ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় ছাত্র প্রতি বছর ইউক্রেনে পড়তে যান কেন?

গত এক সপ্তাহে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সাক্ষী থাকছে বিশ্ব তার খানিকটা ভারতকে জড়িয়েও বটে। শত শত মাইল দূরে রাশি রাশি উদ্বাস্তুর উদ্বেগের অংশীদার বেশ কিছু ভারতীয় পরিবারও। তাদের বাড়ি থেকে কেউ না কেউ পড়তে গিয়েছিল ইউক্রেনে। আচমকা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছেন অনেকেই। তাদের অবস্থা শোচনীয়। আতঙ্কে উৎকণ্ঠায়, উদ্ধারকার্যের অপেক্ষা করতে করতে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে একজন ভারতীয় ছাত্র মারা যাওয়ারও খবর এসেছে। কিন্তু সরকার নিস্পৃহ। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন–এই নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে অতিভারতীয়রা আবার চোখ রাঙাচ্ছে, তেড়ে তেড়ে আসছে। 'ঠিক হয়েছে', 'যাওয়ার কী দরকার ছিল?', 'বেশ হয়েছে', 'সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই'--শুনতে হচ্ছে এসবও। অথচ কেন ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র দেশ ছেড়ে পড়তে যায় ইউক্রেনে? কীসের তাগিদে? কোন পরিস্থিতিতে? এ সব খতিয়ে দেখতে রাজি নয় কেউ। এরাই আবার প্রবাসী ভারতীয়দের প্রবল মোদি-সমর্থনে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে থাকে। এ এমন দেশপ্রেম যা মোদীর বিড়ে ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। সহনাগরিক ছাত্রের অপঘাতে মৃত্যু যখন মানুষকে ভাবায় না, সংবেদনশীল করে না, তখন বুঝতে হয় সেই নাগরিকতার বোধ আদতে সুবিধেবাদী। আজ উল্টোপথে হেঁটে ভারতীয় ছাত্রদের দেশ ছেড়ে ইউক্রেনে গিয়ে পড়াশোনা করার কারণ খোঁজা যাক।

ইউক্রেনের শিক্ষামন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে বর্তমানে ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা ১৮ হাজার ৯৫ জন। জলন্ধরের ডাক্তার অশ্বিনী শর্মার দুই সন্তান গতবছর নভেম্বরে ইউক্রেনে গিয়েছে এম বি বি এস পড়তে। তাঁর বয়ানে পাঞ্জাব ইত্যাদি নানা রাজ্য থেকে হাজার হাজার ভারতীয় ছেলেমেয়ে ইউক্রেনে এম বি বি এস পড়তে যায়। তাঁর দুই সন্তানই বর্তমানে ইউক্রেনে আটকে আছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ফেরার কথা ছিল তাদের ঘরে। কিন্তু আকাশপথ বন্ধ থাকায় ফিরতে পারেনি তারা। এই পিতার উৎকণ্ঠার দাম নেই?

জলন্ধরের এক শিক্ষাবিদ জানিয়েছেন, পাঞ্জাবের একটা বড় অঙ্কের ছাত্রছাত্রী এমবিবিএস পড়ার জন্য ইউক্রেন যেতেই সুবিধা বোধ করছে, কারণ ভারতের মতো অবাস্তব প্রতিযোগিতার গাদাগাদি নেই সেখানে। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েরাই ইউক্রেনে পড়াশোনা করেছে। অথচ ভারতেও তারা সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ভারতের এই প্রতিযোগিতার বাজার তাদের দেশে থেকে পড়ার প্রতি নিস্পৃহ করেছে। পাঞ্জাবের নওনশাহরের এক ছাত্রী এই মুহূর্তে আটকে পড়েছেন ইউক্রেনে। তিনি জানান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং দিল্লি থেকে শয়ে শয়ে ছাত্র ইউক্রেনের বিভিন্ন কলেজে ডাক্তারি পড়তে আসে।

ইউক্রেনের মেডিক্যাল ডিগ্রি ভারতীয় চিকিৎসা পরিষদ, বিশ্ব চিকিৎসা পরিষদ থেকে ইউরোপ, ব্রিটেন সমস্ত দেশে মান্যতা পায়। এবং এতে খরচ অনেক কম। ভারতের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির খরচ বছরে লাখ দুয়েকের কাছাকাছি। কিন্তু সেখানে আসন এতটাই কম যে বেশিরভাগ ছাত্রের পক্ষেই সরকারি কলেজে ডাক্তারি পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেসরকারি কলেজে বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়। সাড়ে চার বছরের কোর্সে তাতে করে শুধু কোর্স ফি-ই দাঁড়ায় লাখ পঞ্চাশেক টাকা। এই তথ্য একজন ডাক্তারেরই বয়ানে উঠে এসেছে। কিয়েভে আটকে পড়া জলন্ধরের এক ছাত্র জানালেন ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়ার বার্ষিক খরচ ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। যা পাঞ্জাবের বেসরকারি কলেজগুলির থেকে অন্তত তিন গুণ কম। প্রসঙ্গত পাঞ্জাবে সরকারি কলেজ রয়েছে মাত্র চারটি। ছত্রিশগড়ে নয়টি। তার মধ্যে সাতটি মাত্র অ্যাডমিশন চালু রেখেছে। এই সরকারি কলেজগুলির সিটসংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। বাবা ফরিদ ইউনিভার্সিটির একজন ডাক্তার জানান, বাকি হাফ ডজন বেসরকারি কলেজের ফিজ সরকারি কলেজের পাঁচ-ছয় গুণ। যা নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলত চিকিৎসাবিদ্যার বেসরকারি ক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন বর্গের একচেটিয়া।

কিন্তু সেইসব দাবি উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন বাবা ফরিদ ইউনিভার্সিটির অধ্যক্ষ রাজ বাহাদুর। তাঁর মতে যে সব ছাত্রেরা এখানে সুযোগ পায় না, অমনোযোগী মিডিওকার–তারাই ইউক্রেনে পড়তে যায় ডাক্তারি। এখানে নিট (NEET)-এ হাই পার্সেন্টেজ নিয়ে পাশ করলে তবেই যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া যায়। ইউক্রেনে সে সব বালাই নেই। যেমন তেমন করে পাশ করলেই লোকে ডাক্তার হয়ে যায়। এ বিষয়ে সরকার ও সরকারপ্রেমীদের মতও তার আশেপাশেই।

গতকাল মৃত নবীনের বাবা জানিয়েছেন, নবীন ইউক্রেনে পড়তে গিয়েছিল কারণ ৯৭% নম্বর পেয়েও ও দেশের সরকারি কলেজে সিট পায়নি। এই দায় কার? আর কত যোগ্যতা দরকার? প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সব আকাশকুসুম যোগ্যতার ধারণা আদতে কেন নির্মিত হচ্ছে? উপরে ডাঃ শর্মার বয়ান থেকে এও পরিষ্কার সিট পেলেও ছাত্রেরা ইউক্রেনে পড়তে যেতেই পছন্দ করছে। অতএব এই সরকারি দাবিগুলি ভিত্তিহীন। উল্লেখ্য এবারও বাজেটে শিক্ষাখাতে ৬০০০ কোটি টাকা কম বরাদ্দ করেছে সরকার। দিনের পর দিন এই কেন্দ্রীয় বাজেটের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমেই চলেছে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমেছে ৩৩,০৮৯ কোটি টাকা।  কেন ভারতে পড়শোনার সরকারি পরিকাঠামো উন্নত হবে না–সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে ইউক্রেনকে সামনে রেখেই।

প্রত্যেক বছর লাখে লাখে ছাত্র নিট-এ বসে,সে তুলনায় চিকিৎসাবিদ্যার সরকারি আসন কতটুকু? বেসরকারি কলেজে খরচ কেন এত বেশি? কীভাবে ইউক্রেন এর থেকে উন্নত মানের শিক্ষার পরিষেবা এত সস্তায় দিতে পারছে? ভারতের সরকারি হাসপাতালগুলির যেখানে এই অবস্থা, মহামারীর সঙ্গে লড়তে যেখানে নাভিশ্বাস ওঠে পর্যাপ্ত ডাক্তারের অভাবে, সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার এই অবস্থা কেন? এ কি ইচ্ছাকৃত? শিক্ষাখাতে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট আরো ছাঁটার সুবিধা? কেন গ্লোবাল এক্সপোজার খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে ডাক্তারি ছাত্রেরা? কেন ইউক্রেনে আটকে পড়া ছাত্রদের উদ্ধার করার তেমন কোনও পদক্ষেপই নিচ্ছে না সরকার? প্রশ্ন উঠুক। প্রশ্ন ওঠা প্রয়োজন। তবে আঙুলটা যেন ক্ষমতার দিকে ওঠে। যাদের দায়িত্ব ছিল, যারা এড়িয়ে গেল তাদের দিকে ওঠে। মৃত সহনাগরিক এক ছাত্রকে গলা ফুলিয়ে গালি দেওয়াটা আর যাই হোক সুস্থতার লক্ষণ নয়।

More Articles