স্যাকরার ঠুকঠাক, মমতার এক ঘা || ছোট পদ থেকে সরিয়ে 'বড়' বার্তা পার্থকে?
দল এবং মন্ত্রিসভায় স্বচ্ছতাকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা স্পষ্ট হলো তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি-র মাথা থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ছেঁটে ফেলার পরই৷ তৃণমূল সুপ্রিমো বার্তা দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন না করে স্রেফ দলের পদ আঁকড়ে বসে থাকবেন, এমন আর চলবে না৷ যে যত বড় নেতা-ই হোন, দলের তরফে দেওয়া নির্দিষ্ট কাজ করতে হবে, না হলে সরে যেতে হবে৷ দলের রাজ্য সভাপতি তথা জাতীয় কমিটির সহ সভাপতি সুব্রত বকসিকে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যানের পদে এনে পার্থকে স্রেফ কমিটির একজন সদস্য রাখা হয়েছে৷ এই কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং অরূপ বিশ্বাস।
আচমকাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অন্যতম শীর্ষনেতাকে এভাবে দলের এক গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় তৃণমূলের অন্দরের পাশাপাশি জোর জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলেও৷ চর্চা চলছে, পার্থকে এভাবে সরানোর প্রকৃত কারণ কী? একাধিক তত্ত্ব সামনে আসছে৷ এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এসএসসি-দুর্নীতিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম জড়িয়ে যাওয়া৷ কলকাতা হাইকোর্ট এই দুর্নীতির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে৷ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যেদিন নির্দেশ দিয়েছেন, প্রয়োজনে সিবিআই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, ঠিক সেদিনই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তলব করেন পার্থকে৷ ফৌজি তৎপরতায় সেদিন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আইনজীবীরা সিবিআই দফতরে তাঁর হাজিরার নির্দেশে স্থগিতাদেশ আদায় করেন৷ পরে ডিভিশন বেঞ্চ থেকেও একমাসের রক্ষাকবচ পান তৎকালীন এই শিক্ষামন্ত্রী৷
চর্চায় উঠে এসেছে, রক্ষাকবচের মেয়াদ শেষ হলে ফের সিবিআই ডাকতে পারে পার্থবাবুকে, তবে তা নির্ভর করবে ডিভিশন বেঞ্চ রক্ষাকবচের মেয়াদ বৃদ্ধি করবে কি'না অথবা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ করে কি'না, তার ওপর৷ তাছাড়া, আইকোর-অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে আনা মামলাতেও জড়িয়েছে তাঁর নাম। মোদ্দা কথা, রাজ্যের প্রাক্তণ শিক্ষামন্ত্রী তথা বর্তমান শিল্পমন্ত্রীর ঘাড়ে সিবিআইয়ের 'থ্রেট' থাকছেই, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে চরম অস্বস্তিকর৷
অতীতে দলের একাধিক জনের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সিবিআই স্ক্যানারে কারো নাম ভেসে উঠলে, দল তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায়৷ শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান নিজেই এক বা একাধিক বিশৃঙ্খল কার্যকলাপে ফেঁসে থাকলে, সেই কমিটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়৷ এসবই পার্থ- অপসারনের কারন হতে পারে বলে অনেকের ধারনা৷ অন্যদিকে দলের একাধিক নেতার অভিমত, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইদানিং সংগঠনের ক্ষমতাশালী অংশের বিরাগভাজন হয়েছেন নানা কারনে৷ তাঁকে যাবতীয় পদ থেকেই সরানোর প্রচ্ছন্ন একটা দাবিও উঠেছে৷ পাশাপাশি 'কথা' শুরু হয়েছে আরও একটি বিষয় নিয়েও৷ বেশ কিছুদিন ধরেই দলের একাধিক নেতা বা পদাধিকারী সংবাদমাধ্যমের কাছে খোলাখুলিভাবে সতীর্থদের বিরুদ্ধেই সরব হলেও, স্রেফ 'একটু বকে দেওয়া' ছাড়া পার্থ'র নেতৃত্বাধীন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি কিছুই করেনি।
এর ফলে, "এভাবে মুখ খুললেও কেউ কিছু করতে পারবে না", এমন একটা ধারনা দলের অন্দরে তৈরি হয়েছে৷ তরজা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে৷ অথচ শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি এই ইস্যুতে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করলে, এই প্রবনতা থামানো যেত বলেই নেতৃত্বের ধারনা৷ এ ধরনের ব্যর্থতার জন্যও পার্থকে সরানো হয়ে থাকতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-মমতা কি দলেই কোণঠাসা? অভিষেক নিয়ে কুণালের বার্তায় কোন ইঙ্গিত?
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি দলনেত্রীর অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রতি শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন পার্থ। এমন কাণ্ড নিয়ে সম্ভবত উষ্মাও প্রকাশ করেন নেত্রী। শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে বদল ঘটিয়ে তৃণমূল-সুপ্রিমো না'কি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কথা না বলে শৃঙ্খলা কমিটি ভবিষ্যতে কোনও বৈঠক ডাকতে পারবে না৷
সব মিলিয়ে, গোটা পরিস্থিতিই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল৷ পার্থ'র আমলে ঘটে যাওয়া এসএসসি-দুর্নীতির জেরে প্রশাসনের অহেতুক বিপাকে পড়া, দুর্নীতির তদন্তে জেরা করার জন্য পার্থকে সিবিআই তলব, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে পার্থর নাম জড়ানো, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনে পার্থ'র ব্যর্থতা, দলের একাংশের পার্থ-অপসারনের জোরালো দাবি ইত্যাদি বিষয়গুলি যথেষ্ট বিব্রত করছে দলকে৷ এই সব কারনেই তাঁকে তুলনায় ছোট একটি পদ থেকে সরিয়ে 'বড়' একটি বার্তা দেওয়া হলো বলেই দলের একাংশ মনে করছে৷ এই পদ থেকে সরানো হলেও এখনও দলের রাজ্য কমিটির মহাসচিব এবং সরকারের শিল্পমন্ত্রীর পদে থাকছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ তবে কতদিন থাকবেন, তা নির্ভর করছে তাঁর কর্মতৎপরতা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বহরের উপরই৷