ভোটার তালিকায় দু'বার নাম থেকে দলের অর্থের উৎস! বিতর্কের চুম্বক প্রশান্ত কিশোর
Prashant Kishor Controversies: তাঁর দাবি, আয় থেকে প্রশান্ত কিশোর ৯৯ কোটি টাকার বেশি দান করেছেন নিজের দল ‘জন সুরজ’কে।
ভারতের ভোটকৌশলী হিসেবে প্রশান্ত কিশোরের নাম আজ দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে পরিচিত। নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্মোহন রেড্ডি, কেজরিওয়াল থেকে অমরিন্দর সিং— প্রায় সব বড়ো নেতার জয়ের নেপথ্যে ছিলেন পিকে। এবার তিনি নিজেই রাজনীতির ময়দানে। তবে সাফল্যের এই আলোয় যেমন তিনি পরিচিত, তেমনি বিতর্কও তাঁর নিত্যসঙ্গী। কখনও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, কখনও নীতীশ কুমারের সঙ্গে তীব্র মতভেদ, আবার কখনও নিজের দলের অর্থায়ন বা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে জল্পনা— নানান সময়ে প্রশান্ত কিশোরকে চুম্বক করে দানা বেঁধেছে একের পর এক বির্তক।
দু’জায়গার ভোটার তালিকায় নাম
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের নোটিসকে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন প্রশান্ত কিশোর। কমিশন জানিয়েছে, তাঁর নাম নাকি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার— দু’জায়গার ভোটার তালিকায় রয়েছে। ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী এটি বেআইনি। তবে পিকের দাবি, তিনি ২০১৯ সাল থেকে বিহারের কোনার গ্রামের নথিভুক্ত ভোটার। দু’বছর কলকাতায় থাকার কারণে সেখানে পুরনো রেকর্ড রয়েছে। কমিশনকে সরাসরি বলেন, “আমি যদি আইন ভেঙে থাকি, তবে নোটিস না পাঠিয়ে আমাকে গ্রেফতার করুন।” তাঁর কথায়, এসআইআর অভিযান ভোটারদের ভয় দেখাতে পারেনি, বরং বিহারের মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
‘জন সুরজ’ পার্টির অর্থের উৎস
ভোটকৌশলী থেকে রাজনীতিবিদ— এই পথচলায় তাঁর আর্থিক উৎস নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকের। সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। এক সাংবাদিক বৈঠকে প্রশান্ত কিশোর জানান, গত তিন বছরে তিনি মোট ২৪১ কোটি টাকা আয় করেছেন। মূলত রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেই এই অর্থ এসেছে বলে দাবি তাঁর। প্রশান্ত কিশোর বলেন, “আমরা বিভিন্ন সংস্থা, রাজনীতিক দলের সঙ্গে পরামর্শমূলক কাজ করি। তার জন্য আমরা পারিশ্রমিক পাই। এই কাজ থেকেই আয়।” তিনি আরও জানান, এই আয় পুরোপুরি বৈধ উপায়ে হয়েছে। সরকারের কাছে করও দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, “এই তিন বছরে প্রায় ৫১ কোটি টাকা কর হিসেবে সরকারকে দিয়েছি— এর মধ্যে জিএসটি ও আয়কর দুটোই আছে।” তাঁর দাবি, আয় থেকে প্রশান্ত কিশোর ৯৯ কোটি টাকার বেশি দান করেছেন নিজের দল ‘জন সুরজ’কে। পিকের কথায়, “আমরা চাই, আমাদের দল বাইরের কারও টাকায় না চলুক। সমাজের পরিবর্তনের জন্য আমরা নিজেদের উপার্জন থেকেই দলের খরচ চালাব।”
আরও পড়ুন
বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর! নির্বাচনের সমস্ত সমীকরণ তছনছ করে দেবেন?
কেন এত টাকার অনুদান? প্রশান্ত কিশোরের দাবি, রাজনৈতিক দল চালাতে গেলে বিপুল অর্থ লাগে। কিন্তু অন্য দলের মতো শিল্পপতি বা গোপন উৎসের উপর নির্ভর করতে চান না তিনি। তাই নিজের উপার্জনের টাকা থেকেই দলের কাজের জন্য অর্থ দান করেছেন। তিনি বলেন, “মানুষ জানুক, আমরা কোথা থেকে টাকা পাই। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা থাকাই সবচেয়ে জরুরি।”
রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন
প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়, বরং তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম বড়ো বিতর্ক এটি। ভোটকৌশলী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ২০১১ সালে গুজরাটে, নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারের পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে। ২০১৪ সালে মোদির বিপুল জয়ের পর তাঁকে রাজনীতির 'গেমচেঞ্জার' বলা হয়। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেস, জেডিইউ, তৃণমূল, ওয়াইএসআর কংগ্রেস— এমনকি তেলঙ্গানার টিআরএসের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির সঙ্গেও কাজ শুরু করেন। এই বহুমুখী রাজনৈতিক সংযোগই তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, পিকে কখনও এক আদর্শ বা মতাদর্শে স্থির নন, সব রকম মতাদর্শের দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। ফলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট নয়।
তবে প্রশান্ত কিশোর নিজের অবস্থান নিয়ে বরাবরই স্বচ্ছতার দাবি করেন। তাঁর কথায়, “আমি কোনো দলের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী নই। আমি যাঁর সঙ্গে কাজ করি, তাঁকে সাফল্যের পরামর্শ দিই।” এখন যখন তিনি নিজেই ‘জন সুরজ’ নামের রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন— একজন ভোটকৌশলী কি সত্যিই নেতা হতে পারেন? ভোটের ময়দানে তিনি কতটা নিরপেক্ষ থাকবেন? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে, তবে আপাতত তাঁর এই নতুন ভূমিকা রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
নীতীশ কুমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া (২০২০)
২০১৮ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রশান্ত কিশোরকে নিজের দল জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডিইউ-র সহসভাপতি পদে নিয়োগ করেছিলেন। রাজনীতিতে এটি ছিল প্রশান্ত কিশোরের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রবেশ। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। ২০২০ সালের শুরুতে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে জেডিইউ।ভাঙনের মূল কারণ ছিল— নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) ইস্যু। নীতীশ কুমার এই আইনকে নীরবে সমর্থন করেছিলেন, প্রশান্ত কিশোর তখন প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। তিনি একাধিক টুইটে বলেন, “নীতীশজির উচিত বিহারের মানুষকে জানানো— তিনি CAA-NRC নিয়ে বিজেপির পাশে আছেন নাকি জনগণের পাশে?” এই মন্তব্যেই ক্ষুব্ধ হন নীতীশ। এরপর সংবাদমাধ্যমে নীতীশ কুমার বলেন, “পিকে অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। দল ও জোটের সীমা তিনি বোঝেন না।”প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্য ছিল, তিনি নীতির সঙ্গে আপস করতে রাজি নন। তাঁর কথায়, “আমি রাজনীতি করি মানুষের পাশে থাকার জন্য, ক্ষমতার জন্য নয়।” নীতীশ কুমারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই প্রশান্ত কিশোর ‘জন সুরাজ অভিযান’ শুরু করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর নতুন রাজনৈতিক দল জন সুরাজ পার্টি-র ভিত্তি তৈরি করে।
আরও পড়ুন
প্রশান্ত কিশোরের নতুন রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করে ঠকবেন বিহারবাসীরা?
ভোটকুশলী জানিয়েছেন, নিজে প্রার্থী হবেন না, বরং দলের প্রার্থীদের প্রচারে থাকবেন। গত তিন বছর ধরে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় ঘুরে প্রচার করছেন। তাঁর প্রচারগুলিতে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে তরুণদের। পিকে-র মূল বক্তব্য, বিহারের মানুষকে জাতপাতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি দাবি করছেন, রাজ্যে শিল্প না থাকায় লক্ষ লক্ষ তরুণ ভিনরাজ্যে সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি, “বিহারের যুবকদের আর শ্রমিক হতে হবে না, নিজের রাজ্যেই কাজ পাবে।” অন্যদিকে আবার নীতীশ কুমার, তেজস্বী যাদব ও রাহুল গান্ধী— তিনজনকেই তিনি পুরনো রাজনীতির প্রতিনিধি বলে সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, নীতীশের রাজনীতি শেষ পর্যায়ে, কংগ্রেসের নিজস্ব অবস্থান নেই, তেজস্বী বাবার ছায়া থেকে বেরোতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, এনডিএ ভোটের আগে এককালীন ১০ হাজার টাকা ও বেকার ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আবার মহাগঠবন্ধনের ইস্তাহারে বলা হয়েছে, মহিলাদের জন্য প্রতি মাসে ২,৫০০ টাকা অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে এবং পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে বছরে ৩০,০০০ টাকা করে প্রদান করা হবে। পিকে জোর দিচ্ছে এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তির উপর।
প্রশান্ত কিশোরকে ঘিরে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— তিনি কি সত্যিই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, নাকি তাঁর লক্ষ্য শুধুই রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করা?

Whatsapp
