মমতা কি দলেই কোণঠাসা? অভিষেক নিয়ে কুণালের বার্তায় কোন ইঙ্গিত?


আপাতত অনেকটাই নিশ্চিন্ত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷

নিদান দিয়েছেন বাংলার একমাত্র 'রাজনৈতিক শ্রীভৃগু' কুণাল ঘোষ, ঘটনাচক্রে তিনি রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদকও বটে৷

এই শ্রীভৃগু সাহেব লিখিতভাবে জানিয়েছেন, "তৃণমূল কংগ্রেসের এক সৈনিক হিসেবে বলতে পারি, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন মমতাদি। আর সেই ২০৩৬ সালে তিনি অভিভাবকের মত উপস্থিত থাকবেন এমন অনুষ্ঠানে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নেবেন অভিষেক।" পাঠকের বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না যে, এখানে অভিষেক বলতে বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বোঝানো হয়েছে৷ স্বীকার করা হয়েছে, অভিষেকই তৃণমূলের Crown Prince.

এই নিদানে কিছুটা মনমরা হয়তো হতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তবে ওঁকে একেবারে নিরাশ করেননি রাজনৈতিক-শ্রীভৃগু৷ বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রিত্বে জ্যোতি বসুর রেকর্ড ভেঙে ভারতে নজির গড়বেন মমতাদি। তবে তার মধ্যে যদি দিল্লির এবং দেশের দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরেকরকম তো হবেই।"

আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়ার আসল কারণ কী? জল্পনা দানা বাঁধছে শুভেন্দুর নীরবতায়

শ্রীভৃগুর গণনা সমাপ্ত৷ ২০৩৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ এবং সরকার গঠন পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন তিনি। তারপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'অভিভাবকের মত উপস্থিত থাকবেন এমন অনুষ্ঠানে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নেবেন অভিষেক।'

তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে ছোট, বড়, মাঝারি- নানা মাপের নেতা নানারকম কথা বলেছেন৷ সেসব কথায় হয়তো বিতর্কও হয়েছে৷ কিন্তু এতদিন দলের কেউই প্রকাশ্যে দলের গোপন অ্যাজেন্ডার জামাকাপড় এভাবে খুলে দেননি৷ তৃণমূল যে সর্বতোভাবেই 'পরিবারতন্ত্র'-তে বিশ্বাসী, সেকথা কেউই এত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেননি৷ এতদিন কেউই বলেননি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসে দ্বিতীয় কোনও যোগ্য নেতা বা নেত্রীই নেই, যিনি ভবিষ্যতে দল বা সরকারের হাল ধরতে পারেন৷ রাজনৈতিক মহলে একটা ইঙ্গিত হয়তো এমন ছিল, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর অভিষেকই যে কান্ডারি, দলের তরফে এমন ঘোষণা এবারই প্রথম৷

কুণালের এই বক্তব্যকে সহজেই দু'ভাবে দেখা যায়৷ হয়, দলের শীর্ষ স্তরের নির্দেশেই তিনি এই বয়ান পোস্ট করেছেন, অথবা দলকে এড়িয়ে, না জানিয়ে, স্তাবকতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ওই মুখপাত্র নিজেই এই কাজ করেছেন৷

যদি দলের অনুমোদন নিয়েই এই পোস্ট করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, তেল দেওয়াও একটা শিল্প, এটা শিখতে হয়৷ এমন পোস্টের দরকার ছিল না৷ দল আচমকাই বেআব্রু হয়ে গেল৷ জনমানসে এই ধারনা বদ্ধমূল হলো, অন্য যেসব দল মূলত 'পরিবারকেন্দ্রিক', তাদের সমালোচনা করার অধিকার তৃণমূল হারিয়ে ফেলল৷


১১ বছর ধরে শাসনক্ষমতায় থাকা একটি রাজনৈতিক দলের এটি চরমতম ব্যর্থতা যে, দলে অভিষেক ছাড়া উপযুক্ত দ্বিতীয় নেতা তৈরিই হয়নি৷ দলের তরফে প্রকাশ্যে বলা হোক বা না-হোক, প্রায় সকলেই জানে, তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক পরের স্থানেই রয়েছেন অভিষেক৷ দলের প্রায় প্রত্যেকেই তা মেনেও নিয়েছে৷ দীর্ঘদিন ধরেই একটা ইঙ্গিত ছিল, আগামী কোনও এক সময়ে দল ক্ষমতায় থাকলে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই হবেন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী৷ দলের এমন সিদ্ধান্ত হতেই পারে, তাতে দলের বাইরের কারও কিছুই বলার থাকতে পারে না৷ কিন্তু তাই বলে ফেসবুকে পোস্ট করে একথা জানাতে হবে? এতে মমতা অথবা অভিষেক, কার সম্মান বৃদ্ধি পেল? তৃণমূলের মুখপাত্রের মুখ থেকে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা শোনার পর দলের অন্দরে বা বাইরে প্রায় সকলেরই ধারণা হয়েছে, অভিষেক-কে এইভাবে Crown Prince করার সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই দলের৷ একটি রাজনৈতিক দল আগামিদিনে কাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রোজেক্ট করবে, তা কখনওই কোনও এক মুখপাত্রের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, লেখা বা বলার ওপর নির্ভর করে না৷ দলের কথা অফিসিয়ালি জনসমক্ষে তুলে ধরাই মুখপাত্রের কাজ৷ কুণালের এই ফেসবুক পোস্ট ঘিরে যত বিতর্কই হোক, জনাকয়েক ওজনদার নেতা যতই বলুন এসব কথা দলের নয়, রাজনৈতিক মহলের অভিমত, সাধারণ এক দলীয় মুখপাত্রের ঘাড়ে ক'টা মাথা আছে যে তৃণমূলের বৃত্তে বসবাস করে এত বড় ইঙ্গিত নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে উপস্থাপন করবে? তৃণমূলে এই কাজ এককথায় অসম্ভব৷ এতদিন কংগ্রেস-সহ নানা দলের দিকেই তৃণমূল 'পরিবারতন্ত্র'-র তোপ দেগেছে৷ কংগ্রেসকে বিঁধতে এই শব্দটির থেকে আর ভালো কোনও শব্দই নেই৷ কিন্তু সেসব কথা বিরোধী দল সাধারণত কংগ্রেসের উদ্দেশ‍্যে বলে৷ সম্ভবত, এই প্রথমবার কোনও রাজনৈতিক দল নিজেই প্রকাশ্যেই ঘোষণা করল যে, তারা শুধুমাত্র পরিবারতন্ত্রেই বিশ্বাস করে৷ দল চালিত হয় সেই বিশ্বাসেই৷ যদি দলীয় অনুমোদনেই কুণাল একথা বলে থাকেন, তা হলে প্রশ্ন তো উঠবেই, এই বিতর্কিত পোস্টে দল যে হতমান হলো, শীর্ষ মহল কি তা বুঝতে পারছে ?

আর যদি দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে? যদি দলের এক মুখপাত্র দলের অজান্তে, স্রেফ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করার জন্য এই কাজ করে থাকেন? দল কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবে? এই ধরনের কাজে তো মর্যাদাহানি হলো অভিষেকেরই৷ যে অভিষেক দাপটের সঙ্গে রাজনৈতিক ময়দানে নানা ফ্রন্টে লড়াই করছেন, তাঁর ইমেজ কি এই ধরনের বক্তব্যে আরও উজ্জ্বল হলো? তা হতে পারে? যদি দল সত্যিই তাঁকে যোগ্য এবং দক্ষ বলে মেনে নিয়ে থাকে, তাহলে ২০৩৬ পর্যন্ত কেন তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে? কেন তার আগেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন না? এ ধরনের জ্যোতিষ-চর্চা'র অর্থ কী? অনেকেই ভুলে যাননি, গত বছরের ৭ জুন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, আগামী ২০ বছর তিনি কোনও প্রশাসনিক পদ গ্রহণ করবেন না৷ এটা যদি কথার কথা না হয়ে থাকে, তা হলে ২০৪১ পর্যন্ত ওঁর আদৌ ইচ্ছে নেই প্রশাসনিক কোনও পদে আসার৷ তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে ২০৩৬ এল কোথা থেকে? অভিষেক চাইলে আজই উনি মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে পারেন৷ তৃণমূলের একজনও আপত্তি করবেন না৷ বরং খুশি হবে৷ কিন্তু এখনও তিনি তেমন চাননি৷ অভিষেক অসম্ভব ক্যালকুলেটিভ৷ রাজনীতিতে এটা একটা বড় গুণ৷ দলের অন্যতম এক মুখপাত্র ঘোষণা করবেন, তিনি কবে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তারপর তিনি ওই পদে বসবেন, এমন কখনও হতে পারে? কুণাল ঘোষের এই পোস্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও উঁচুতে তুলল, না'কি টেনে নিচে নামাল? কে বা কারা এটা বিচার করবেন? যদি সত্যিই স্রেফ নিজের ইচ্ছায় কুণাল এসব কথা লিখে থাকেন, তা হলে কেন তিনি এই পোস্ট করলেন, দল কি তার কারণ জানতে চাইবে?

অনেকেই বলছেন, তৃতীয়বারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০২১-এর ২ মে৷ সেই ঘটনার বর্ষপূর্তির দিনই ফেসবুক পোস্টে 'ফাটিয়ে' দিয়েছেন কুণাল। কী ফাটিয়েছেন বোঝা দুষ্কর! যুগ যুগ ধরেই রাজনীতিতে স্তাবকতার একটা বড়সড় ভূমিকা আছে৷ ঠিকঠাক জায়গায় তৈলমর্দনে ব্যর্থতার কারণে অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অকালেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে৷ এমন নজির গোটা দেশেই রয়েছে৷ দলে টিকে থাকতে হলে অভিষেককে তেল মাখানোই যে এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি, তা ঢের আগেই কুণাল বুঝেছেন৷ বুঝেছেন, অভিষেক সদয় না হলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ টানা লোডশেডিংয়ে থাকবে৷ আর তা বুঝেই তিনি আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় সাধারণ সম্পাদককে তোয়াজ করতে৷ তবে এক্ষেত্রে বোধহয় মিসফায়ার হয়ে গিয়েছে৷

তবে একথাও ঠিক, তৃণমূলের এই মুখপাত্রটির কথাবার্তা কেউই বিশেষ আমল দেয় না৷ দলের মধ্যেও দেয় না, দলের বাইরে তো নয়ই৷ সাধারণ মানুষ কুণালকে আজও ঠিক কোন নজরে দেখেন, তা ধরার সব থেকে সহজ পথ, কুণাল ঘোষের যে কোনও ফেসবুক পোস্টের কমেন্ট সেকশন দেখা৷ ওটা দেখলেই মালুম হবে, জনমানসে কুণালের ভাবমূর্তি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে৷


তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের নাম শুনলে একাধিক ভিডিও ক্লিপের কথাও মনে পড়ে যায়৷ সারদা চিটফান্ড কাণ্ডে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকার সময় ইস্টম্যানকালার সব মন্তব্য করেছিলেন প্রাক্তন এই তৃণমূল সাংসদ। বাংলার মানুষের ওঁর বহুচর্চিত সেই 'বিখ্যাত' কথাটাও মনে পড়ে৷ এই ভিডিও ক্লিপ প্রায় প্রত্যেকেই দেখেছেন৷ ওই ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, কুণাল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "সারদা মিডিয়া সূত্রে যদি কেউ সবচেয়ে লাভবান হয়ে থাকেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।" ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুণাল এই কথা বলেছিলেন। যতদিন রাজনীতিতে থাকবেন, ততদিনই কুণালকে এই কথা শুনে যেতে হবে, ঠিক যেমন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর মুকুল রায়কে শুনে যেতে হয়েছে সতীর্থ সিদ্ধার্থনাথ সিংয়ের বলা সেই ভাইরাল উক্তি, 'ভাগ মুকুল ভাগ'৷ দিনকয়েক আগে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই জানিয়েছে, এই কুণাল সংবাদমাধ্যমের সামনে অবলীলায় তোপ দেগেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধেও৷ মুখ্যমন্ত্রী-সহ দলের একাধিক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে কুণালের এহেন কথাবার্তা তৃণমূলকে অস্বস্তিতে রেখেছে বলাই বাহুল্য।

সারদা কাণ্ডে সাড়ে তিন বছর জেলে থাকার পর কুণাল তৃণমূলে কার্যত নির্বাসনেই ছিলেন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলেও দলের বেশিরভাগ লোকজনই কুণালকে এড়িয়ে চলতেন৷ শোনা যায়, তৃণমূলে কুণালের সেকেন্ড ইনিংস শুরু হয় অভিষেকের হাত ধরে। শাসক দলের বড় অংশের ধারণা কুণালকে রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র করার নেপথ্যে রয়েছেন অভিষেকই। দলের একাংশ বলছে, তারই প্রতিদান দিতে গিয়ে শিব গড়তে পুরোদস্তুর হনুমান বানিয়ে ফেলেছেন কুণাল৷

আর একটা কথা৷

কুণাল ঘোষের পর মঙ্গলবার একটি ট্যুইট করেন আরামবাগের তৃণমূল সাংসদ অপরূপা পোদ্দার৷ বিষয় একই৷ ফারাক একটাই, এক ট্যুইটে লেখা হয়েছে অভিষেক মুখ্যমন্ত্রী হবেন ২০৩৬-এ, অন্য ট্যুইটে লেখা, মুখ্যমন্ত্রী হবেন ২০২৪-সালেই৷ অপরূপার ট্যুইটে 'লেখা ছিল', "আমি চাই, আমাদের দিদি ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন আরএসএস মনোনীত রাষ্ট্রপতির থেকে। আর এই বিজেপির গোবর্ধন জগদীশ ধনকরের থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০২৪ সালে শপথ নেবেন আমাদের প্রিয় যুব নেতা অভিষেক বন্দোপাধ্যায়।" এই ট‍্যুইট ঘিরে দলের অন্দরে শোরগোল শুরু হয়৷ 'লেখা ছিল' এই কারণেই বলা হলো, ট্যুইট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ডিলিট করে দেন অপরূপা। কুণালের পর অপরূপা, একই ধরনের পর পর ট‍্যুইটের কারণ নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে তৃণমূলের কিচেন-ক্যাবিনেটে৷

 

More Articles