কংগ্রেস আমলে পদ্মশ্রী, বিজেপি আমলে গ্রেপ্তার! তিস্তাতে কেন রুষ্ট সরকার?

কেন গ্রেপ্তার তিস্তা শেতলাবাদ? এর উত্তর একটাই, গণহত্যার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলা মানবাধিকার কর্মী জেলে, ফ্যাসিবাদের এই উল্লাসমঞ্চ আবারও স্বাগত জানাল ভারতবাসীকে।

মনমোহন জমানায় পদ্মশ্রী। আর মোদি জমানায় তাঁর ঠিকানা হল শ্রীঘর। লড়াইয়ের নাম তিস্তা শেতলাবাদ। কে এই তিস্তা? শুধুমাত্র এক উজ্জ্বল বংশের উত্তরাধিকার বহন করে সুখে থাকতে পারতেন তিস্তা। কিন্তু দেশে আলোড়ন ফেলা দেওয়া ঘটনা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে লাইমলাইটে। সেই সঙ্গে উপহার দিয়েছে একরাশ বিতর্ক।

কিছুদিন আগের ঘটনা। গুজরাত দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দেয় সুপ্রিম কোর্ট। নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সু্প্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন গুজরাত দাঙ্গায় নিহত এক কংগ্রেস সাংসদের স্ত্রী। যদিও এই মামলার কোনও ভিত্তি নেই বলেই জানিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এর আগে গুজরাত সরকারের গঠিত সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দলও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দিয়েছিল। সিট-এর সেই সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দিল শীর্ষ আদালত।

গুজরাত দাঙ্গা চলাকালীন গুলবার্গ সোসাইটির গণহত্যার ঘটনায় নিহত ৬৯ জনের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি। তাঁর স্ত্রী জাকিয়া জাফরি মোদিকে সিট-এর দেওয়া ক্লিনচিটের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাই খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

আরও পড়ুন: গুজরাত দাঙ্গায় নিহত স্বামী, যে লড়াই জাকিয়া জাফরি লড়ছেন

ঘটনা-পরম্পরা এখানেই শেষ নয়।

গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে নিহত কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া এবং সমাজকর্মী তিস্তা যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। যে মামলার মূল কথা ছিল, ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া ক্লিনচিট খারিজ করুক আদালত। শুক্রবারই সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদনকে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দেয়। পাশাপাশি তিস্তার ভূমিকারও সমালোচনা করে। ঘটনাচক্রে, শনিবারই তিস্তার বিরুদ্ধে আমেদাবাদের থানায় এফআইআর দায়ের হয়। শনিবারই গুজরাতের এটিএস মুম্বই এসে গ্রেপ্তার করে তিস্তাকে। রবিবার তাঁকে হাজির করানো হয় মুখ্য মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। এরপর নানা মহলে তাঁর গ্রেপ্তারি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

গ্রেপ্তারি বিতর্ক
গুজরাতের জঙ্গিদমন শাখার (এটিএস) হাতে গ্রেফতার হওয়া সমাজকর্মী তিস্তা শেতলাবাদ তাঁকে মারধরের অভিযোগ তুললেন। দাবি করলেন তাঁকে বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে। তিস্তাকে ১ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।আমেদাবাদে তাঁর বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের হওয়ার পর শনিবার এটিএস তাঁকে মুম্বইয়ের জুহু-র বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রবিবার তাঁকে আমেদাবাদের আদালতে পেশ করা হয়। সেখানেই তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন। তিনি আদালতে বলেন, ‘এটিএসের আধিকারিকরা কোনও পরোয়ানা ছাড়াই আমার বাড়িতে ঢুকে পড়েন। তাঁরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ফোনটি ছিনিয়ে নেন। একটি এফআইআরের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার কি আইনসংগত? আমাকে কেন নোটিস দেওয়া হল না? দুপুর ৩টে থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আমাকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হল কেন?’ তিস্তার ওপর অত্যাচার নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

ঠাকুরদা দেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল
১৯৬২ সালে এক গুজরাতি পরিবারে জন্ম তিস্তা শেতলাবাদের। বাবা অতুল শেতলবাদ মুম্বইয়ের আইনজীবী। ঠাকুরদা এম সি শেতলবাদ ছিলেন দেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল। এই উজ্জ্বল পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করে নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পারতেন তিনি। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্তে দিন কাটাননি। বিতর্কে জড়াবেন জেনেও ঝাঁপিয়েছেন লড়াইয়ে। ঠাকুরদা এবং বাবা তাঁকে যে আইনের দরজা দেখিয়েছেন, তাঁর ভরসাতেই মোদির বিরুদ্ধেও আদালতে গেছেন এই লড়াকু মেয়েটা।

১৯৮৩ সালে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোজফিতে স্নাতক তিস্তা। এরপরই তিনি যোগ দেন সাংবাদিককতায়। তবে ১৯৯৩ সালেই সাংবাদিকতার মূল স্রোত থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। তবে তিনি ও তাঁর স্বামী তখন একটি মাসিক পত্রিকা বের করতেন। যার নাম 'কমিউন্যালিজম কমব্যাট'। ২০০২ সালে গুজরাত হিংসার পর তিস্তা সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস নামে একটি এনজিও তৈরি করেন। হিংসা মামলায় সহযোগী হিসেবে দ্বারস্থ হন আদালতের।

২০০৭ সালের মার্চ মাসে গুজরাত হাইকোর্টে একটি বিশেষ ফৌজদারি মামলায় জনৈক জাকিয়া জাফরির সঙ্গে সহ-আবেদনকারী হিসেবে নাম ছিল তিস্তার। মোদি-সহ ৬১ জন রাজনীতিবিদ ও আমলার বিরুদ্ধে এফআইআরও দায়ের করেন তিনি। মোদির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবিও জানান। শেতলাবাদের সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর পরেই উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। আদালত সিট গঠনের নির্দেশ দেয়। ২০১৮ সালে শেতলাবাদ ও তাঁর স্বামী জাভেদ আনন্দের বিরুদ্ধে আমেদাবাদের ডিসিবি থানায় এফআইআর দায়ের হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে এনজিও-র অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ দায়ের করেন জনৈক রইস খান। গুলবার্গ সোসাইটিতে মিউজিয়াম গড়তে বিদেশিদের থেকে অর্থসাহায্য নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

কংগ্রেস আমলে পদ্মশ্রী
একাধিক অভিযোগ থাকলেও তিস্তাকে ২০০৭ সালে পদ্মশ্রী দেয় মনমোহন সরকার। বিজেপি আজ তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করার অভিযোগ এনেছে। তবে একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে তিস্তা শেতলাবাদ যে এক বিতর্কিত চরিত্র, তাতে সন্দেহ নেই। বিতর্ক আসবে জেনেও লড়াইয়ের মাঠ থেকে চম্পট দেননি তিস্তা।

গুলবার্গ গণহত্যা
গুলবার্গ গণহত্যা বারবার তিস্তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। কী এই ঘটনা? ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাত দাঙ্গার সময় আমেদাবাদের গুলবার্গ হাউসিং সোসাইটি গণহত্যায় নিহত হন প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি-সহ ৬৯ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ওই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি। আমেদাবাদের বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা, পুলিস অফিসার ও আমলার বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।

জাকিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তে নামে গুজরাত-দাঙ্গার বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে 'সিট'-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে কোনও রায় দেয়নি শীর্ষ আদালত। এরপর জল অনেক দূর গড়ায়। শেষে মোদির স্বস্তি ও তিস্তার জেল।

সব ভুলে যাওয়ার কথাই তো বলছে রাষ্ট্র! ভুলতে পারেননি জাকিয়া জাফরি, খুন হওয়া কংগ্রেস সাংসদের স্ত্রী। ভুলতে পারেননি তিস্তা শেতলাবাদের মতো মানবাধিকার কর্মীরা। তাই রাষ্ট্র বেপরোয়া।

কেন গ্রেপ্তার তিস্তা শেতলাবাদ? এর উত্তর একটাই, গণহত্যার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলা মানবাধিকার কর্মী জেলে, ফ্যাসিবাদের এই উল্লাসমঞ্চ আবারও স্বাগত জানাল ভারতবাসীকে। বিচারের নামে এ নিছক প্রহসন নয়? হয়ত আদালতের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকিয়ে অট্টহাস্য করছে ফ্যাসিবাদ।

More Articles