মিমকে টেক্কা দিয়ে বিহারী মুসলিমদের মনদখল করতে চাইছেন পিকে?
Political strategist Prashant Kishor: পিকের দাবি, মুসলিম ভোটারা প্রতি বার একপাক্ষিকভাবে আরজেডিকে ভোট দেন, কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছু পান না। উন্নয়ন, শিক্ষা বা চাকরির সুযোগ— কোনো ক্ষেত্রেই মুসলিম সমাজের বিশেষ উন্নতি হয়নি।
বিহারের রাজনীতিতে নতুন বার্তা দিচ্ছেন ভোটকুশলী তথা জন সুরজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত কিশোর। তিনি বলছেন, বিজেপিকে হারাতে হলে শুধু মুসলিম ভোটে হবে না। মুসলিমদের উচিত এমন হিন্দুদের সঙ্গে একজোট হওয়া, যারা মহাত্মা গান্ধী, ড. বি.আর. আম্বেদকারের চিন্তাধারায় বিশ্বাস করেন। প্রাশান্ত কিশোরের আহ্বান, মুসলিম ভোটাররা যেন বিজেপির ভয় না পেয়ে নিজেরা উন্নয়ন ও বাস্তব সমস্যার কথা ভেবে ভোট দিন। তাঁর কথায়, বহু রাজনৈতিক দল মুসলিম ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ভোট চায়। “ভোট না দিলে বিজেপি জিতে যাবে”— এই ভয় দেখানো রাজনীতি থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাঁর এই বক্তব্যে আরজেডি ও কংগ্রেসও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে, কারণ তাঁর সমালোচনার তীর সেই দলগুলোর দিকেও। তবে প্রশ্ন উঠছে, কেন এ কথা বলছেন পিকে?
পিকে-র যুক্তি, দেশের ৮০% মানুষ হিন্দু, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৪০% বিজেপিকে ভোট দেয়। বাকি হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে নেই, এই অংশের হিন্দুদের সঙ্গেই মুসলিমদের একজোট হওয়া দরকার। যদি ২০% মুসলিম আর ৪০% বিজেপিবিরোধী হিন্দু একসঙ্গে হয়ে যায়, তাহলেই শক্তিশালী বিকল্প তৈরি হবে। তাঁর কথায়, “এখন আর কোনো নেতাকে বা দলকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
বিহারের সীমাঞ্চল অঞ্চলের মুসলিম ভোটারদের উদ্দেশে প্রাশান্ত কিশোরের সরাসরি বার্তা— “এইবার জাত বা ধর্ম দেখে নয়, তোমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভোট দাও।” বিগত সরকারগুলো মুসলিমদের উন্নয়নে তেমন কাজ করেনি, বলে বারবার দাবি করে গিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। বিজেপিকে হারাতে হলে আদর্শ ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে জোট গড়তে হবে, শুধু ধর্ম নয়— বলেও মত তাঁর। তিনি নিজে দাবিও করেছেন যে তিনি মুসলিমদের সমর্থন পাচ্ছেন। তবে প্রশ্ন উঠছে, ভোটকুশলী কি মুসলিমদের মসিহা হয়ে উঠতে চাইছেন?
আরও পড়ুন
ভোটার তালিকায় দু’বার নাম থেকে দলের অর্থের উৎস! বিতর্কের চুম্বক প্রশান্ত কিশোর
সাধারণত মুসলিম ভোট বিজেপিবিরোধী হিসেবে ধরা হয়। আর বিহারে মোট ভোটারের প্রায় ১৭-১৮ শতাংশ মুসলিম। রাজ্যটির রাজনীতিতে এই ভোটব্যাঙ্ক সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম ভোটের বড় অংশ ছিল আরজেডি-র দখলে। আবার বিহারের বড় অংশের ভোটার হলেন যাদব ও অন্যান্য ওবিসি সম্প্রদায়। ওই রাজ্যের রাজনীতিতে 'মুসলিম-যাদব' ভোটব্যাঙ্ক বা M-Y ফ্যাক্টর বহুদিন ধরে চলে আসছে। লালু প্রসাদ যাদবের সময় থেকেই যাদব ও মুসলিম ভোট একজোট থাকায় আরজেডি শক্তিশালী হয়েছে। প্রশান্ত কিশোর মনে করেন, যদি এই ভোটভিত্তি বদলানো না যায়, তাহলে নতুন কোনো রাজনৈতিক বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। এবার কি সেই সমীকরণই ভাঙতে চাইছেন প্রশান্ত কিশোর?
বিহারের সীমাঞ্চল অঞ্চলের কিসানগঞ্জ, পূর্ণিয়া, আরারিয়া ও কাটিহারে মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে ওয়েইসির দল এআইএমআইএম সীমাঞ্চলের পাঁচটি আসনে জিতে ছিল। তবে পরে তাদের চারজন বিধায়ক আরজেডি-তে যোগ দেন। এতে এআইএমআইএম-এর প্রভাব কিছুটা কমে গেলেও মুসলিম ভোট বিভাজনের ফলে আরজেডি ও কংগ্রেসের অনেকটাই ক্ষতি হয়। ফলে বিজেপি ও জেডিইউ তুলনামূলকভাবে সুবিধা পায়। এবারও মুসলিম ভোট রাজনীতির বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। এখানে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৪৫-৫০%, যা বিহারের অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। পাশাপাশি দলিত, ওবিসি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারও উল্লেখযোগ্য। এই কারণেই সীমাঞ্চল বিহারের রাজনীতিতে একটি 'সুইং জোন' অর্থাৎ, যে দল এখান থেকে বেশি আসন পায়, তাদের পক্ষে সরকার গঠন সহজ হয়।
এবার সীমাঞ্চলে প্রচারে জোর দিয়েছে প্রশান্ত কিশোরের দল জনসুরজ পার্টি। অন্যদিকে, আরজেডি মুসলিম-যাদব ভোটব্যাংক ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আবার বিজেপি ও জেডিইউ 'অবৈধ অভিবাসী' ইস্যু তুলে হিন্দু ভোট এক করতে চাইছে। তবে এআইএমআইএম কয়েকটি আসনে প্রার্থী দিলেও, আগের মতো প্রভাব রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার সীমাঞ্চলের মুসলিম ভোট তিন ভাগে ভাগ হতে পারে— আরজেডি, এআইএমআইএম ও জনসুরজ পার্টি-এর মধ্যে। প্রশান্ত কিশোরের বার্তা যদি মানুষের মনে জায়গা করে নেয়, তাহলে তাঁর দল অনেকটাই সুফল পাবে। এআইএমআইএম যদি কম আসনে লড়াই করে, তাহলে মুসলিম ভোট বিভাজন কিছুটা কমতে পারে। তবে বিশ্লেষক মহলের একাংশই বলছেন, আরজেডি এখনও এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল, কিন্তু জনসুরাজ-এর উত্থান তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
আরও পড়ুন
বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর! নির্বাচনের সমস্ত সমীকরণ তছনছ করে দেবেন?
পিকের দাবি, মুসলিম ভোটারা প্রতি বার একপাক্ষিকভাবে আরজেডিকে ভোট দেন, কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছু পান না। উন্নয়ন, শিক্ষা বা চাকরির সুযোগ— কোনো ক্ষেত্রেই মুসলিম সমাজের বিশেষ উন্নতি হয়নি। তাই এবার মুসলিম ভোটারদের 'নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবে' ভোট দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
প্রশান্ত কিশোর আগেই জানিয়েছিলেন, তাঁর দল এমন একটি রাজনৈতিক বিকল্প গড়তে চায় যেখানে মুসলিম ভোটাররা শুধু 'বিজেপিকে ঠেকানোর' যুক্তিতে নয়, বরং উন্নয়ন ও প্রতিনিধিত্বের জন্য ভোট দেবেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর দলে মুসলিম সমাজ থেকে অন্তত ৪০ জন প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন। যদিও প্রকাশিত তালিকায় সেই সংখ্যা ২১। জন সুরজ পার্টির প্রার্থী তালিকা দেখে বোঝা যায়, দলটি বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণির প্রার্থীকে সুযোগ দিতে চেয়েছে। দলের সদস্যদের মতে, জনসুরজ পার্টি জাত-ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং কাজ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চায়।
সীমাঞ্চলের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তাঁর এই বার্তা কতটা প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে। তবে এতটুকু নিশ্চিত, তাঁর প্রচারে বিহারের ঐতিহ্যগত ভোট-সমীকরণে এক নতুন আলোচনার সূচনা হয়েছে।

Whatsapp
