্থাৎ ফাইভ হান্ড্রেড মিটার অ্যাপার্চার রেডিও টেলিস্কোপ বা FAST-এ তিন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে ধেয়ে আসা রিপিটিং ফাস্ট রেডিও বার্স্টের সন্ধান পান।

সেটিও দূরের কোনও ছায়াপথ থেকেই ভেসে আসছে বলে জানিয়েছিলেন সেই গবেষণার প্রধান গবেষক ড: ডি লি। তাঁরা জানিয়েছিলেন, এর মতো শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী রেডিও বার্স্ট আগে কখনও দেখা যায়নি। তাঁরাও 'নেচার' জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশ করে জানান, এই রেডিও বার্স্ট প্রতি ঘণ্টায় দেখা গিয়েছিল। এই রেডিও তরঙ্গের উৎস কোনও নিউট্রন-নক্ষত্র থেকেই আসছে বলে জানিয়েছিলেন চিনের গবেষকরাও।

 

 

More Articles