পাঞ্জাবে চলল না চান্নির চাল, কোন ভুলে সাম্রাজ্য হারাল কংগ্রেস?

এবারে শুধু দিল্লি নয়, দিল্লির সাথে পাঞ্জাবেও সরকার গঠন করতে চলেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। কংগ্রেস, বিজেপি এবং অকালি দলকে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে পাঞ্জাবে প্রবেশ করল আপ। বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষা এবং জনমত সমীক্ষা থেকেই বিষয়টা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। কোনদিনই পাঞ্জাবে বিজেপির তেমন একটা প্রভাব ছিল না। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং পাঞ্জাব লোক কংগ্রেস স্থাপন করে বিজেপির সঙ্গে জোট তৈরি করলেও এই নির্বাচনে বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা খুব কমই ছিল, সৌজন্যে, কৃষক আন্দোলন। কিন্তু, ২০২২ পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচন যে রাজনৈতিক দলের জন্য সবথেকে বেশি হতাশাব্যঞ্জক, সেটা হল কংগ্রেস। শুধুমাত্র, পাঞ্জাব নয়, পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে সবকটিতেই হতশ্রী ফলাফল করছে হাত।

উত্তর প্রদেশ বিধানসভাতেও খুবই খারাপ ফল করল কংগ্রেস। উত্তরাখণ্ড এবং গোয়ায় কংগ্রেস কিছুটা প্রভাব দেখাতে পারলেও, বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা তাদের পক্ষে কার্যত ছিল অসম্ভব। এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন ছিল আগামী লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল। আর তাতেই কংগ্রেসের এই ফলাফল প্রশ্ন তুলছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির উপরেই। একটা রাজনৈতিক দল, যারা কয়েক যুগ ধরে ভারত শাসন করে এসেছিল, তারা আজ কার্যত মুছে গিয়েছে ভারতের মানচিত্র থেকে। স্বাধীন ক্ষমতাবলে এই মুহূর্তে শুধুমাত্র রাজস্থান এবং ছত্রিশগড়ে ক্ষমতায় রয়েছে কংগ্রেস। মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড এবং তামিলনাড়ুতে জোট করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে এই দলটি। কিন্তু তাতেও কি বিশেষ কিছু লাভ হচ্ছে? ঠিক কি কারণে ভারতের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল কংগ্রেস?

ক্যাপ্টেন অপসারণ

কিন্তু এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যেও যে রাজ্যে কংগ্রেসের পক্ষে যে রাজ্যে সবথেকে সহজ ছিল, অর্থাৎ পাঞ্জাব, সেখানেও আম আদমি পার্টির কাছে পরাজিত হলেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কারা। কৃষি আইনের বিরোধিতা করে ২০২০-তে পাঞ্জাবে একটা ভালো প্রভাব তৈরি করে ফেলেছিল কংগ্রেস। পাঞ্জাবের কৃষক বিদ্রোহের সময়ও তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতারা। এক বছর ধরে সেই আন্দোলন চলে। সেই আন্দোলনে কৃষকদের পাশে থেকে, পাঞ্জাবে একটা বেশ ভালো জায়গাও তৈরি করে ফেলেন সিধুরা। তবে তার পরেই, পটপরিবর্তন হতে শুরু করে পাঞ্জাবের রাজনীতিতে। কার্যত নিজের দলের চাপে পড়েই মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং। কংগ্রেস ছেড়ে পাঞ্জাব লোক কংগ্রেস তৈরি করে তিনি বিজেপির কাছাকাছি চলে আসেন, যা কংগ্রেস সরকারের জন্য সবথেকে বড়ো সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়।

অন্যদিকে কংগ্রেসের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন চরণজিৎ সিং চান্নি। এবং কংগ্রেসের সভাপতি হন নভজোৎ সিং সিধু। তবে, এখান থেকেই পাঞ্জাব কংগ্রেসে শুরু হয় ডামাডোল। অমরিন্দর সিং দল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেসের ভিতরেই ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। পাঞ্জাব কংগ্রেসের মধ্যে ক্যাপ্টেনের বেশ ভালো একটা প্রভাব ছিল। তিনি দল ছাড়ার সঙ্গে দলের অন্দরেই বিক্ষোভে নেমে পড়েন কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অবস্থা সামাল দিতে আসলেও তেমন একটা লাভ হয়নি।

চান্নি ও সিধুর সমস্যা

ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়ার পরেই কংগ্রেসের অন্দরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নভজোৎ সিং সিধু। কিন্তু, দলের ইচ্ছা ছিল কিছুটা আলাদা। তারা মুখ্যমন্ত্রী পদে সিধুকে না এনে বসিয়ে দেন একজন দলিত নেতা চরণজিৎ সিং চান্নিকে। কংগ্রেসের তরফ থেকে এই পদক্ষেপকে মাস্টার স্ট্রোক হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, আদতে তেমন একটা লাভ হয়নি। উল্টে সিধু এবং চান্নি দুজনের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই শুরু হয় দুটি আলাদা আলাদা দলের রাজনীতি। একদিকে যেমন ছিলেন সিধু, অন্যদিকে, ছিলেন চান্নির সমর্থকরা। কংগ্রেস হাইকমান্ডের কাছে এই দুজনের মধ্যে সমস্যা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করার চেষ্টা করলেও সেই চেষ্টা কার্যত বৃথা হয়।

নভজোৎ সিং সিধু ও চরণজিৎ সিং চান্নির মধ্যে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করতে শুরু করে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করতে শুরু করেন নভজোৎ সিং সিধু। একটা সময় মনে হয়েছিল ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং এর মতো তিনিও দলবদল করতে পারেন। পরে যদিও সেটা হয়নি। আসলে তার কাছে খুব একটা বেশি বিকল্প খোলা ছিল না। তাই, শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুটা ব্যাকফুটে চলে আসেন। আরো একবার মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয় চান্নিকে। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নির্বাচনে পাঞ্জাব কংগ্রেসের মধ্য থেকে নভজোৎ সিং সিধু একটাও ভোট পেলেন না। সেই সময় থেকেই কিছুটা পিছিয়ে আসতে শুরু করলেন তিনি। বিধানসভা নির্বাচনে তাকে প্রচারেও বিশেষ একটা দেখা যায়নি। তার সমর্থকরাও কংগ্রেসের প্রতি হয়ে উঠেছিল বীতশ্রদ্ধ। ঠিক এই সমস্যাকেই কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের অধিকাংশ ভোট নিজেদের দিকে টেনে নেয় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।

অপরিণত রাজনীতি - প্রিয়াঙ্কা গান্ধী

এবারের নির্বাচনে পাঞ্জাব কংগ্রেসের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল তাদের প্রচার। একদিকে যেমন তারা দলিত মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করলেন, তেমনি প্রচারে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও করলেন কিছু বেফাঁস মন্তব্য। ফেব্রুয়ারীতে পাঞ্জাবে একটি প্রচারে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বললেন, "অমরিন্দর সিং এর সরকার কেন্দ্রে বিজেপি দ্বারা পরিচালিত হতো।" এই কথাটি কংগ্রেসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। অন্যদিকে, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর প্রচারের একটা অন্যতম অংশ ছিল মহিলাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার। তেমনটা করতেও অনেকটাই অসফল ছিলেন তিনি। দলিত নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে উচ্চবর্ণের মানুষের কাছেও কিছুটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার সিদ্ধান্তে কংগ্রেসের অনেক নেতাই কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ধীরে ধীরে জর্জরিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পাঞ্জাব কংগ্রেস, যা জনগণের চোখে পড়তে খুব একটা সময় নেয়নি।

জনগণের ক্ষোভ

কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ অনেকাংশেই বাড়তে শুরু করেছিল। গত পাঁচ বছরে পাঞ্জাব সরকার তাদের দেওয়া একটাও প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি ঠিকভাবে। গত পাঁচ বছরে পাঞ্জাবের সবথেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যুবদের বেকারত্ব। পাঞ্জাব সরকার এই সমস্যার সঠিক কোন সমাধান করতে পারেনি। ২০১৭ সালে যখন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, সেই সময় তারা 'ঘর ঘর নৌকরি' নামের একটি প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল। তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রত্যেকটি বাড়ির কোন একজন ব্যক্তিকে অন্তত চাকরি দেওয়া হবে সরকারের তরফ থেকে। সে রকম প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, বরং বেকারত্ব আরো দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে শুরু করেছিল পাঞ্জাবে। ২০২১ সালের শেষদিকে পাঞ্জাবের বেকারত্ব হার এসে দাঁড়ায় ৭.৮৫ শতাংশে।

কৃষক আন্দোলন ও কংগ্রেস

কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি আইনের বিরোধিতা করে সারা ভারত জুড়ে যে কৃষি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার মূল সূত্রপাত হয়েছিল পাঞ্জাব থেকেই। সমস্ত বিরোধী দলগুলি বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেও কংগ্রেসের প্রচারে তেমন একটা জোর ছিল না। সর্বোপরি, কংগ্রেস বলতে গেলে অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সকলেই যখন এই কৃষক আন্দোলনকে পাখির চোখ করে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে ছিলেন, সেই সময়ে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌণ। পাঞ্জাব সরকারের বিরুদ্ধেও কৃষকদের অভিযোগ ছিল একাধিক। তাই বলতে গেলে কৃষক আন্দোলনকে একেবারে নিজেদের প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে পারেনি কংগ্রেস।

আপের উত্থান

এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস যখন একের পর এক সমস্যায় পড়তে শুরু করেছে, সেই জায়গা থেকেই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে প্রবেশ করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ভগবন্ত মানকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে চলে লড়াই। দিল্লি মডেলকে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবের মাটিতে নিজেদের জমি শক্ত করা শুরু করে আম আদমি পার্টি। বেকারত্ব, পাঞ্জাবের ড্রাগস সমস্যা, এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের মনে জায়গা তৈরি করতে শুরু করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আম আদমি পার্টির ইশতেহারেও ছিল একাধিক চমক। হাসপাতাল এবং বিদ্যালয়ের পরিস্থিতির উন্নয়ন থেকে শুরু করে পবিত্রতা এবং অপবিত্রতার মামলায় কড়া শাস্তির প্রতিশ্রুতি, বেকারদের কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে কৃষকদের সমস্যার সমাধান, সবকিছুর উপরেই লক্ষ্য রেখেছিল আম আদমি পার্টি। এই ইশতেহারের সামনে কংগ্রেসের ইশতেহার কার্যতই ছিল ফিকে। সর্বোপরি, তাদের বিগত ৫ বছরের কাজেই কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেছিল পাঞ্জাবের মানুষ। তাই পাঞ্জাবে কংগ্রেসের এই ফলাফল ছিল কার্যত সময়ের অপেক্ষা

More Articles