কীসের টানে গান্ধীজির আশ্রমে আসেন বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা?

সবরমতী আশ্রম বললেই মাথায় আসে লবণ সত্যাগ্রহ এবং গান্ধীজির প্রসঙ্গ। আর তাই বারবার বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতা ভারতে সফরে এলেই উপস্থিত হন গুজরাতের সবরমতী আশ্রমে। সেখানে ভিজিটর্স বুকে লিখে দিয়ে যান নিজেদের অনুভূতি। সদ্য এখান থেকে ঘুরে গেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। 
মাটিতে আসনে বসে চরকায় সুতো কাটছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এক মহিলা তাঁকে শিখিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে চালাতে হয় চরকা। এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৯১৭ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত গুজরাতের এই সবরমতী আশ্রমই ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ঠিকানা। সেখানে এসে মুগ্ধ বরিস। আশ্রম ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে 'ভিজিটর্স বুক'-এ লেখেন বরিস, 'দুনিয়ায় বদল আনতে এই অসাধারণ মানুষটি কীভাবে সত্য ও অহিংসার সহজ-সরল নীতিকে কাজে লাগিয়েছিলেন, আশ্রমে এসে তা উপলব্ধি করে সমৃদ্ধ হলাম!'

তবে এর আগেও বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতারা এসেছেন সবরমতীতে। 

সবরমতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা

২০২০ সালে গুজরাতের বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে নিজে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রীকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর সেখান থেকেই তাঁদের সবরমতী আশ্রমে নিয়ে যান তিনি। গোটা আশ্রমটি তাঁদের ঘুরিয়ে দেখান প্রধানমন্ত্রী। ওই আশ্রমে থাকা মহাত্মা গান্ধীর একটি ছবিতে সস্ত্রীক মালা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কীভাবে চরকায় সুতো কাটতে হয়, তাও মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখান মোদি। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভিজিটর্স বুকে লেখেন, "প্রিয় বন্ধু মোদিকে আমি এই অসাধারণ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই।"

গান্ধীজির স্মৃতি বুকে আগলে রাখা সবরমতী আশ্রমের ভিজিটর্স বুকে যখন নিজের মতামত জানান তৎকালীন মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট, তখন তাতে শুধুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা। বাপুর আশ্রমে গেলেন, অথচ গান্ধীজির সম্পর্কে একটি কথাও লিখলেন না মন্তব্য খাতায়- ট্রাম্পের এই আচরণ নিয়েই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক।

আরও পড়ুন: বারবার হত্যার পরিকল্পনা || কারা ছিল গান্ধী-নিধনের নেপথ্যে?


২০১০ সালে একবার ভারত সফরে এসেছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেই সময় তিনিও সবরমতী আশ্রমে যান। আশ্রম পরিদর্শনের পর 'ভিজিটর্স বুক'-এ একেবারে অন্য কথা লেখেন তিনি। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লেখেন: "গান্ধীজির জীবনের এই অধ্যায়টি দেখার সুযোগ হওয়ায় আমি অনুপ্রেরণায় পূর্ণ হয়েছি। তিনি যে শুধু ভারতের কাছে একজন নায়ক ছিলেন তা নয়, গোটা বিশ্বের কাছে তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, একজন নায়ক।"


অথচ ওবামার দেখানো পথের ধারেকাছেও হাঁটলেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। 


২০১৮ সালে নেতানিয়াহু

ভারত সফরে এসে সবরমতী আশ্রমে এসেছিলেন ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। পরিবারের সঙ্গে এখানে এসেছিলেন তিনি। ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেন বাপুর অহিংসা। যাওয়ার আগে ভিজিটার্স বুকে লেখেন, "মহাত্মা গান্ধী হলেন বিশ্বমানবতার পূজারী।" 


২০১৮ সালে জাস্টিন ট্রুডো


এক সপ্তাহের জন্য ভারতে এসেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সপরিবারে আসেন গান্ধীজির সবরমতী আশ্রমে। ভিজিটর্স বুকে তিনি লেখেন, "সত্য, মানবতা এবং শান্তির অসাধারণ জায়গা। আজকের দিকে এর প্রয়োজন অসীম।" চরকায় সুতো কাটতে দেখা যায় ট্রুডোকেও। 


২০১৭ সালে শিনজো আবে

২০১৭ সালে দু'দিনের সফরে ভারতে আসেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তিনি আসেন সবরমতী আশ্রমে। যাওয়ার আগে লেখেন তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, "ভালবাসা এবং ধন্যবাদ।" 


২০১৪ সালে শি জিনপিং

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে চিনের প্রিমিয়ার শি জিনপিং আহমেদাবাদে এসেছিলেন। আসেন সবরমতী আশ্রমে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মোদি। তিনি জিনপিংকে চিনা ভাষায় অনূদিত গীতা উপহার দেন। 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম' গানের ধ্বনি আপ্লুত করে এই রাষ্ট্রনায়ককেও। 


আজাদি কি অমৃত মহোৎসব

২০২১ সালে 'আজাদি কি অমৃত মহোৎসব' অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এখানে এসেছিলেন মোদি। তিনি লেখেন, এই আশ্রমে এসে বাপুর প্রেরণায় আমার দেশগঠনের অঙ্গীকার দৃঢ়তর হল। 


ইতিহাসের ছোঁয়া

গান্ধীজির সবরমতী আশ্রমকে সত্যগ্রহ আশ্রমও বলা হয়। তবে গান্ধীজি অন্যান্য কাজকর্ম ছাড়াও কৃষিকাজ ও পশুপালনের মতো বিভিন্ন কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যার জন্য অনেক জমির ব্যাপক প্রয়োজন হয়েছিল। ১৯১৭ সালের ১৭ জুন আশ্রমটি সবরমতী নদীর তীরে ছত্রিশ একর জায়গায় স্থানান্তরিত হয় এবং এটি সবরমতী আশ্রম নামে পরিচিতি লাভ করে। গান্ধীজি ১৯২৩ সালের ১২ মার্চে দণ্ডি মার্চকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা 'লবণ সত্যাগ্রহ' নামে পরিচিত। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের উপর এই মার্চটির যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল, তার স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকার আশ্রমটিকে একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।


কীসের টানে এখানে বারবার ছুটে আসেন বিদেশিরাও? 
আশ্রমে এখন একটি জাদুঘর রয়েছে, গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়। এটি মূলত আশ্রমের ভেতর গান্ধীজির নিজস্ব বাড়ি 'হৃদয়কুঞ্জ'-তে ছিল। তারপরে ১৯৬৩ সালে স্থপতি চার্লস কোরিয়া-র নকশা অনুযায়ী জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছিল। সংগ্রহালয়টি তখন সু-নকশাকৃত ও সজ্জিত জাদুঘর ভবনে পুনরায় স্থাপন করা হয়েছিল এবং ১০ মে, ১৯৬৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তা উদ্বোধন করেন। আশ্রমে অনেক ভবন রয়েছে এবং প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব নাম। গান্ধীই অধিকাংশ ভবনের নামকরণ করেছেন। আশ্রমের কয়েকটি বিল্ডিংয়ের নাম যেমন 'নন্দিনী', 'রুস্তম ব্লক' প্রভৃতি গান্ধীর দেওয়া। গান্ধীর লেখা চিঠি থেকে তা প্রমাণিত হয়। 

বাপুর জীবনচর্যা, অহিংসার আদর্শ অনুভব করতে বারবার এখানে এসেছেন বিদেশিরা। আজ বিশ্বের বহু দেশ যখন হিংসায় মত্ত, তখন বাপুর আদর্শ ছুঁয়ে দেখতে সবরমতী আশ্রম অহিংসারই পীঠস্থান।

More Articles