গুজরাত দাঙ্গায় নিহত স্বামী, যে লড়াই জাকিয়া জাফরি লড়ছেন
আদালতের দাবি, স্বামীর মৃত্যুতে আবেগতাড়িত জাকিয়া। তাঁর এই আবেগকে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছেন তিস্তার মতো কয়েকজন। তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত বলেও মন্তব্য করে আদালত। এরপরই সটান মুম্বই এসে গুজরাত পুল...
নামের পাশে জ্বলজ্বল করত স্বাধীনতা সংগ্রামীর উপমা। দেশের সংসদেও প্রবেশ ঘটেছিল সসম্মানে। পাড়া-পড়শি তো বটেই, দিল্লির রাজপথেও সমাদর ছিল যথেষ্ট। স্বামীর এই কৃতিত্ব মাথায় করে নিয়ে কেটে যেতে পারত বাকি জীবন। কিন্তু শেষ সময় স্বামীকে চরম অসম্মানিত হতে দেখতে হয়েছে তাঁকে। চোখের সামনে প্রিয় মানুষের দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে উল্লাস করতে দেখেছেন জল্লাদের দলকে। রক্তমাখা মাংসপিণ্ড একটি একটি করে আগুনে ঝলসাতে দেখেছেন। তার পরও গত দু’দশক ধরে জীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন জাকিয়া জাফরি। যে স্বামীর পরিচয় মাথায় নিয়ে শান্তিতে চোখ বুজতে চেয়েছিলেন, আজ ৮৩ বছর বয়সে সেই স্বামীর খুনের বিচার চাইতেই এ-দরজা, ও-দরজা ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাঁকে।
বিবাহসূত্রে যশস্বী পুরুষের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা পড়লেও, বাড়ির অন্দরমহলেই মোটামুটি জীবনের ৬৩টি বছর কাটিয়েছেন জাকিয়া। কিন্তু এক জতুগৃহর আগুন দীর্ঘ দু’দশক ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে। সেই আগুনে শুধু মন পোড়েনি তাঁর, পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে প্রথম জীবনের সুখকর স্মৃতিও। হাতড়াতে গেলেই বুকের মধ্যে জ্বালা, যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাস টের পান শুধু। কিন্তু নিভৃতে সন্তাপও বিলাসিতা বলে ঠাহর হয়। তাই বেরতেই হয়। মনে হয়, এই হয়তো জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োবে। কিন্তু পরক্ষণেই আরও বৃহত্তর আকারে নেমে আসে আঘাত। ক্ষত-বিক্ষত হয়েও ফের উঠে দাঁড়াতে হয় জাকিয়াকে। না চাইতেই গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে রুক্ষ স্বর। তিরিক্ষি হয়ে কখনও কখনও ফুটে ওঠে অস্থিরতা। আইনি ঘোরপ্যাঁচের সামনে নগণ্য জেনেও এসপার-ওসপার দেখে ছাড়বেন বলে দেন বটে। কিন্তু দিনের শেষে প্রতিবার আরও দগ্ধ হয়েই ফিরতে হয়ে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি তথা প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় স্বামীর খুনের পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল বলে প্রমাণ করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে। তার আগের কয়েক বছর মামলা-মোকদ্দমার জন্য নিজেকে তৈরি করতেই কেটে গিয়েছে তাঁর। গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর সরকারের মন্ত্রী, আমলা এবং পুলিশ আধিকারিক মিলিয়ে ৬৩ জনের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত না করেই, সকলকে ক্লিনচিট দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ জাকিয়ার। কিন্তু নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত হয়ে সর্বোচ্চ আদালত- যেখানেই গিয়েছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন জাকিয়া। তাঁর অভিযোগের কোনও সারবত্তা খুঁজে পাননি মহামান্য আদালতের বিচারপতিরা। বরং আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি বিপথে চালিত হয়েছেন বলে নিদান এসেছে। তবুও ন্যায্য বিচারের আশা ছাড়ছেন না জাকিয়া।
আরও পড়ুন: ইতিহাস বই থেকে বাদ গুজরাত দাঙ্গা, সিলেবাস বদলে যে সত্যি আড়াল করছে বিজেপি
২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের গোধরা রেল স্টেশনের কাছে সবরমতী এক্সপ্রসের কামরায় আগুন ধরিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। অযোধ্যা থেকে আমেদাবাদে ফেরার পথে ওই আগুনে ঝলসে মৃত্যু হয় শিশু, মহিলা-সহ ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীর। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আকারে নিমেষে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা গুজরাতে। পর দিন সকাল হতে হতে সেই আগুন গ্রাস করে রাজধানী আমেদাবাদকেও। আমেদাবাদের উত্তরে চমনপুর এলাকাটি মূলত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলমান অধ্যুষিত। উঁচু দেওয়ালে সন্নিবিষ্ট গুলবার্গ সোসাইটিকে তার মধ্যে নিরাপদ মনে হয়েছিল স্থানীয়দের। প্রায় ২০০ মানুষ তাই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু গুলবার্গ সোসাইটি জতুগৃহে পরিণত হলে, তাতে পুড়িয়ে মারা হয় কমপক্ষে ৬৯ জনকে, সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩৯। ছাইয়ের স্তূপে বহু মানুষের দেহের অবশিষ্টাংশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই গুলবার্গ সোসাইটিতেই বাস ছিল এহসান জাফরি, জাকিয়া এবং গোটা পরিবারের। আদতে মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরের বাসিন্দা হলেও, সপরিবারে মাত্র ছ’বছর বয়সে আমদাবাদে চলে আসেন এহসান জাফরি। উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকাকালীনই উর্দুতে একটি পত্রিকা বার করেন তিনি। ১৯৪০ নাগাদ যোগদান স্বাধীনতা সংগ্রামে। শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাও ছিলেন। শ্রমিক বিপ্লবে উসকানি জোগানোর অভিযোগে জেল খাটেন। তারপর আইন নিয়ে পড়াশোনা এবং আমেদাবাদেই প্র্যাকটিস শুরু। ১৯৬৯-এর দাঙ্গাতেও তাঁদের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঠাঁই হয় ত্রাণ শিবিরে। পরে ফের ওই জায়গাতেই বাড়ি তৈরি করেন, গড়ে তোলেন গুলমার্গ সোসাইটি।
১৯৬৯-এর দাঙ্গাই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করতে বাধ্য করে এহসান জাফরিকে। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। আমেদাবাদের প্রথম মুসলিম সাংসদও নির্বাচিত হন তিনি। তবে ওই একবারই। পরবর্তীকালে সামাজিক কাজকর্ম, সাহিত্যেই ডুবে যান। নির্বাচনী রাজনীতিতে আর অংশ নেননি। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজকোট থেকে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দেওয়ার বিরোধিতা করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দেওয়া উচিত নয় বলে প্রকাশ্যে জনমতও তৈরি করতে উদ্যোগী হন তিনি। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই গোধরা কাণ্ড ঘটে এবং সবার আগে গুলবার্গ সোসাইটির ওপরেই জোরালো আঘাত নেমে আসে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, আইনজীবী এবং সর্বোপরি সাংসদ পরিচয়ের জন্য এলাকার মানুষজন এহসান জাফরিকে সম্ভ্রম করে চলতেন। ১৯৮৫-র দাঙ্গার সময় তাঁর পরিবারকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। তাই গোধরা কাণ্ডের পর অশান্তির আবহ তৈরি হতে দেখে উঁচু দেওয়ালে ঘেরা গুলবার্গ সোসাইটিতে, এহসান জাফরির নিরাপদ আশ্রয়েই মাথা গুঁজতে ছুটে যান বহু মানুষ। সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ প্রায় ২০০ মানুষ জড়ো হন গুলবার্গ সোসাইটিতে। এতসংখ্যক মানুষকে নিয়ে কী করবেন ভেবে না পেয়ে তদানীন্তন গুজরাত সরকারের শীর্ষ আমলা থেকে আধিকারিক, রাজ্য পুলিশের আধিকারিক, এমনকী, দিল্লিতে ফোন করেও সাহায্য প্রার্থনা করেন এহসান জাফরি।
ওই সময়ই গুলবার্গ সোসাইটির বাইরে উন্মত্ত ভিড়ের আনাগোনা শুরু হয়। ভেসে আসতে শুরু করে হুমকি, হুঁশিয়ারি। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ আমেদাবাদের তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার গুলবার্গ সোসাইটি পৌঁছন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশ বাহিনী পাঠাচ্ছেন বলে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যান তিনি। কিন্তু দু’কিলোমিটারের মধ্যে পুলিশ-প্রশাসন সব থাকলেও, সোসাইটির অনতিদূরে পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকলেও, সাহায্য এসে পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এর পর একে একে প্রথমে সোসাইটির বাইরের জাকির বেকারিতে আগুন ধরানো হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একটি অটো। তার পর হুড়মুড় করে সোসাইটির ভেতর ঢুকে পড়ে উন্মত্তের দল। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারে কেরোসিন ঢেলে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন।
জাকিয়া এবং গুলবার্গ সোসাইটি থেকে বেঁচে ফিরে আসা মানুষজনের দাবি, স্ত্রী এবং অন্য মহিলাদের দোতলার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েচিলেন এহসান জাফরি। ভিড়ের খুনি আচরণ দেখে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে লাগাতার ফোন করে সাহায্য চাইতে থাকেন তিনি। ফোন করেন কন্ট্রোলরুমেও। কিন্তু উল্টো প্রান্ত থেকে ভেসে আসে বিদ্রূপ, গালাগালি। এরপর বন্ধ দরজার ভেতর থেকে সকলে দেখতে পান যে, তিন তরুণীকে ধরে ফেলেছে উন্মত্তের দল। তাঁদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করছে তারা। তাতে বন্ধ দরজার পিছন থেকে হামলাকারীদের টাকার লোভ দেখান এহসান জাফরি। তাঁর সঙ্গে রফা করতে রাজি হয় উন্মত্তের দলও। সেই মতো দরজা ঈষৎ ফাঁক করে হাত গলিয়ে টাকা ছুড়ে দিতে উদ্যত হন এহসান জাফরি।
কিন্তু দরজা দিয়ে হাত বের করা মাত্র এহসান জাফরিকে বাইরে টেনে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। বেধড়ক মারধর করা হয় প্রথমে তাঁকে। তার পর ওপর-নিচে, আড়াআড়িভাবে টুকরো করা হয় শরীর। আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে একটি একটি করে দেহাংশ ফেলে দেওয়া হয়। তারপরই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় গোটা সোসাইটিতে। জাকিয়া এবং পীড়িতদের দাবি, ঘটনার সময় গুলবার্গ সোসাইটি থেকে অনতিদূরেই পুলিশের তিনটি ভ্যান দাঁড় করানো ছিল। কিন্তু কেউ আসেনি। সাহায্য এসে পৌঁছয় প্রায় ন’ঘণ্টা পর, যখন কেন্দ্রীয় সরকারের র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (RAF) সোসাইটিতে এসে পৌঁছয়। কিন্তু ততক্ষণে ৬৯টি শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কাউকে শনাক্ত করার মতো অবস্থায় রেখে যায়নি। এহসান জাফরি, তাঁর তিন ভাই এবং দুই ভাইপোকেও খুন করে গিয়েছে সেই খুনে দল। পীড়িতদের দাবি, পুরসভা থেকে কাগজে ছাপিয়ে এলাকায় বসকারীদের নামের তালিকা নিয়ে সোসাইটিতে ঢুকেছিল হামলাকারীর দল।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলবার্গ সোসাইটিতে নিজের প্রাণ দিয়ে সকলকে আগলে রেখেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ ছিলেন বলেই নয়, গুজরাতের প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির শেষ ধারক-বাহক হিসেবেই আজও এহসান জাফরিকে মনে রেখেছেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। ইন্দুলাল ইয়াগনিকের ১৯২০ সালের সাবেক কংগ্রেসি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এহসান জাফরি। ইন্দুলাল ছিলেন দরিদ্র, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের প্রতি দরদি। ধীরে ধীরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, কেএম মুন্সি, গুলজারিলাল নন্দ এবং মোরাজি দেসাইয়ের মতো নরম হিন্দুত্ব-ঘেঁষা নেতাদের ভিড় বাড়লে দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এরপর মহাত্মা গন্ধীর অনুরোধ সত্ত্বেও কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ইন্দুলাল। গুজরাতের মুক্ত রাজনীতির জনক ছিলেন তিনি, ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসে বিভাজন ঘটলে ইন্দিরা গান্ধীকে অনুসরণ করেন। ১৯৫৭ সাল থেকে আমেদাবাদ আসনটি তাঁর দখলে ছিল। ১৯৭১ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন।
১৯৭৭ সালে ওই আমেদাবাদ আসনেই নির্বাচিত হন এহসান জাফরি। তাঁর হাত ধরে ক্ষত্রিয়, হরিজন, আদিবাসী এবং মুসলিমদের নিয়ে KHAM জোট গড়ে ওঠে গুজরাতে। স্বামীর এই আদর্শের সঙ্গেই একাত্ম হয়ে যান জাকিয়া। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গুলবার্গ সোসাইটির পীড়িতদের পাশে বরাবর দেখা গিয়েছে তাঁকে। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-পারসি, ধর্মবিশ্বাস আলাদা হলেও, মনুষ্যত্ববোধই শেষ কথা বলে বিশ্বাস তাঁর। ২০০৬ সালের ৮ জুন পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন জাকিয়া। তাতে বাকিদের সঙ্গে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া, জয়দীপ প্যাটেল, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার পিসি পান্ডের নাম উল্লেখ করেন। পুলিশ, সরকার এবং আমলারা মিলে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের আওতায় মুসলিমদের গণহত্যা হতে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। ২০০৮ সালে বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) গঠন করে বিষয়টির তদন্তের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
শীর্ষ আদালত নিযুক্ত ওই তদন্তকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন সিবিআই কর্তা আরকে রাঘবন। তদন্তকারী দলে ছিলেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিজি সিডি সৎপতি, গুজরাত ক্যাডারের তিন জন আইপিএস অফিসার, গীতা জোহরি, শিবানন্দ ঝা এবং আশিস ভাটিয়া। আমদাবাদ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তাঁদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেইমতো তদন্তে ইতি টেনে ২০১২ সালে রিপোর্ট জমা দেন তাঁরা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, নরেন্দ্র মোদি এবং বাকিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। আমেদাবাদ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তা গৃহীত হয়। কিন্তু সকলকে ক্লিনচিট দেওয়ার বিরোধিতা করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ফের মামলা দায়ের করেন জাকিয়া, যা খারিজ হয়ে যায়। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গুজরাত হাইকোর্টও তাঁর মামলা খারিজ করে দেয়। এর পর ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন জাকিয়া। গুজরাত দাঙ্গার পীড়িতদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালানো সমাজকর্মী তিস্তা শেতলাবাদ তাতে জাকিয়ার সহ-মামলাকারী হন।
একাধিকবার মামলার শুনানি স্থগিত রাখার পর সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও জাকিয়ার মামলা খারিজ করে দিয়েছে। জাকিয়ার অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই বলে জানিয়েছে তারা। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে ষড়যন্ত্রের আওতায় ফেলা অনুচিত বলেও জানিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে আদালতের দাবি, স্বামীর মৃত্যুতে আবেগতাড়িত জাকিয়া। তাঁর এই আবেগকে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছেন তিস্তার মতো কয়েকজন। তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত বলেও মন্তব্য করে আদালত। এরপরই সটান মুম্বই এসে গুজরাত পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখা তিস্তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭১ ব্যাচের আইপিএস অফিসার তথা গুজরাত দাঙ্গার সময় নিযুক্ত সেখানকার সশস্ত্র পুলিশের প্রাক্তন ডিআইজি আরবি শ্রীকুমারকেও। গুজরাত সরকারের তৎকালীন আমলারা মিথ্যে বয়ান দিতে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি।
প্রাক্তন আইআইটি-বম্বের ছাত্র, আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভট্টও সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। দাঙ্গা চলাকালীন নরেন্দ্র মোদি একটি বৈঠক ডেকেছিলেন, সেখানে হিন্দুদের ক্ষোভ এবং রোষ প্রকাশ প্রকাশের সুযোগ করে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন সঞ্জীব। আদালত নিযুক্ত SIT-র সঙ্গে তৎকালীন গুজরাত সরকারের ষড় ছিল বলেও অভিযোগ করেন। চাকরি থেকে আগেই বরখাস্ত হয়েছেন সঞ্জীব। হেফাজতে বন্দির মৃত্যু মামলায় জেলবন্দি তিনি। তবে এখনও হাল ছাড়তে নারাজ জাকিয়া। তিনি সাফ জানিয়েছেন, ‘এহসান সাহেব’-এর জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। আদালতের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর। কারও প্রতি আক্রোশ নেই তাঁর। কিন্তু একদিন না একদিন ন্যায্য বিচার হবে বলে বিশ্বাস করেন। মক্কায় হজে গিয়েছেন জাকিয়ার ছেলে তনভির জাফরি। হজ থেকে ফিরে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।